বহরমপুর, 27 সেপ্টেম্বর : রাজশাহী থেকে রাজপাট গুটিয়ে ভাগীরথীর তীরে মুর্শিদাবাদের বড়নগরে দ্বিতীয় বারাণসী গড়তে চেয়েছিলেন নাটোরের রানি ভবানী । 1755 সাল থেকে একের পর এক মন্দির নির্মাণ করেছেন ভাগীরথীর তীরে । বঙ্গেশ্বর মন্দির, ভুবনেশ্বর মন্দির, চার বাংলা মন্দির, জোড়া বাংলা মন্দির, রাজরাজেশ্বরী মন্দির, তারকেশ্বর শিব মন্দির । এমন প্রায় 108 টি মন্দির নির্মাণ করেছিলেন তিনি । অধিকাংশ মন্দির পোড়ামাটির অলঙ্করণে তৈরি । টেরাকোটার অসাধারণ শিল্প আর ভাস্কর্য যে কাউকেই মুগ্ধ করবে ।
বড়নগরের এই অংশে বারাণসীর মতো গঙ্গা কিছুটা উত্তর বাহিনী । তাই এই নদীর পারকে বেছে নিয়েছিলেন নাটোরের রানি ভবানী । কিন্তু বেশ কয়েকটি কারণে তাঁর সব স্বপ্ন পূরণ হয়নি । ঐতিহাসিকদের মতে, তার মধ্যে অন্যতম কারণ ছিল রানি ভবানীর বাল্যবিধবা মেয়ে তারাসুন্দরীর উপর নবাব সিরাজদৌলার কুদৃষ্টি । সিরাজের ছত্রছায়া থেকে মেয়েকে রক্ষা করতে তাঁকে গোপনে রেখে আসেন কাশীতে । এরপর ফিরে এসে মন্দির নির্মাণ শুরু করলেও আর মন বসাতে পারেননি নাটোরের রানি ।
কালের নিয়মে বহু মন্দির গঙ্গা গর্ভে বিলীন হয়ে গিয়েছে । বহু মন্দির অবহেলা এবং সংরক্ষণের অভাবে নষ্ট হয়ে গিয়েছে । গঙ্গেশ্বর জোড়া বাংলা মন্দির রাজ্য পুরাতত্ত্ব বিভাগ সংরক্ষণ করেছে । আর চার বাংলা মন্দির রয়েছে আর্কিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার অধীনে । কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে মন্দির থেকে খসে খসে পড়ছে টেরাকোটার কাজ । চুরি হয়ে যাচ্ছে পোড়ামাটির বহু নিদর্শন । বডনগরকে ঘিরে যে বড় পর্যটন কেন্দ্র গড়ে ওঠার সম্ভাবনা ছিল সে সম্ভাবনাও আজ অতীত হয়ে গিয়েছে । স্থানীয় মানুষের দাবি শিল্পকলায় পূর্ণ বড়নগরকে ঘিরে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে উঠলে রানি ভবানীর স্মৃতিবিজড়িত স্থান বাংলা তথা দেশ বিদেশের মানুষকে আকৃষ্ট করবে । এলাকা আর্থিকভাবে অনেক সচ্ছল হয়ে উঠবে ।
ইতিহাস বলছে, রানি ভবানীর দুই পুত্র সন্তানের একজন 11 বছর বয়সে এবং একজন দু'বছর বয়সে মারা যায় । একমাত্র কন্যা তারাসুন্দরীর বিয়ে হয়েছিল রাজশাহির খেজুরিয়াতে । তিনিও বিধবা হন মাত্র 12 বছর বয়সে । সনাতন ধর্মের পণ্ডিতরা বিধবা বিয়েতে আপত্তি জানান । রানি ভবানী মেয়েকে ধর্ম, পূজা পাঠের মধ্যেই মগ্ন করে রাখতে চেয়েছিলেন । সেই লক্ষ্যেই বড়নগরে মন্দির প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা । তিনি চেয়েছিলেন বডনগরে গড়ে উঠুক দ্বিতীয় বারাণসী । একসময় বডনগরকে বঙ্গের বারাণসীও বলা হত । আজ তার ঐতিহ্য হারাতে বসেছে । নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে অনেক ইতিহাস । নদী গ্রাসে চার বাংলা মন্দির অস্তিত্ব সংকটে পড়ে ছিল । স্থানীয় মানুষের জোরালো দাবিতে পাথর দিয়ে বাঁধানো হলেও অপূর্ব কারুকার্যখচিত চার বাংলা মন্দির অযত্নে পড়ে রয়েছে ভাগীরথীর কিনারে ।
স্বপ্ন পূরণ হয়নি রানির । আশা পূরণ হয়নি স্থানীয় মানুষ এবং মুর্শিদাবাদবাসীর । দু'বাংলা মন্দির সচরাচর দেখা যায় । কিন্তু চার বাংলা মন্দির বাংলায় একমাত্র রানি ভবানীর তৈরি বড়নগরে । 1750 খ্রিস্টাব্দে তিনি এখানে বসবাস শুরু করে মন্দির নির্মাণে হাত লাগান । গঙ্গেশ্বর মন্দিরটি উলটানো পদ্মর মতো দেখতে , একটি গম্বুজের আকৃতি বিশিষ্ট । চার বাংলা মন্দির টেরাকোটার কারুকার্য আর অপূর্ব চুনাবালির অলঙ্করণে নির্মিত । একটি উঠান ঘিরে একই আদলে তৈরি করা হয়েছে চারটি মন্দির । প্রত্যেক মন্দিরে রয়েছে তিনটি করে খিলান দেওয়া দরজা । দরজার পিছনে রয়েছে এক একটি শিবলিঙ্গ । বড়নগর গঙ্গাতীরে আঠারো শতকের দ্বিতীয়ার্ধে মোট 108 মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন রানি । এছাড়া মুর্শিদাবাদের একমাত্র সতীপীঠ কিরীটেশ্বরী , তারাপীঠ মন্দির রানি ভবানীর নির্মিত ।
সবকিছুই চলছিল আপন গতিতে। বড়নগরে দ্বিতীয় বারাণসী গড়ার প্রথম ধাক্কা এল নবাব সিরাজদৌলার কাছ থেকে । 1756 সালের 15 এপ্রিল বাংলার মসনদে বসেন সিরাজ। ইতিহাস বলছে, একদিন ভাগীরথীতে নৌবিহারের সময় পিছন থেকে তারাসুন্দরীকে ছাদে চুল শুকাতে দেখেন সিরাজ । তখনই তার উপর কুনজর পড়ে। মাঝ গঙ্গায় দু'দিনে একটানা নোঙ্গর ফেলে রানি ভবানীর রাজ বাড়ির দিকে চেয়েছিলেন সিরাজ । পরে বহু নৌকা ও দুর্বৃত্তদের পাঠিয়েছিলেন তারাসুন্দরীকে তুলে আনার জন্য । সিরাজের সে কুচক্র কাজে লাগেনি । জগৎশেঠের সঙ্গে শলা পরামর্শ করে রানি ভবানী মেয়েকে কাশীতে রেখে আসেন জগৎশেঠের আস্তানায় । বারাণসী গড়ার পরিকল্পনা ধীরে ধীরে মুছে যায় রানি ভবানীর মন থেকে । কিন্তু যে ভাস্কর্য, যে কারুকার্য তিনি রেখে গিয়েছেন আজ তাও অস্তিত্ব সংকটে । চার বাংলা মন্দির সংলগ্ন রানি ভবানীর কাছারিবাড়ি ভেঙে ভেঙে পড়ছে । কয়েকটি মন্দির আজও টিকে রয়েছে । কিন্তু এলাকার মানুষের পর্যটনকেন্দ্র গড়ে ওঠার স্বপ্নপূরণ আজও হয়নি । প্রতিবছর কয়েক হাজার বিদেশি পর্যটকের পা পড়ে বড়নগরে । কিন্তু ভিড় জমে না দেশীয় পর্যটকদের। গ্রামবাসীদের আক্ষেপ, বড়নগরকে ঘিরে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে উঠলে এই এলাকা আর্থিকভাবে আরও সচ্ছল হয়ে উঠত ।