আলিপুরদুয়ার, 13 ফেব্রুয়ারি: একটা সময় নিজে ন্যূনতম বস্ত্রের অভাব বোধ করেছেন । একটা ট্রাকশ্যুট পরেই দীর্ঘদিন কাটিয়েছেন । এমনকী ইউনিফর্ম না থাকায় স্কুলছুটও হতে হয়েছে তাঁকে ৷ তাই বস্ত্র না থাকার যন্ত্রণা ঠিক কতটা, তা তিনি জানেন । সেই কারণেই তিনি চান, অন্ন-বস্ত্রের অভাবে সেই একই যন্ত্রণা যেন কাউকে সহ্য করতে না হয় ৷
আর এই মহান উদ্যোগ যিনি নিয়েছেন, তাঁর নাম সাজু তালুকদার ৷ বছর পঞ্চাশের এই ব্যক্তি আলিপুরদুয়ারের বীরপাড়ার ডিমডিমা হাটখোলার বাসিন্দা ৷ যাঁকে সকলে চেনেন সাজুদা নামে ৷ তিনি রাস্তার ধারে অসহায় অবস্থায় পড়ে থাকা মানুষদের বাড়িতে নিয়ে এসে যত্ন করে সুস্থ করে তোলেন ৷ অসহায় মানুষদের জন্য তিনি হোম তৈরি করেছেন ৷ সেখানে এখন 49 জন পুরুষ-মহিলা আবাসিক রয়েছেন ৷ এই আবাসিকরা তাঁর পরিবারেরই সদস্য হয়ে উঠেছেন ৷
এক সময় ডিমডিমা-সহ বিভিন্ন নদীতে বালি পাথর তোলার কাজ করতেন সাজুদা ৷ সেই সময় অভাব-অনটনের সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছে তাঁকে ৷ পরিস্থিতি কিছুটা স্থিতিশীল হওয়ার পর তিনি গাড়ি চালক হিসেবে কাজ করতে শুরু করেন ৷ সেই সুবাদে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জায়গায় যেতে হয় তাঁকে । এই চলার পথে কখনও রেল স্টেশনে, আবার কখনও ফুটপাতে বস্ত্রহীন অবস্থায় অনেককেই শুয়ে থাকতে দেখেন তিনি ৷ যতবার এই দৃশ্য তাঁর চোখে পড়েছে, ততবারই তাঁর অতীতের কথা মনে পড়েছে ৷ তাঁর মতো যাতে আর কাউকে কষ্ট পেতে না হয়, সেই কারণে শুরুতে বাড়িতে থাকা পুরনো জামাকাপড় দিয়েই বস্ত্রদান শুরু করেন সাজুদা ।
এর পর সময় যত এগোয়, ততই মানুষের প্রতি সাহায্যের ইচ্ছা আরও বাড়তে থাকে তাঁর ৷ বাড়িতে আর কতই বা পুরনো জামাকাপড় থাকে ৷ তাই তিনি আত্মীয়-পরিজন থেকে বন্ধু-পরিচিত, সকলের কাছেই অনুরোধ করতে থাকেন সাহায্যের জন্য ৷ কেউই তাঁকে বিমুখ করেননি ৷ জামাকাপড়-সহ আরও অন্য উপায়ে অনেকেই তাঁর পাশে দাঁড়ান ৷ ফলে ভবঘুরেদের সাহায্যের কাজে ক্রমশ ব্রতী হতে শুরু করেন সাজুদা ৷ তৈরি করেন ‘ক্লথ ব্যাঙ্ক’ ৷ নিন্দুকেরা তাঁকে পাগল বললেও কখনও লক্ষ্যচ্যূত হননি সাজু তালুকদার ৷
![SHELTER HOME FOR VAGABONDS](https://etvbharatimages.akamaized.net/etvbharat/prod-images/13-02-2025/wb-jal-01-special-saju-talukdar-7203426_12022025130743_1202f_1739345863_86.jpg)
এভাবেই চলছিল ৷ হঠাৎই একদিন পরিস্থিতি বদলে যায় ৷ নাগরাকাটার এক ব্যক্তিতে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখেন তিনি ৷ ওই ব্যক্তিকে জামাকাপড় দিয়ে সাহায্য করলেও এই নিয়ে অনুশোচনা হয় সাজুদার ৷ একদিন গাড়িতে করেই তিনি বাড়িতে নিয়ে আসেন ওই ব্যক্তিকে । বাড়িতে চিকিৎসা হয় ওই ব্যক্তির ৷ এই নিয়ে সাজু তালুকদার বলেন, ‘‘নাগরাকাটার নন্দু মোড়ে আমি এক ব্যক্তিকে পাই । দীর্ঘ ছয় মাস দেখার পর তাঁকে বাড়ি নিয়ে আসি ।’’
এর পর থেকে সাহায্যের লক্ষ্য বদলে যায় সাজুদার ৷ তিনি একে একে আরও ভবঘুরেকে নিয়ে আসতে শুরু করেন ৷ সেই সংখ্যা বাড়তে-বাড়তে এখন 49-এ পৌঁছেছে ৷ যে ডিমডিমা নদীতে এক সময় বালি-পাথর কোড়ানো ছিল সাজুদার কাজ, সেই নদীর তীরে এখন তিনি গড়ে তুলেছেন হেভেন শেল্টার হোম ৷ যে হোম তৈরি করতে কিস্তিতে কেনা নিজের গাড়িটাকেও জলাঞ্জলি দিতে হয়েছে তাঁকে ৷
![SHELTER HOME FOR VAGABONDS](https://etvbharatimages.akamaized.net/etvbharat/prod-images/13-02-2025/23534493_sajugfx_aspera.jpg)
তবে সব আত্মত্যাগ যে তিনি নিজে করেছেন, তা নয় ৷ তাঁর এই লড়াইয়ে পাশে থেকেছে পরিবার ৷ বাড়িতে স্ত্রী, দুই ছেলে আলমগীর ও সোয়েল এবং মা রয়েছেন সাজুদার ৷ তাঁরা প্রত্যেকেই শুরু থেকে এই লড়াইয়ে পাশে থেকেছেন ৷ দুই ছেলে নিজেদের উপার্জন করা অর্থও হেভেন শেল্টারের জন্য খরচ করেন ৷
সাজুদার ছেলে আলমগীর তালুকদার বলেন, ‘‘আমরা বাবার পাশে সব সময় আছি । আমাদের দোকান থেকে যে লাভ আসে, সেটাই হোমে আমরা দিয়ে দিই । বাবা চিন্তায় অসুস্থ হয়ে পড়েন । গাড়িটা আজ আর নেই ।’’ সাজুদার স্ত্রী মামনি তালুকদার বলেন, ‘‘জায়গা-জায়গা থেকে জামাকাপড় সংগ্রহ করে আনেন । মানুষদের সাহায্য করেন । এখানেই আমাদের বাড়ি হয়ে গিয়েছে । এখানে সীমানা প্রাচীর নেই । অনেকে কোথায় চলে যাচ্ছে দেখতে হয় । এত মানুষের খাবার কীভাবে চালাবেন, সেটা ভাবতেই সাজু অসুস্থ হয়ে পড়েন । সরকারি সাহায্য পেলে ভালো হয় ।’’
![SHELTER HOME FOR VAGABONDS](https://etvbharatimages.akamaized.net/etvbharat/prod-images/13-02-2025/wb-jal-01-special-saju-talukdar-7203426_12022025130743_1202f_1739345863_136.jpg)
এছাড়া আরও অনেকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন ৷ হোমের ঘর তৈরিতে সরকারি সাহায্যও পেয়েছেন সাজু তালুকদার ৷ আলিপুরদুয়ারের বীরপাড়ার দেবীগড় কলোনির বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত এক চা-বাগান কর্মী বিকাশ রায় সাজুদাকে তাঁর বাইক দিয়ে সাহায্য করেছেন । অবসর সময়ে সাজুদা যাতে বাইকে করে বস্ত্র সংগ্রহ করতে পারেন, তাই তিনি নিজের বাইকটি দিয়েছেন ৷ এখন এই বাইক নিয়েই আলিপুরদুয়ার ও জলপাইগুড়ি জেলার বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে বেড়ান সাজুদা ৷ নতুন ও পুরনো বস্ত্র সংগ্রহ করেন তাঁর ‘ক্লথ ব্যাঙ্ক’-এর জন্য । তিনি সাহায্য করছেন চা-বাগানে থাকা বস্ত্রহীন শিশুদের ৷
সকলের কাছ থেকে পাওয়া সাহায্যের কথা অকপটে স্বীকারও করেছেন তিনি ৷ সাজু তালুকদার বলেন, ‘‘মানুষের সাহায্যেই আমার এই শেল্টার হোম চলছে । বিশেষ করে শারীরিক সমস্যা নিয়ে কিছু রোগী ও ভবঘুরে আছেন । সরকারি ভাবে পরিকাঠামো উন্নয়নের সাহায্য আমি পেয়েছি । সমাজের শুভানুধ্যায়ীদের সাহায্যেই চলছি । সরকারিভাবে আরও সাহায্য না পেলে সামনে অসুবিধা হবে ।’’
![SHELTER HOME FOR VAGABONDS](https://etvbharatimages.akamaized.net/etvbharat/prod-images/13-02-2025/wb-jal-01-special-saju-talukdar-7203426_12022025130743_1202f_1739345863_937.jpg)
তিনি আরও বলেন, ‘‘এক থেকে দেড় লক্ষ টাকা আমার খরচ আছে । কষ্ট কী জিনিস, আমি খুব কাছে থেকেই দেখেছি । এই মানুষদের জন্য আমি কষ্ট করতেও রাজি ।’’ এছাড়া আবাসিকদের খাবারের জোগান দিতে কিচেন গার্ডেনও তৈরি করেছেন সাজুদা । শীতকালীন সবজি চাষ করেছেন । আর সেই সবজি দিয়েই তিনবেলা আবাসিকদের খাওয়াচ্ছেন ।
তিনবেলা খাবার ও মাথাগোঁজার ঠাঁই পাওয়ায় খুশি আবাসিকরা ৷ তাঁদের একজন দিলীপ গুরুং ৷ বীরপাড়ার এই বাসিন্দা বলেন, ‘‘দুই বছর ধরে আমি এখানে থাকি । এখানে খাওয়াদাওয়া সব দিচ্ছে । আমি খুব খুশিতেই আছি । খুব ভালো দেখভাল করে রাখে আমাদের ।’’ আরেকজন আবাসিক শালভিনা রাজপুত বলেন, ‘‘পটনার এক বেসরকারি নার্সিংহোমে কাজ করতাম । আমি নিখোঁজ হয়ে যাই । তার পর এখানে ঠাঁই হয় ৷ আমি এখন ভালো আছি । ওষুধ খাচ্ছি । বাড়ির কথা মনে পড়ে । এখানে থাকতে আর ইচ্ছে করে না ।’’
![SHELTER HOME FOR VAGABONDS](https://etvbharatimages.akamaized.net/etvbharat/prod-images/13-02-2025/wb-jal-01-special-saju-talukdar-7203426_12022025130743_1202f_1739345863_706.jpg)
হোমের অন্য এক আবাসিক ছত্রে দোরজি বলেন, ‘‘আমি একবছর ধরে এখানে রয়েছি । আমার পরিবারে কেউ নেই । তাই আমি এখানে সাজু তালুকদারের হোমে এসেছি ।’’ তবে তিনি এখানে শুধু একজন আবাসিক নন ৷ বরং হোম চালানোর কাজেও সাহায্য করেন ৷ তিনি বলেন, ‘‘আমি আবাসিক ভাই বোনেদের দেখভাল করি । সবজি বাগান করি । আবাসিকদের দেখভাল করতে হয় । তবে খুব কষ্টে আবাসিকদের খাওয়াচ্ছেন সাজুদা । তাঁর অনেক কষ্ট ।’’
তাঁর শেল্টার হোমে এখন পুলিশও অনেককে রেখে যায় ৷ কারণ, উত্তরবঙ্গে এই ধরনের কোনও সরকারি শেল্টার হোম নেই ৷ তাই হেভেন শেল্টার হোমের জন্য আরও সাহায্যের আবেদন জানিয়েছেন তিনি ৷ কারণ, এই হোমের ভবিষ্যৎ নিয়ে তিনি চিন্তিত ৷ নিজে মুখে বলছেন, ‘‘ছেলেরা আমায় সাহায্য করছে৷ আগামিদিনে কী হবে জানি না ।’’