মালদা, 5 জুন : মালদা জেলার পরিচয় আমের জন্য ৷ এই জেলার প্রধান অর্থকরী ফসল আম ৷ জেলার প্রায় 32 হাজার হেক্টর জমি নিয়ে গড়ে উঠেছে এই জেলার অর্থনীতির মূল ভিত্তি ৷ এই ফসলকে ঘিরে গড়ে উঠেছে কিছু অনুসারী শিল্পও ৷ তার মধ্যে অন্যতম গাছ থেকে আম পেড়ে তা বাজারজাত করার জন্য বাঁশের ঝুড়ি তৈরি করা ৷ এই কাজের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে গোটা জেলার অন্তত দেড় হাজার পরিবার ৷ কিন্তু এবার প্রকৃতির রোষ এবং কোরোনার দাপট প্রভাব ফেলেছে এই শিল্পে ৷ এখনও উৎপাদিত সব ঝুড়ি বিক্রি করতে পারেননি শিল্পীরা ৷ বরাতও এবার তেমন জোটেনি ৷ এই শিল্পীদের বেশিরভাগই ঋণ নিয়ে এই কাজ করেন ৷ বর্তমান পরিস্থিতি চিন্তায় ফেলেছে তাঁদের ৷ এমন অবস্থা চলতে থাকলে ঋণ কীভাবে শোধ করবেন, ভেবে পাচ্ছেন না কেউ ৷ অনিশ্চিত ভবিষ্যতকে সঙ্গী করেই কাজ করে যাচ্ছেন তাঁরা ৷
মালদা জেলায় আমচাষকে কেন্দ্র করে একাধিক অনুসারী শিল্প গড়ে উঠেছে ৷ তার মধ্যে অন্যতম বাঁশের ঝুড়ি তৈরি ৷ এই জেলার আম রাজ্যের অন্য জেলাগুলির সঙ্গে একাধিক রাজ্যেও রপ্তানি হয় ৷ অন্য বছরগুলিতে মে মাসের মাঝামাঝি সময় থেকেই জলদি প্রজাতির আমগুলি পরিপক্ক হতে শুরু করে ৷ সেই আম জেলার সঙ্গে বাইরেও বাজারজাত করা হয় ৷ আম বাজারজাত করার জন্য প্রয়োজন বাঁশের ঝুড়ি ৷ তাই প্রতি বছর ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাস থেকেই বাঁশের শিল্পীরা কাজে নেমে পড়ে ৷ এবারও শুরুটা হয়েছিল অন্য বছরগুলির মতো ৷ কিন্তু সময় যত গড়িয়েছে, ততই কপালে চিন্তার ভাঁজ বেড়েছে এই শিল্পীদের ৷ এবার মরশুমের শুরু থেকেই আবহাওয়া বিরূপ ৷ তার প্রভাব পড়েছিল মুকুলে ৷ প্রথমে দীর্ঘকালীন শীতের জন্য আমের মুকুল আসতে দেরি হয় ৷ পরে অবশ্য অধিকাংশ বাগানেই ঝেঁপে মুকুল আসে ৷ জেলার প্রায় 32 হাজার হেক্টর জমিতে আমের ভালো উৎপাদনের আশা করেছিল উদ্যানপালন ও খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ দপ্তর ৷ আশা ছিল, এবার গোটা জেলায় এবার তিন লক্ষ মেট্রিক টন আম উৎপাদন হবে ৷ কিন্তু একের পর এক ঝড়, তার সঙ্গে অতিরিক্ত বৃষ্টি চাষের বারোটা বাজিয়ে দেয় ৷ বিশেষত উত্তর মালদার বিস্তীর্ণ এলাকায় ঝর-বৃষ্টি আমচাষে মারাত্মক প্রভাব ফেলে৷ এই পরিস্থিতিতে বর্তমানে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের বক্তব্য, তিন লক্ষ অনেক দূরের কথা, দুই লক্ষ মেট্রিক টন ফলন হলেই এবার যথেষ্ট ৷ আর এতেই সিঁদুরে মেঘ দেখছে বাঁশের ঝুড়ি তৈরিতে যুক্ত হাজার দেড়েক পরিবার ৷
মানিকচক ব্লকের শেখপুরা গ্রামে বসবাস করেন কয়েকশো বাঁশের সামগ্রী তৈরির শিল্পী ৷ তাঁদেরই একজন শেখ নজরুল ৷ তিনি বলেন,‘‘এবার আমাদের চরম ক্ষতির মুখে পড়তে হবে ৷ পরপর ঝড় আর বৃষ্টিতে আম প্রায় শেষ ৷ ব্যবসায় অনেক টাকা বিনিয়োগ করে ফেলেছি ৷ লকডাউনে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠেছে ৷ জুন মাস শুরু হয়ে গেল ৷ অথচ এখনও বাইরে আম যাচ্ছে না ৷ প্রতি বছর আমাদের ঝুড়ির চাহিদা বেশ ভালো থাকে ৷ মরশুম শুরু হতে না হতেই আম ব্যবসায়ীরা ঝুড়ির বরাত দিয়ে যায় ৷ কিন্তু এবার চাহিদাই নেই ৷ গতবার আমারই 10 হাজার ঝুড়ি বিক্রি হয়েছিল ৷ এবার দুই হাজার ঝুড়িও বিক্রি করতে পারিনি ৷ বাড়িতে ঝুড়ির পাহাড় জমেছে৷ এমাসের মধ্যে মাল বিক্রি না হলে আমাদের না খেয়ে মরতে হবে ৷ একটি ঝুড়ি তৈরি করতে অন্তত 15 টাকার বাঁশ লাগে ৷ তার সঙ্গে আমাদের শ্রমের মজুরি রয়েছে ৷ রক্ষণাবেক্ষণের খরচ আলাদা ৷ প্রতিটি ঝুড়ি তৈরি করতে অন্তত 30 মিনিট সময় লাগে ৷ গতবার একেকটি ঝুড়ি বিক্রি করেছিলাম 42 টাকায় ৷ এবার পরিস্থিতি দেখে আমরাই ঝুড়ির দাম কমিয়ে দিয়েছি ৷ প্রতিটি ঝুড়ি 30 টাকা দরে বিক্রি করছি ৷ গত 30 বছর ধরে এই কাজ করছি৷ কখনও এমন অবস্থার মুখোমুখি হইনি ৷ এখন আমার সঙ্গে ছেলেও এই কাজ করে ৷ পাঁচ মাস ধরে এই কাজ চলে ৷ এর উপর নির্ভর করে গোটা বছর সংসার চলে ৷ এবার কী হবে জানি না ৷”
শেখপুরা গ্রামের আরেক ঝুড়ি শিল্পী রাইহান শেখ বলেন, “প্রতি বছর গোটা জেলায় প্রায় পাঁচ কোটি টাকার এই ব্যবসা হয় ৷ এবার প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর লকডাউনে গাছ পরিচর্যার আমের ফলন ভীষণ কমে গিয়েছে ৷ যা পরিস্থিতি, তাতে এবার আমাদের এই ব্যবসা গোটা জেলায় দুই কোটি টাকারও হবে না ৷ দু’একদিন ধরে গাড়ি চলতে শুরু করেছে ৷ কিন্তু এখনও যদি আমাদের মাল বাইরে যেতে শুরু করে তবুও ব্যবসা আর আগের জায়গায় ফিরে যাবে না ৷ কারণ, সময় প্রায় শেষ ৷ যত মাল বানিয়েছি তার অধিকাংশই অবিক্রিত থেকে গিয়েছে ৷ গতবার আমরাও পরিবারের তিনজন মিলে 10 হাজার ঝুড়ি বিক্রি করেছিলাম ৷ এবার এখনও কিছুই হয়নি ৷ এমন চললে আমাদের বেঁচে থাকাই সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে ৷ আমাদের কাছে পুঁজিও বিশেষ নেই ৷ এই পরিস্থিতিতে আমরা সরকারের কাছে আর্থিক সাহায্যের আবেদন জানাচ্ছি ৷”
এই শিল্পীদের মূল সমস্যা আরও গভীরে ৷ এদের বেশিরভাগই ব্যাংক কিংবা মহাজনের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে ব্যবসা করে ৷ সেকথাই শোনা গেল এক শিল্পীর বিবির মুখে ৷ শিলা বিবি নামে ওই বধূ বলেন, “এবার বন্ধন ব্যাংক থেকে এক লাখ 40 হাজার টাকা ঋণ নিয়ে কাজ শুরু করেছিলাম ৷ লকডাউনের জন্য মাল বিক্রি প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছে ৷ ভেবেছিলাম, লকডাউন মিটে গেলে মাল বেরোতে শুরু করবে ৷ তখন ব্যাংকের ঋণ শোধ করব ৷ কিন্তু লকডাউন শিথিল হলেও মাল বেরোচ্ছে না ৷ এখন ঘরে দেড় লাখ টাকার বেশি মাল পড়ে রয়েছে ৷ এদিকে ব্যাংকের লোকজন বাড়ি এসে জানিয়ে যাচ্ছে, ঋণ তাড়াতাড়ি শোধ করতে হবে ৷ এই অবস্থায় কীভাবে ঋণের টাকা শোধ করব? ব্যাংক কর্তৃপক্ষ আমাদের কোনও কথাই শুনতে রাজি নয় ৷”
ধীরে ধীরে তুলে নেওয়া হচ্ছে লকডাউন ৷ এখন গোটা দেশে আনলক 1 ৷ কিন্তু সরকারের এই সিদ্ধান্তে মালদা জেলার বাঁশের ঝুড়ি নির্মাতাদের ব্যবসা আনলক হবে কিনা এখনও জানা যাচ্ছে না ৷ চলতি মরশুমে এই ব্যবসার ভবিষ্যৎ কী হবে, তা সময়ই বলবে ৷