ETV Bharat / state

সদাই ফকিরের পাঠশালা, গুরুদক্ষিণা বছরে মাত্র 2 টাকা

আদিবাসী অধ্যুষিত আউশগ্রামের প্রত্যন্ত জঙ্গল এলাকার ছেলে- মেয়েদের বছরে মাত্র 2 টাকা গুরুদক্ষিণার বিনিময়ে পড়ান শিক্ষক সুজিত চট্টোপাধ্যায় ৷

Sujit Chatterjee
সুজিত চট্টোপাধ্যায়
author img

By

Published : Sep 4, 2020, 7:10 PM IST

আউশগ্রাম, 5 সেপ্টেম্বর : আগে ছিল বছরে 1 টাকা, এখন বেড়ে হয়েছে 2 টাকা ৷ মাত্র 2 টাকার বিনিময়ে ছেলে-মেয়েদের পড়ান মাস্টারমশাই সুজিত চট্টোপাধ্যায় ৷ পূর্ব বর্ধমানের রামনগর গ্রামের সদাই ফকিরের পাঠশালা ৷ একডাকে চেনে সবাই ৷ বিগত 16 বছর ধরে পড়াচ্ছেন আদিবাসী অধ্যুষিত আউশগ্রামের প্রত্যন্ত জঙ্গল এলাকার ছেলে-মেয়েদের ৷

আউশগ্রামের জঙ্গল থেকে প্রায় 20 কিলোমিটার দূরে মোড়বাঁধ এলাকা । সেখান থেকে আরও তিন কিলোমিটার গেলে রামনগর গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকা । সেখানে যে কাউকে জিজ্ঞাসা করলেই দেখিয়ে দেবে সদাই ফকিরের পাঠশালা । হলদে রংচটা পাঁচিল ৷ নীল গেট ৷ গেটের পাশে লেখা, "লিখে রেখো একফোঁটা দিলেম শিশির", সদাই ফকির ৷ ভিতরে ঢুকলেই চোখে পড়বে খোলা বারান্দা ৷ মাথায় টিনের চাল ৷ বারান্দার একপাশে পুরানো কাঠের চেয়ারে বসে ছেলে-মেয়েদের পড়াচ্ছেন বছর 77-এর সুজিতবাবু ৷ কিন্তু নিজের নাম হঠাৎ সদাই ফকির রাখেলেন কেন? উত্তরে হাসিমুখে সুজিতবাবু বলেন, "2004 সালে অবসর নেওয়ার পর থেকে আমি পড়াচ্ছি ৷ তখন যারা আমার কাছে পড়ত, তারা বলত স্যার আপনার অনেক টাকা ৷ আমি বলতাম, আমার টাকা-পয়সা নেই ৷ কিন্তু, ওরা আমার কথা কিছুতেই বিশ্বাস করত না ৷ শেষমেশ ওদের বিশ্বাস করানোর জন্য সদাই ফকির নামটা নিয়েছি ৷ " 2004 সালের আগে রামনগর হাইস্কুলে শিক্ষকতা করতেন সুজিতবাবু ৷

এলাকাবাসীর বেহাল আর্থিক অবস্থার কথা খুব ভালো করেই জানতেন সুজিতবাবু ৷ কারণ তিনবার গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধানের পদ সামলেছেন তিনি ৷ সুজিতবাবু বলেন, "এখানে মানুষের আর্থিক অবস্থা খুব খারাপ ৷ প্রায় 22-25 কিলোমিটার দূর থেকে ছেলে-মেয়েরা আসে ৷ জঙ্গলের ভিতরে ভিতরে গ্রাম ৷ সেখান থেকে সাইকেল নিয়ে ওরা পড়তে আসে ৷ টিউশন অনেকেরই নেই ৷ সেইজন্য আমার কাছে ওরা আসে ৷ আমি তিনটি টার্ম গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান ছিলাম ৷ তাই সবটাই আমি জানি ৷ আমি ওদের বলি, আমার কাছে পড়তে হলে বছরে 1 টাকা গুরুদক্ষিণা দিতে হবে ৷ ওরাও শুনে খুব খুশি হয় ৷ সেই থেকেই শুরু ৷ " এখন বছরে 2 টাকার বিনিময়ে ছাত্র-ছাত্রীদের পড়ান সুজিতবাবু ৷ বলেন, "দু'-তিন বছর আগে 1 টাকা থেকে গুরুদক্ষিণা বাড়িয়ে করেছি বছরে 2 টাকা ৷ "

students of Sadai Fakir Pathsala
পাঠশালার ছাত্র-ছাত্রী

পাশাপাশি থ্যালাসেমিয়া রোগীদের চিকিৎসার জন্য অর্থ সাহায্যও করেন সুজিতবাবু ৷ নিজের পেনশনের টাকার একাংশ এই কাজে ব্যয় করেন ৷ সাধ্যমতো কখনও 10, 50 বা 100 টাকা দিয়ে তাঁকে এই কাজে সাহায্য করে ছাত্র ছাত্রীরাও । পাশাপাশি গ্রামের মানুষরাও সহযোগিতা করে ৷ শুরুটা হয়েছিল একজনকে দিয়ে ৷ এখন সব মিলিয়ে 8 জন থ্যালাসেমিয়া রোগীর চিকিৎসার জন্য তাদের পরিজনদের আর্থিক সাহায্য করেন ৷

sadia fakir pathsala
ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াচ্ছেন মাস্টারমশাই সুজিত চট্টোপাধ্যায়

সুজিতবাবু জানান, আট-দশ বছর আগে গ্রামেরই এক যুবতিকে বাচ্চা কোলে ভোরবেলা বাসস্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলেন ৷ জিজ্ঞাসা করে জানতে পেরেছিলেন, বাচ্চাটির থ্যালাসেমিয়া রয়েছে ৷ প্রতিমাসেই তাকে বর্ধমানে যেতে হয় রক্ত পালটানোর জন্য ৷ বলেন, "শুনে খুব খারাপ লেগেছিল ৷ ওই যুবতির আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ ছিল ৷ তার উপর বর্ধমান যাওয়া, সারাদিন ওখানে থাকা-খাওয়া, সব মিলিয়ে অনেক খরচ ৷ তাই কিছুটা সাহায্য করার জন্য আমার ছাত্র-ছাত্রীদেরও বলি ৷ তারাও 10 টাকা করে দেয় ৷ সব মিলিয়ে ওই যুবতির পরিবারের হাতে 5,000 টাকা তুলে দিই ৷ এখন প্রায় 7 থেকে 8 জন থ্যালাসেমিয়া রোগীর পরিবারকে অর্থসাহায্য করা হয় ৷ এলাকার অনেকে সাহায্য করে ৷ "

মাস্টারমশাই খুব ভালো পড়ান ৷ প্রয়োজনে সাহায্যও করেন বলে জানায় ছাত্র-ছাত্রীরা ৷ সুজিতবাবুর ছাত্রী সালেহা খাতুন ৷ ক্লাস টুয়েলভে পড়ে ৷ বলে, "স্যার খুব ভালো পড়ান ৷ এই বয়সে উনি যেভাবে পড়ান, কমবয়সি স্যাররাও সেভাবে পড়ান না ৷ বেতন নেন না ৷ বছরে মাত্র 2 টাকা গুরুদক্ষিণা নেন ৷ কোনও চাপও দেন না ৷ বিপদে সাহায্য করেন ৷ "

সদাই ফকিরের পাঠশালা, গুরুদক্ষিণা বছরে মাত্র 2 টাকা

সুজিতবাবুর আরও এক ছাত্রী হাফিজ়া খাতুন বলে, "স্যার খুব ভালো পড়ান শুনেছিলাম ৷ প্রায় 25 কিলোমিটার দূর থেকে আসি ৷ আগে বাসে আসতাম ৷ এখন সাইকেল নিয়ে আসি ৷ অন্য স্যাররা এতটা সময় দেন না, যতটা উনি দেন ৷ " ক্লাস টুয়েলভের আরও এক ছাত্রী সোনামণি কিস্কু বলে, "বাড়িতে বাবা, মা, ভাই আছেন । বাবা মাঠে কাজ করেন । আর্থিক অবস্থা খারাপ । মাইনে দেওয়ার ক্ষমতা নেই ৷ তাই স্যারের কাছে এসেছি । স্যার খুব ভালো পড়ান এবং আমাদের প্রয়োজনে আর্থিক সাহায্যও করে থাকেন ।"

আউশগ্রাম, 5 সেপ্টেম্বর : আগে ছিল বছরে 1 টাকা, এখন বেড়ে হয়েছে 2 টাকা ৷ মাত্র 2 টাকার বিনিময়ে ছেলে-মেয়েদের পড়ান মাস্টারমশাই সুজিত চট্টোপাধ্যায় ৷ পূর্ব বর্ধমানের রামনগর গ্রামের সদাই ফকিরের পাঠশালা ৷ একডাকে চেনে সবাই ৷ বিগত 16 বছর ধরে পড়াচ্ছেন আদিবাসী অধ্যুষিত আউশগ্রামের প্রত্যন্ত জঙ্গল এলাকার ছেলে-মেয়েদের ৷

আউশগ্রামের জঙ্গল থেকে প্রায় 20 কিলোমিটার দূরে মোড়বাঁধ এলাকা । সেখান থেকে আরও তিন কিলোমিটার গেলে রামনগর গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকা । সেখানে যে কাউকে জিজ্ঞাসা করলেই দেখিয়ে দেবে সদাই ফকিরের পাঠশালা । হলদে রংচটা পাঁচিল ৷ নীল গেট ৷ গেটের পাশে লেখা, "লিখে রেখো একফোঁটা দিলেম শিশির", সদাই ফকির ৷ ভিতরে ঢুকলেই চোখে পড়বে খোলা বারান্দা ৷ মাথায় টিনের চাল ৷ বারান্দার একপাশে পুরানো কাঠের চেয়ারে বসে ছেলে-মেয়েদের পড়াচ্ছেন বছর 77-এর সুজিতবাবু ৷ কিন্তু নিজের নাম হঠাৎ সদাই ফকির রাখেলেন কেন? উত্তরে হাসিমুখে সুজিতবাবু বলেন, "2004 সালে অবসর নেওয়ার পর থেকে আমি পড়াচ্ছি ৷ তখন যারা আমার কাছে পড়ত, তারা বলত স্যার আপনার অনেক টাকা ৷ আমি বলতাম, আমার টাকা-পয়সা নেই ৷ কিন্তু, ওরা আমার কথা কিছুতেই বিশ্বাস করত না ৷ শেষমেশ ওদের বিশ্বাস করানোর জন্য সদাই ফকির নামটা নিয়েছি ৷ " 2004 সালের আগে রামনগর হাইস্কুলে শিক্ষকতা করতেন সুজিতবাবু ৷

এলাকাবাসীর বেহাল আর্থিক অবস্থার কথা খুব ভালো করেই জানতেন সুজিতবাবু ৷ কারণ তিনবার গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধানের পদ সামলেছেন তিনি ৷ সুজিতবাবু বলেন, "এখানে মানুষের আর্থিক অবস্থা খুব খারাপ ৷ প্রায় 22-25 কিলোমিটার দূর থেকে ছেলে-মেয়েরা আসে ৷ জঙ্গলের ভিতরে ভিতরে গ্রাম ৷ সেখান থেকে সাইকেল নিয়ে ওরা পড়তে আসে ৷ টিউশন অনেকেরই নেই ৷ সেইজন্য আমার কাছে ওরা আসে ৷ আমি তিনটি টার্ম গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান ছিলাম ৷ তাই সবটাই আমি জানি ৷ আমি ওদের বলি, আমার কাছে পড়তে হলে বছরে 1 টাকা গুরুদক্ষিণা দিতে হবে ৷ ওরাও শুনে খুব খুশি হয় ৷ সেই থেকেই শুরু ৷ " এখন বছরে 2 টাকার বিনিময়ে ছাত্র-ছাত্রীদের পড়ান সুজিতবাবু ৷ বলেন, "দু'-তিন বছর আগে 1 টাকা থেকে গুরুদক্ষিণা বাড়িয়ে করেছি বছরে 2 টাকা ৷ "

students of Sadai Fakir Pathsala
পাঠশালার ছাত্র-ছাত্রী

পাশাপাশি থ্যালাসেমিয়া রোগীদের চিকিৎসার জন্য অর্থ সাহায্যও করেন সুজিতবাবু ৷ নিজের পেনশনের টাকার একাংশ এই কাজে ব্যয় করেন ৷ সাধ্যমতো কখনও 10, 50 বা 100 টাকা দিয়ে তাঁকে এই কাজে সাহায্য করে ছাত্র ছাত্রীরাও । পাশাপাশি গ্রামের মানুষরাও সহযোগিতা করে ৷ শুরুটা হয়েছিল একজনকে দিয়ে ৷ এখন সব মিলিয়ে 8 জন থ্যালাসেমিয়া রোগীর চিকিৎসার জন্য তাদের পরিজনদের আর্থিক সাহায্য করেন ৷

sadia fakir pathsala
ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াচ্ছেন মাস্টারমশাই সুজিত চট্টোপাধ্যায়

সুজিতবাবু জানান, আট-দশ বছর আগে গ্রামেরই এক যুবতিকে বাচ্চা কোলে ভোরবেলা বাসস্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলেন ৷ জিজ্ঞাসা করে জানতে পেরেছিলেন, বাচ্চাটির থ্যালাসেমিয়া রয়েছে ৷ প্রতিমাসেই তাকে বর্ধমানে যেতে হয় রক্ত পালটানোর জন্য ৷ বলেন, "শুনে খুব খারাপ লেগেছিল ৷ ওই যুবতির আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ ছিল ৷ তার উপর বর্ধমান যাওয়া, সারাদিন ওখানে থাকা-খাওয়া, সব মিলিয়ে অনেক খরচ ৷ তাই কিছুটা সাহায্য করার জন্য আমার ছাত্র-ছাত্রীদেরও বলি ৷ তারাও 10 টাকা করে দেয় ৷ সব মিলিয়ে ওই যুবতির পরিবারের হাতে 5,000 টাকা তুলে দিই ৷ এখন প্রায় 7 থেকে 8 জন থ্যালাসেমিয়া রোগীর পরিবারকে অর্থসাহায্য করা হয় ৷ এলাকার অনেকে সাহায্য করে ৷ "

মাস্টারমশাই খুব ভালো পড়ান ৷ প্রয়োজনে সাহায্যও করেন বলে জানায় ছাত্র-ছাত্রীরা ৷ সুজিতবাবুর ছাত্রী সালেহা খাতুন ৷ ক্লাস টুয়েলভে পড়ে ৷ বলে, "স্যার খুব ভালো পড়ান ৷ এই বয়সে উনি যেভাবে পড়ান, কমবয়সি স্যাররাও সেভাবে পড়ান না ৷ বেতন নেন না ৷ বছরে মাত্র 2 টাকা গুরুদক্ষিণা নেন ৷ কোনও চাপও দেন না ৷ বিপদে সাহায্য করেন ৷ "

সদাই ফকিরের পাঠশালা, গুরুদক্ষিণা বছরে মাত্র 2 টাকা

সুজিতবাবুর আরও এক ছাত্রী হাফিজ়া খাতুন বলে, "স্যার খুব ভালো পড়ান শুনেছিলাম ৷ প্রায় 25 কিলোমিটার দূর থেকে আসি ৷ আগে বাসে আসতাম ৷ এখন সাইকেল নিয়ে আসি ৷ অন্য স্যাররা এতটা সময় দেন না, যতটা উনি দেন ৷ " ক্লাস টুয়েলভের আরও এক ছাত্রী সোনামণি কিস্কু বলে, "বাড়িতে বাবা, মা, ভাই আছেন । বাবা মাঠে কাজ করেন । আর্থিক অবস্থা খারাপ । মাইনে দেওয়ার ক্ষমতা নেই ৷ তাই স্যারের কাছে এসেছি । স্যার খুব ভালো পড়ান এবং আমাদের প্রয়োজনে আর্থিক সাহায্যও করে থাকেন ।"

ETV Bharat Logo

Copyright © 2024 Ushodaya Enterprises Pvt. Ltd., All Rights Reserved.