রাইপুর, 27 মে : ইচ্ছা থাকলে উপায় হয় । হাজার প্রতিকূলতা জয় করা যায় ইচ্ছেশক্তির জেরেই । তার প্রমাণ দিল জঙ্গলমহলের প্রত্যন্ত গ্রামের অনিমা মুর্মু ও সনকা হেমব্রম । রাইপুরের চাতরি গ্রামের পণ্ডিত রঘুনাথ মুর্মু আবাসিক বিদ্যালয়ের এই দুই ছাত্রী অলচিকিতে মেয়েদের মধ্যে রাজ্যে প্রথম হয়েছে । তাদের প্রাপ্ত নম্বর 445 । অন্যদিকে, উচ্চমাধ্যমিকে রাজ্যে অলচিকিতে প্রথম হয়েছে রঘুনাথ কাঁকসার একলব্য আদিবাসী রেসিডেন্সিয়াল স্কুলের ছাত্র বিশ্বনাথ মুর্মু । তার প্রাপ্ত নম্বর 457 ।
বাড়িতে নুন আনতে পান্তা ফুরোয় গোছের অবস্থা । রানিবাঁধের বনশোল গ্রামে ছোটো একটি মাটির ঘর । সেখানে বাবা-মা ও বোনের থাকে সনকা । তাঁর বাবা-মা বাবুদের জমিতে কাজ করে কোনওরকমে সংসার চালান । পরীক্ষার আর মাত্র দু'দিন বাকি । হ্যারিকেনের আলোয় পড়তে বসেছে সনকা । হঠাৎ পাশের বাড়ির কাকিমা এসে বলেছিল, "কী বিটি কী করছিস।" বই থেকে মুখ উঠিয়ে সনকা উত্তর দিয়েছিল, "পড়তে বসেছি দেখতে পাও লাই ।" তখন কাকিমা বলেছিল, "আমরা কামিন মানুষ । যতই পড়াশোনা করিস না কেন সেই বাবুদের কামিনগিরিই তো করতে হবে । কেউ দাম দেবে লাই তোর পড়াশোনার। " বুকের ভিতরটা কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠেছিল সনকার । মায়ের কাছে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, "আমরা কামিন মানুষ । তা বলে আমাদের কি স্বপ্ন থাকতে লাই । " জেদটা ছিল আগেই । ভিতরের অদম্য ইচ্ছেটাও সেদিন বলে উঠেছিল, "না কিছু একটা করে দেখাতেই হবে ।"
ফলাফল দেখার পরই চোখ ছলছল করে ওঠে সনকার । কারণ উচ্চমাধ্যমিকে অলচিকি ভাষায় প্রথম সে । ছুটে গিয়ে মাকে বলেছিল, "মা আমি প্রথম হয়েছি । আমাদের দুঃখের দিন শেষ । আমি আরও পড়াশোনা করব । আমি শিক্ষিকা হব মা ।" কিন্তু ভাগ্যের ফের । মেয়েকে পড়াশোনা করানোর ইচ্ছাটা ষোলো আনা থাকলেও পয়সা কোথায় ? সনকার মা বলে ওঠেন , "বিটি আমার ভূগোল নিয়ে পড়তে চায় । খরচ তো অনেক । এত টাকা পাব কোথায় ?" ফের খানিকক্ষণ চুপ থাকার পর বলে ওঠেন, "সরকার কিছু সাহায্য করলে হয়তো স্বপ্নপূরণ হতে পারে সনকা । না হলে আমরা তো দিনমজুর আমাদের ইচ্ছা থাকলেও উপায় কোথায়?"
তবে সনকার থেকে অর্থিকভাবে কিছুটা স্বচ্ছল অনিমার পরিবার । রাইপুরের লোহামোড়া গ্রামের বাসিন্দা সে । তার বাবা শিবু মুর্মু কৃষক । ছয় মেয়ের দায়িত্ব তাঁর কাঁধে । অনিমার ইচ্ছে অলচিকি ভাষা নিয়ে গবেষণা করার । সেই ইচ্ছেকে কতটা সফল করতে পারবেন তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন শিবুবাবু । তবে যাই হোক না কেন এই দুই ছাত্রীর ফলাফলে বেশ গর্বিত রাইপুরের চাতরি গ্রামের পণ্ডিত রঘুনাথ মুর্মু আবাসিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কৌশিক চ্যাটার্জি।
বড় হয়ে উকিল হতে চায় কাঁকসার মলানদিঘির বাসিন্দা বিশ্বনাথ । বিশ্বনাথের বাবা বাবুরাম ভাগচাষি। তাঁর বাকি দুই ছেলে বেকার । তাই পাঁচজনের পেট চালাতে হয় তাঁকে । পরিবারের আর্থিক অবস্থা দেখে নিজের উচ্চশিক্ষা নিয়ে শঙ্কিত বিশ্বনাথ । অর্থের যোগান দিতে পারবেন তো তাঁর বাবা মা ? এই প্রশ্নটাই ভাবাচ্ছে তাকে ।