আসানসোল, 4 সেপ্টেম্বর : কুষ্ঠ পরিবারের শিশুদের শিক্ষার আলোয় ফেরাতে এক দীর্ঘ পথচলা নিরঞ্জন সর্দারের । কাঁকরডাঙা কুষ্ঠপল্লিতে গেলে দেখা যায় তাঁর ছোট্ট পাঠশালা । যে পাঠশালা স্বপ্ন দেখতে শেখায়, বাঁচতে শেখায় ।
আটের দশকের বেশ কিছুটা আগের সময় । সেই সময় থেকেই পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলা থেকে কুষ্ঠ আক্রান্ত মানুষ আসতে শুরু করেন । যাঁরা ব্রাত্য, উপেক্ষিত । বার্নপুর স্টেশনের পাশে গড়ে ওঠে কুষ্ঠপল্লি । সমাজ থেকে তাঁরা কার্যত বিচ্ছিন্ন ছিলেন । ভিক্ষে করে দিনযাপন হত । শিশুদের স্কুলে গিয়ে লেখাপড়া করার কোনও অধিকার ছিল না ।
বার বার আন্দোলনের পর 1980 সালে কাঁকরডাঙা অঞ্চলে পুনর্বাসন পায় কুষ্ঠ আক্রান্ত পরিবারগুলি । কিন্তু সমাজ তাঁদের প্রান্তিক করেছে । কুষ্ঠ পরিবারের শিশুরা তাই স্কুলে যেতে পারত না । কেন ? কারণ তথাকথিত শিক্ষিত পড়ুয়াদের অভিভাবকরাই আপত্তি করতেন । উপেক্ষা মেনে নেননি নিরঞ্জন । শুরু হয় নিরঞ্জন সর্দারের পাঠশালা । কুষ্ঠ পরিবারের শিশুদের নিয়ে নিজেদের উদ্যোগে তিনি গড়ে তোলেন একটি অবৈতনিক পাঠশালা । শিশুদের জীবনে পৌঁছে দেন শিক্ষার আলো । বাড়তে থাকে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা । পড়ানোর নেশায় মশগুল হয়ে ওঠেন নিরঞ্জন মাস্টার ।
দিন বদল হয় । তবু নিরঞ্জনের স্কুল চলতে থাকে । 20 বছরে মানুষ অনেকটাই সচেতন হন । কুষ্ঠ রোগীদের এড়িয়ে চলা বন্ধ করেন । কুষ্ঠ আক্রান্ত পরিবারের শিশুরা অন্যান্যদের সঙ্গে স্কুলে যাওয়ার অধিকার পায় । ছাত্র-ছাত্রীরা অনেকে ভরতি হন কলেজও । তবে নিরঞ্জন সরদারের পাঠশালা একদিনের জন্য বন্ধ হয়নি । স্কুলে যাওয়ার পাশাপাশি নিরঞ্জন মাস্টারের কাছেও ছাত্র-ছাত্রীরা পড়তে আসত । বর্তমানে 26 জন ছাত্র-ছাত্রী পড়ে এই পাঠশালায় ।
কিন্তু এসবের মধ্যেই আসে প্যানডেমিক... লকডাউন । বন্ধ হয়ে যায় স্কুল । এই এলাকার বাসিন্দারা আর্থিকভাবে অনেকটাই পিছিয়ে । বেশিরভাগ মানুষই দিনমজুর । অনেক মহিলা পরিচারিকার কাজ করেন । যাঁরা সম্পূর্ণভাবে বিশেষভাবে সক্ষম তাঁরা ভিক্ষা করেন । সেই পরিবারগুলি ভাবতেই পারে না স্মার্টফোন বা ডিজিটাল ক্লাসের কথা ।
দীর্ঘ সাড়ে তিন মাস স্কুল বন্ধ । পাশের গ্রামগুলির বাচ্চাদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়েছে । কিন্তু বন্ধ হয়নি কুষ্ঠপল্লির শিশুদের পঠন-পাঠন । নিরঞ্জনের পাঠশালা চলছে । লকডাউনে অল্প কয়েকজন পড়ুয়াকে নিয়ে পড়াশোনা করাতেন । আনলক শুরু হতেই পুরো দমে পড়াশোনা শুরু । সকাল থেকেই বেরিয়ে যান পাড়ায় । বাচ্চাদের ডেকে নিয়ে আসেন স্কুলে । প্রথমে চলে পড়াশোনা । তারপর স্কুলের ছোট্ট এক চিলতে মাঠে খেলাধূলা হয় । এই সময় শিশুদের কোরোনা নিয়ে সচেতন করতে গানও বেঁধেছেন তিনি । প্রার্থনার সময়ে শিশুরা এই গান গায় ।
নিরঞ্জন সর্দার নিজেও কুষ্ঠ রোগী । ভালো করে হাঁটতে পারেন না । স্কুল চালানোর জন্য পৌরনিগম থেকে সাম্মানিক পান । কিন্তু তা অনেকটাই অল্প । তা দিয়ে তাঁর সংসার চলে না । তাই স্কুলের পড়ানোর পরে ছোট্ট একটি মুদিখানা দোকান চালান তিনি । কুষ্ঠপল্লির গরিব বাসিন্দারা তাঁর কাছেই নিত্যনৈমিত্তিক জিনিসপত্র কেনেন । সেই রোজগারেই চলে নিরঞ্জন মাস্টারের সংসার । তার থেকে টাকা বাঁচিয়ে স্কুলের বাচ্চাদের জন্য বইখাতা, খেলার সরঞ্জাম আরও কত কী কিনে দেন নিরঞ্জন । তাঁর মতো শিক্ষক থাকলে শিক্ষার আলো ঘরে ঘরে পৌঁছাবেই, বিশ্বাস এই শিক্ষক দিবসে ...