হায়দরাবাদ, 27 নভেম্বর: ভিশন 2047 ! ভারতীয় ফুটবলের উত্তরণ, জাগরণ এবং তাকে আন্তর্জাতিক স্তরে পৌঁছে দিতে রোডম্যাপ নিয়েছিল দেশের ফুটবল ফেডারেশন ৷ 2023 সালে জানুয়ারি মাসে এআইএফএফ জানিয়েছিল, ভারতকে এশিয়ার সেরা 4টি দলের মধ্যে একটি এবং বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফুটবলারদের সাপ্লাই-লাইন হিসেবে তুলে ধরার লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে ৷
অ্যাড-অন হিসেবে ফেডারেশন কর্তাদের দাবি, 2046 সালে বিশ্বকাপ খেলবে ভারত ৷ তাঁদের দাবি শুধু নয়, ফেডারেশনের বেঁধে দেওয়া লক্ষ্যে ভারতীয় ফুটবল পৌঁছলে এমনিতেই বিশ্বকাপ খেলতে পারবে দেশ ৷ যদিও গম্ভীর আলোচনা, কঠিন ভাষায় রোডম্যাপ তৈরি করা কিংবা সুন্দর গ্রাফিক্সে তা বোঝানো, পুরোটাই পরিকল্পনা ভিত্তিক, স্বপ্নের উপর ভিত্তি করে গড়া ৷ বাস্তব কিন্তু বলছে অন্যকথা ৷
2024 সালে ফুটবলে জয়ের মুখই দেখেনি ভারত ৷ টানা এগারো ম্যাচে জয় নেই ৷ বর্তমানে ফিফা ক্রমতালিকায় 125 নম্বরে ভারত। মালয়েশিয়া 133 নম্বরে । ফিফা ক্রমতালিকায় 8 ধাপ নীচে থাকা দেশের কাছেও আটকে গিয়েছে ভারত ৷ 2046 বিশ্বকাপের ‘মাত্র’ 22 বছর আগে ভারতীয় ফুটবলের এই হাল কেন ? 2023 সালে নেওয়া রোডম্যাপের দু’বছর পরেও তথৈবচ দেশের ফুটবলের হাল ৷ সমস্যাটা কোথায় ?
প্রাক্তন ফুটবলার অলোক মুখোপাধ্যায় বুটজোড়া তুলে রেখেছেন প্রায় 25 বছর আগে ৷ দেশের অনুর্ধ্ব-20 দলের কোচও ছিলেন ৷ তিনিও ওয়াকিবহাল ফেডারেশনের রোডম্যাপ এবং ভারতীয় ফুটবলের বাস্তবতার আকাশ-পাতাল পার্থক্যে ৷ ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানে দাপিয়ে খেলা অলোকের একে ‘অলীক স্বপ্ন’ ছাড়া কিছু ভাবতে নারাজ ৷ ‘‘এশিয়ায় ভালো ফল করে বিশ্বকাপের স্বপ্ন দেখা উচিৎ ৷ সেমিফাইনাল না-খেলে ফাইনাল খেলা যায় না ৷’’ মন্তব্য প্রাক্তন লেফট উইঙ্গারের ৷ শুধু ফেডারেশন কর্তাদের দাবি নয়, এত সুযোগ-সুবিধা পেয়েও দেশের খেলোয়াড়দের কেন এই পারফর্ম্যান্স, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তিনি ৷
অলোকের সঙ্গেই একমত অ্যালভিটো ডি’কুনহাও ৷ ইস্টবেঙ্গলের প্রাক্তনী জানালেন, এর আগেও ‘ভিশন 2010’ নেওয়া হয়েছিল ৷ তাতে কী হয়েছে, আমাদের চোখের সামনে ৷ এরপরেও বহু ভিশন আসবে ৷ কিন্তু ভারতীয় ফুটবলের মান দিন দিন পড়তির দিকে ৷ 2024 সালে গোটা বছরে একটা ম্যাচও জিততে পারেনি ভারত ৷ এত সুযোগ, আইএসএল খেলে এত টাকা ৷ তাও ফুটবলারা কেন পারফর্ম করতে পারছেন না ? সেই প্রশ্নও তুলেছেন অ্যালভিটো রোনাল্ডো কোরিয়া ডি'কুনহা ৷
দুই প্রাক্তনী বাস্তবকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেও তাঁদের সঙ্গে একমত নন মেহতাব হোসেন ৷ লাল-হলুদের প্রাক্তন মিডফিল্ড জেনারেল ফেডারেশনের ‘অলীক’ স্বপ্নে আস্থা রাখছেন ৷ ‘‘যদি এখন থেকে ঠিকমতো রোডম্যাপ তৈরি করা যায়, তাতে সময়-অর্থ ঠিকমতো বিনিয়োগ করা যায়, ধাপে ধাপে উন্নতি করা যায়, তাহলে বিশ্বকাপ খেলাও যায় ৷ এই রোডম্যাপ ঠিকমতো চললে স্বপ্ন কঠিন হলেও অসম্ভব নয়’’, মন্তব্য মেহতাবের ৷
- ভিশন 2047 কী ?
ফুটবল দর্শন, স্কাউটিং থেকে তথ্য সংগ্রহ সমস্তকিছু নিয়ে ভাবা হবে আগামী কয়েক বছরে ৷ একটি নির্দিষ্ট ক্রমবিন্যাস সাজানো হবে ৷ কোচ এবং খেলোয়াড়দের উন্নতির উপর ফোকাস করা হবে ৷ এআইএফএফ সারা দেশে 50 হাজার কোচ তৈরির লক্ষ্য নিয়েছে ৷ যার মধ্যে প্রায় 4,500 জনের ন্যূনতম AIFF সি লাইসেন্স থাকবে বলে রোডম্যাপে বলা হয়েছে ।
তথ্য সংগ্রহ এবং একটি স্কাউটিং সিস্টেম তৈরি করা হবে, যার ডেডলাইন 2026 । ভারতের গ্রামগুলিতে সাড়ে 3 কোটি শিশুকে ফুটবলের সঙ্গে প্রাথমিক পরিচয় করানো হবে ৷ অর্থাৎ তৃণমূল স্তর থেকে ফুটবলার তুলে আনার কাজ শুরু হবে ৷
2026 সালের মধ্যে মহিলাদের ফুটবলের জন্য একটি চার-স্তরের লিগ টেবিল পিরামিড তৈরি করা হবে ৷ পিরামিডের শীর্ষে থাকবে ভারতীয় মহিলা লিগ (10টি দল ), তারপরে 2য় বিভাগ (8টি দল)। এআইএফএফ 2027 সালের মধ্যে নতুন মহিলাদের যুব কাঠামো বাস্তবায়নের জন্য ন্যূনতম 20টি রাজ্যকে লক্ষ্য করেছে ।
- ভারতের খেলা কী বলছে ?
গোলমুখে প্রত্যাশিত ধার না-থাকায় গোলের মুখ খুলতে পারছে না ভারত । এখনও সুনীল ছেত্রীর জায়গা ভরাট করার কেউ নেই ৷ তারুণ্যের ওপর জোর দিলেও জয় অধরা । 2017 সালে দেশে আয়োজিত হয়েছিল অনুর্ধ্ব-17 বিশ্বকাপ ৷ আয়োজক দেশ হিসেবে খেলেছিল ভারত ৷ ঘানা, কলম্বিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে হেরে গ্রুপের লায় বয় হয়ে বিদায় নেয় ভারত ৷ তিন ম্যাচে 9 গোল খেয়েছিল ‘মেন ইন ব্লু’ ৷ ওই দলের আনোয়ার আলি, অমরজিৎ সিংম কিয়াম, রহিম আলিরা জাতীয় দলে নিয়মিত হলেও নিজেদের মেলে ধরতে ব্যর্থ ৷
- এশিয়া ব়্যাংকিং
ফিফা ক্রমতালিকায় ভারত বর্তমানে 127 ৷ এএফসি তালিকায় 23 ৷ ইন্দোনেশিয়া, উত্তর কোরিয়াও ভারতের উপরে ৷ 2022 বিশ্বকাপে জার্মানিকে হারিয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া ৷ বিশ্বচ্যাম্পিয়ন আর্জেন্তিনা প্রথম ম্যাচেই হেরেছিল সৌদি আরবে কাছে ৷ রয়েছে জাপান, অস্ট্রেলিয়া, ইরানের মতো দেশও ৷ সুতরাং এশিয়ার সেরা 4টি দলের মধ্যে একটি হওয়ার ভারতের যে পরিকল্পনা, তা ‘মিরাকল’ না-হলে আগামী 22 বছরে অসম্ভব ৷
শুধু তাই নয়, 2026 সালের মধ্যে এশিয়া ব়্যাংকিংয়ে প্রথম দশে পুরুষদের দল এবং মহিলা দলকে প্রথম আটে আনার কথা বলা হয়েছে ৷ অর্থাৎ তা সত্য়ি করতে হলে আগামী দু’বছরে এশিয়া ব়্যাংকিংয়ে পুরুষ দলকে উঠতে হবে 13 ধাপ ৷ বর্তমানে 13 নম্বরে থাকা মেয়েদের উঠতে হবে 5 ধাপ ৷ ফলে রোডম্যাপ থাকলেও তার বাস্তবায়ন এবং ফলাফল নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে ৷