কলকাতা, 13 ফেব্রুয়ারি: এতদিন যে বিষয়টি নিয়ে মহারাষ্ট্র-দিল্লির রাজনীতি সরগরম হয়েছে, এবার ভোটার তালিকায় গরমিলের সেই অভিযোগ নিয়ে উত্তপ্ত হতে শুরু করেছে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি ৷ পুরোটাই শুরু হয়েছে বুধবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের করা একটি মন্তব্যের প্রেক্ষিতে ৷ যার পর রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস এখনই ভূতুড়ে ভোটার ধরতে কোমর বেঁধে নামার পরিকল্পনা করেছে ৷ অন্যদিকে ভোটার তালিকায় গরমিলের এই অভিযোগকে গুরুত্ব দিতেই নারাজ রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল বিজেপি ৷
মহারাষ্ট্রে বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি-শিবসেনা-এনসিপির কাছে পর্যুদস্ত হওয়ার পর ভোটার তালিকায় গরমিলের অভিযোগ তুলে সরব হয় বিরোধীরা ৷ 2024 সালের গোড়ায় লোকসভা নির্বাচনের সময় থেকে বছরের শেষে বিধানসভা নির্বাচনের আগে মহারাষ্ট্রে অস্বাভাবিক হারে ভোটার বৃদ্ধি পেয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে ৷ সম্প্রতি দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশের আগেরদিন এই নিয়ে দিল্লিতে সাংবাদিক বৈঠকও করেন লোকসভার বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধি ৷ সেখানে মহারাষ্ট্রে তাঁর দলের দুই শরিক শিবসেনা (ইউবিটি)-র সঞ্জয় রাউত ও এনসিপি (এসপি)-র সুপ্রিয়া সুলে ৷
গত কয়েকমাস ধরে এই নিয়ে জাতীয় রাজনীতিতে চর্চা হলেও বাংলায় সেভাবে হয়নি ৷ বুধবার বিধানসভায় বাজেট নিয়ে সাংবাদিক বৈঠক চলাকালীন আচমকাই এই প্রসঙ্গ তোলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ৷ তিনি অভিযোগ করেন, নির্বাচন কমিশনের সাহায্য নিয়ে অনলাইনে ভূতুড়ে ভোটারদের নাম তোলা হচ্ছে । বিশেষ করে বিহারের বাসিন্দাদের নাম তুলছে একটি রাজনৈতিক দল । কেন ভোটার কার্ডে নাম তোলার কাজ অনলাইনে হবে, সেই প্রশ্ন তোলেন তিনি । পাশাপাশি মহারাষ্ট্রের প্রসঙ্গ তোলেন মুখ্যমন্ত্রী ৷ প্রশ্ন তোলেন, 40 লক্ষ ভোট বাড়ল কী করে মহারাষ্ট্রে ? দিল্লিতেই বা কী করেছেন ? একদিন না একদিন তো বেরোবেই ।
এই প্রসঙ্গে মমতা আরও বলেছিলেন, ‘‘আমরা অঙ্ক কষে দেখে নিয়েছি । এখানেও বাবুরা এসে বসে আছেন প্রত্যেকটা বিধানসভায় । 30 হাজারের নাম ঢোকানো হবে বাইরে থেকে । নির্বাচন কমিশন ভোট করবে সেন্ট্রাল ফোর্স দিয়ে । তারা গার্ড দেবে আর বাইরের লোকেরা এসে, যারা বাংলার ভোটার নয়, তারা এসে ভোট দেবে । এই পরিকল্পনা এখানে আমরা ভেস্তে দেব । অন্য রাজ্য যেটা পারে না, সেটা বাংলা পারে ।’’
আগামী বছর রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন ৷ সেই ভোটের প্রায় এক বছর আগে মুখ্যমন্ত্রীর এই মন্তব্যকে হাতিয়ার করে ময়দানে নামার প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে তৃণমূল ৷ শাসক দল সূত্রে খবর, ইতিমধ্যেই জনপ্রতিনিধিদের কাছে নির্দেশ পৌঁছেছে । সেই নির্দেশে বলা হয়েছে, প্রত্যেক জনপ্রতিনিধিকে নিজের এলাকায় ভোটার তালিকা তৈরির বিষয়টির উপর নজরদারি করতে হবে ৷ যাঁরা সংযোজন ও বিয়োজনের সঙ্গে যুক্ত, তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে ৷ যে সমস্ত নাম তালিকায় উঠছে, সেগুলি খতিয়ে দেখতে হবে ৷ নতুন করে যাঁদের নাম উঠেছে, তাঁরা আদৌ ওই এলাকায় থাকেন কি না, সেটাও দেখতে হবে । সব তথ্য সংগ্রহ করে তা দলের কাছে জানানোর কথাও বলা হয়েছে ৷
এই নির্দেশ পাওয়ার পর শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়, মানস ভুঁইয়ার মতো নেতারা এই নিয়ে তড়িঘড়ি বৈঠক ডেকেছেন । শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় আগামী শনিবার এই নিয়ে বৈঠক ডেকেছেন । এরপর তিনি নির্বাচন কমিশনেও যাবেন । এরপর বুথ ধরে ধরে ভোটার তালিকা খতিয়ে দেখে সংযোজন-বিয়োজনের তথ্য সংগ্রহ করবেন ৷ তিনি বলেন, ‘‘বাংলাকে দিল্লি-হরিয়ানা করতে দেব না ।’’ একইভাবে মানস রঞ্জন ভুঁইয়াও এই বিষয়টি নিয়ে বৈঠকে বসছেন । তাঁর জেলায় (পশ্চিম মেদিনীপুর) অন্যান্য বিধায়কদের সঙ্গে বিষয় নিয়ে তাঁর কথা হয়েছে ।
বৃহস্পতিবার এই প্রসঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের অন্যতম রাজ্য সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষ জানান, দিল্লি ও মহারাষ্ট্রে ভুয়ো ভোটার প্রকাশের পরে বিষয়টি সারা দেশে আলোচিত হচ্ছে । এর ওপর কড়া নজর রাখছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ৷ ভোটার তালিকার দিকে নজর রাখতে সব দলের নেতাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে ৷
যদিও বাংলার রাজনীতিতে ভূতুড়ে ভোটার নিয়ে অভিযোগ নতুন নয় ৷ সেই বাম আমল থেকেই এই নিয়ে অভিযোগ শোনা যায় ৷ সেই সময় কাঠগড়ায় থাকত সিপিএম ৷ আর অভিযোগ করত তৃণমূল ৷ এখন অবশ্য সিপিএম-কংগ্রেস-বিজেপি একযোগে এই নিয়ে অভিযোগ করে বর্তমান শাসক দল তৃণমূলের বিরুদ্ধে ৷ কিন্তু এবার এই অভিযোগ তুলেছেন স্বয়ং শাসক দল তথা রাজ্য প্রশাসনের প্রধান ৷
স্বাভাবিকভাবেই এই নিয়ে হইচই পড়েছে রাজ্য রাজনীতিতে ৷ প্রধান বিরোধী দল বিজেপিও এই নিয়ে মুখ খুলেছে ৷ পালটা তৃণমূলের বিরুদ্ধেই তোপ দেগেছে বিজেপি ৷ তাদের দাবি, মহারাষ্ট্র এবং দিল্লির ফলাফল দেখে তৃণমূল কংগ্রেস একরকম নিশ্চিত হয়ে গিয়েছে যে এ রাজ্যে তাদের পরাজয় শুধুমাত্র সময়ের অপেক্ষা । তাই এসব কথা বলে বিষয়টিকে হালকা করতে চাইছেন তৃণমূল নেতারা ।
এদিন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রীর কোনও কাণ্ডজ্ঞান আছে । 14 বছর ধরে মুখ্যমন্ত্রী রয়েছেন, ভোটার তালিকা ভেরিফিকেশন অফিসার কে ? বাংলায় 16 লক্ষ ভুয়ো ভোটার আমরা চিহ্নিত করে দিয়েছি । বিধানসভা নির্বাচনের আগে সেগুলো আমরা ডিলিট করাব ।’’
বিজেপি নেত্রী তথা বিধায়ক অগ্নিমিত্রা পাল বলেন, ‘‘তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা-নেতৃত্বের কিছু বলার আগে কোনও ট্যাক্স লাগে না। যা পারছেন বলে দিচ্ছেন । ভোটার তালিকা বানানো, চেক করা, সংযোজন-বিয়োজন সবটাই তো জেলাশাসকের হাতে । জেলাশাসককে কে নিয়োগ করেন ? প্রশাসন তো আপনার৷ এসব ভিত্তিহীন অভিযোগ করে লাভ কি ?’’
তবে ভোটার তালিকায় গরমিল সংক্রান্ত এই অভিযোগের জল যেদিকেই গড়াক না কেন, ভোট যত এগিয়ে আসবে, ততই এই নিয়ে উত্তাপ বাড়বে বঙ্গ রাজনীতিতে ৷