হায়দরাবাদ, 11 জুন: লোকসভার ফলাফল এবার অস্বাভাবিক । এই ফল বিজয়ীদের কাছে হেরে যাওয়ার মতোই । আর পরাজিতদের অনুভূতি আবার বিজয়ীদের মতো । আসুন ব্যাখ্যা করা যাক । এবার বিজেপি শুধু 272 আসনের সহজ সংখ্যাগরিষ্ঠতাই আশা করেনি । তারা স্বপ্ন দেখেছিল 400 পারের ৷ তবে সেই সংখ্যাটা যখন মাত্র 240-এ আটকে গেল, তখন মনে হয়েছিল যেন তারা হেরেই গিয়েছে । যদিও এটা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন যে, তাদের সংখ্যাটা দ্বিতীয় বৃহত্তম দল কংগ্রেসের থেকে অনেক বেশি ৷ কংগ্রেস মাত্র 99টি আসনই জিততে পেরেছে । কিন্তু বিজেপির হতাশার অন্যতম কারণ, তাঁদের প্রত্যাশিত 400-র থেকে জেতা আসনের সংখ্যাটা অনেকটা কমে যাওয়ায় ৷ ম্যাজিক ফিগার 272 -এর থেকেও তাঁদের আসনের সংখ্যাটা 32 কম ৷
আর কংগ্রেস এই নিয়ে টানা তৃতীয় নির্বাচনে লোকসভার অর্ধেক আসনের ধারে কাছেও আসতে ব্যর্থ ৷ গত তিনটি নির্বাচনে তাদের জেতা আসন সংখ্যা 44, 52 এবং 99 যোগ করলেও সেই সংখ্যাটা বিজেপির 2024 সালের জেতা আসনের থেকে 45 কম ৷ সুতরাং, আপনি ভালোভাবে জিজ্ঞাসা করতে পারেন যে রাহুল গান্ধি এমন কেন ভাব করছেন যেন তিনিই নির্বাচনে জিতেছেন ? তিনি বিজেপিকে সংখ্যাগরিষ্ঠতায় পৌঁছতে দেননি ৷ এই সীমিত অভিযানে তিনি সাফল্য দাবি করতেই পারেন । তবু তিনি মোদিকে টানা তৃতীয়বারের জন্য প্রধানমন্ত্রী হতে বাধা দিতে পারেননি । এটি একটি ছোট কৃতিত্ব নয় ৷ এই নজির একমাত্র রয়েছে প্রথম প্রধানমন্ত্রী নেহরুর, যিনি 1962 সালের নির্বাচনে এই কৃতিত্ব অর্জন করেছিলেন ৷
তাই সোজা কথায় আসা যাক ৷ রাহুল গান্ধি যদি এখনও 2024 সালের ফলাফলের ময়নাতদন্ত করতে বলেন, তবে তাঁর ক্রিকেট বিশ্ব থেকে এটি বিষয় বিবেচনা করা উচিত । ধরুন, বিরাট কোহলি প্রকাশ্যে তিনটি সেঞ্চুরি করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকেন, তাতে দেখা গেল পরপর দুটি সেঞ্চুরি করলেও তিনি তৃতীয় ম্যাচে দশ বা তার সামান্য কিছু বেশি রানের জন্য তিন অঙ্কের স্কোরে পৌঁছতে পারলেন না । এটি কি তাঁর হেরে যাওয়া ? তাঁকে কি ভালো ব্যাটসম্যান বলা হবে না ? উত্তর পরিষ্কার ।
400-পার স্লোগান বিজেপির প্রচারকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে । কারণ এই স্লোগানকে কাজে লাগিয়েই কংগ্রেস ছড়িয়ে দিয়েছে যে, মোদি 400টি আসন চেয়েছিলেন যাতে তিনি আম্বেদকরের সংবিধানকে ফেলে দিতে পারেন এবং তফসিলি জাতি ও উপজাতি এমনকি অন্যান্য অনগ্রসর জাতিদের জন্যও সংরক্ষণ বন্ধ করতে পারেন । এই প্রচার উত্তরপ্রদেশে দলিতদের একটি বিশাল অংশকে বিভ্রান্ত করেছে, যারা কংগ্রেস এবং সমাজবাদী পার্টিকে ভোট দিয়েছে ৷ এমনকি তারা ত্যাগ করেছে মায়াবতীর বিএসপিকেও ।
400 পারের লক্ষ্যের সরাসরি পতন এনে দেয় 20-শতাংশ মুসলমানের একত্রিত হয়ে বিজেপির বিরুদ্ধে ভোট দেওয়া এবং মোদিকে প্রধানমন্ত্রী হতে বাধা দেওয়া ৷ প্রচারের মাঝপথে যখন বিজেপি বুঝতে পেরেছিল যে সংবিধান পরিত্যাগ করার বিষয়ে কংগ্রেসের প্রচার তাদের সুফল দিচ্ছে, তখন গেরুয়া শিবির ড্যামেজ কন্ট্রোল করার চেষ্টা করেছে । মোদি বলেন, কংগ্রেস এসসি-এসটি এবং ওবিসি সংরক্ষণ ত্যাগ করতে চেয়েছিল এবং তা মুসলিমদের দিতে চেয়েছে ৷ বিরোধীদের অপপ্রচারের মোকাবিলা করার জন্যই এ কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী ৷
তবে প্রকৃতপক্ষে মুসলিম বিরোধী বাগাড়ম্বর বিজেপির বিরুদ্ধে ভোট দিতে মুসলমানদের সংকল্পকে দৃঢ় করেছে । মৌলবী-মোল্লা ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের প্রধানদের জবাব দেওয়া নেতারা বিজেপিকে পরাজিত করতে ভোট দিয়েছেন । উত্তরপ্রদেশে তারা বিএসপি বা অন্যান্য গোষ্ঠীর টিকিটে দাঁড়ানো দুর্বল মুসলিম প্রার্থীদের ভোট দিয়ে ভোট নষ্ট করেননি ৷ মুসলিম একত্রীকরণ এমনই ছিল যে, অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত শর্মার মতো চৌকস নেতাও তিনটি লোকসভা আসনে বিজেপি প্রার্থীদের পরাজিত করতে মুসলিম ভোটারদের ভূমিকায় দুঃখ প্রকাশ করেছেন । বিদায়ী লোকসভার বিরোধী দলের নেতার ভাগ্যই একবার বিবেচনা করুন । অধীররঞ্জন চৌধুরী । নব্বইয়ের দশকের শেষ দিক থেকে তিনি পশ্চিমবঙ্গের বহরমপুর আসনে জয়ী হয়ে আসছেন । কিন্তু তিনিও এবার হেরেছেন ৷ তাও আবার গুজরাতের প্রাক্তন ক্রিকেটার ইউসুফ পাঠানের কাছে ৷ এই আসনটিতে 52 শতাংশ মুসলিম রয়েছে । 70,000 ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হওয়ার পর অধীর চৌধুরী বলেন, "...30 বছর ধরে বহরমপুরের জন্য আমার ঘাম ও রক্ত দিয়েছি ৷ আমি কী করতে পারি, আমি আমার পরাজয় মেনে নিচ্ছি ।" মুসলিমরা ঝেঁটিয়ে পাঠানকে ভোট দেন ৷ গুজরাতের একজন মুসলিম চৌধুরীকে হারাল । এটাই শেষ কথা ।
এখনও আরেকটি প্রাসঙ্গিক সত্য রয়েছে ৷ উত্তরপ্রদেশের রামপুর লোকসভা কেন্দ্রে একটি গ্রাম রয়েছে ৷ একশ শতাংশ মুসলমান । এই গ্রামে প্রধানমন্ত্রীর আবাস যোজনায় প্রায় 550টি দরিদ্রদের বাড়ি দিয়েছে যোগী সরকার । এখানেও একটি ভোটও বিজেপি পায়নি ৷ সন্দেহ নেই, বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব টিকিট দেওয়ার ক্ষেত্রে যোগী এবং অন্যান্য রাজ্য নেতাদের ইচ্ছাকে উপেক্ষা করেছে ৷ শুধু টিকিট বণ্টন নয়, পুরো নির্বাচনী অনুশীলনের অন্যান্য দিকগুলিও দিল্লি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়েছে । তাই দলের 272 সংখ্যাটা অতিক্রম করতে না পারার দায়ভার কেন্দ্রীয় নেতাদেরই বহন করতে হবে ।
এদিকে মোদির নৌকায় দোলা দিতে নীতীশ কুমার ও চন্দ্রবাবু নাইডুকে নিয়ে কংগ্রেস শিবিরের প্রত্যাশা নিয়ে আলোচনা করা যাক ৷ এই দুই নেতাই তা করতেন না ৷ দুটি কারণে ৷ উভয়ই জানেন যে, তথাকথিত ইন্ডি জোটের স্থিতিশীল সরকার হওয়া সম্ভব নয় । দুই, যদি জেডি(ইউ) এবং টিডিপিও সমর্থন প্রত্যাহার করে, যার সম্ভাবনা একেবারেই নেই, তবুও মোদির সরকার অন্যান্য সাংসদদের নিয়ে ম্যাজিক ফিগার অতিক্রম করে যেত ৷ মোদিকে প্রধানমন্ত্রী করলে তাঁরা তাঁদের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী তাঁদের রাজ্যের জন্য অনুকূল সুবিধে বের করে আনতেও সক্ষম হবেন ৷ এছাড়াও, মোদি সবসময় বাজপেয়ীর মতো সহানুভূতিশীল এবং বন্ধুত্বপূর্ণ নন । তাঁকে বাঁকানো যাবে না । স্বভাবগতভাবে তিনি এতটাই শক্তিশালী নেতা যে, শরিকদের ব্ল্যাকমেইলের কাছে আত্মসমর্পণ করার থেকে আগাম নির্বাচন ডেকে আনারই চেষ্টা করবেন তিনি ৷ মিত্রদের নিয়ে যতদিন মোদি এনডিএ-3.০ চালাবেন, ততদিন তিনি দৃঢ় ও আশ্বস্ত হয়ে দৌড়বেন, নিজের মত থেকে নড়বেন না ৷ যেটা ইউপিএ-1.০- ও ইউপিএ-2.0 সরকারে মনমোহন সিং প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন হয়েছিল ৷
হ্যাঁ, নতুন সরকার তাঁর সমালোচকদের প্রতি সদয় হওয়ার চেষ্টা করবে । কিন্তু এখানে আবার, মোদি সরকারকে আক্রমণ করার ক্ষেত্রে রাহুল গান্ধি কোনও সংযম এমনকি দায়িত্বও দেখাবেন না ৷ বিবেচনা করুন, বিভিন্ন এক্সিট পোলের ফলাফলের পর শেয়ার বাজারের অস্থিরতার পেছনে মোদি ও শাহের হাত ছিল, এমন বিচিত্র অভিযোগও করেছেন তিনি ৷ রাহুলের আগ্রাসন এবং সংঘর্ষকে দৃঢ়ভাবে দমন করবে মোদি সরকার, কারণ মোদি দুর্বল বা নম্র নন মনমোহন সিং-এর মতো ।