মালদা, 15 অক্টোবর : রাত প্রায় সাড়ে 11টায় অষ্টমী তিথির শেষ 24 মিনিট আর মহানবমীর প্রথম 24 মিনিটের সন্ধিপুজোয় চামুণ্ডারূপে পূজিতা হয়েছেন মহামায়া । শ্রীশ্রী চণ্ডী গ্রন্থ অনুযায়ী, এই সময় রুদ্ররূপ ধারণ করে মহিষাসুর ৷ তাঁর তিন যোদ্ধা চণ্ড, মুণ্ড এবং রক্তবীজকে হত্যা করেন দেবী দুর্গা । অকাল বোধনের পর মায়ের আশীর্বাদ নিয়ে ঠিক এই সময়েই রাবণ বধ করেছিলেন রামচন্দ্র । তাই হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী, মহানবমী হল আসুরিক শক্তি বধে বিজয়ের দিন । শাস্ত্র বলছে, শুক্লা নবমী তিথি 'উগ্রপ্রদা' অর্থাৎ এই তিথিতে জীবকূলের উত্তেজনা বাড়ে । আশ্বিন মাসের শুক্লা নবমী তিথিতে সেই উত্তেজনা কমাতে দুর্গার আরাধনার নিদান দিয়েছে শাস্ত্র । সেই বিধি মেনেই আজ বিশ্বব্যাপী পূজিতা হচ্ছেন মহামায়া ।
কিন্তু আজ শাস্ত্রীয় বক্তব্যের বিপরীত ছবি কালিয়াচক 3 নম্বর ব্লকের বীরনগর 1 নম্বর গ্রাম পঞ্চায়েতের সরকারটোলা গ্রামে । মহানবমী তিথিতে সেখানে কারও মনে কোনও উত্তেজনা নেই । রয়েছে আতঙ্ক । এ বছর বারবার সংবাদমাধ্যমে উঠে এসেছে এই গ্রামের ছবি । গঙ্গার আগ্রাসনে এবারও গ্রামের আয়তন অনেকটা সংকুচিত করে দিয়েছে । নদীর উপর ঝুলছে গ্রামের হাইস্কুলের একাংশ । সেই অংশ কখন নদীগর্ভে চলে যাবে, তা কেউ জানে না । 117 বছর আগে গ্রামের মাঝামাঝি জায়গায় স্থাপিত হয়েছিল দুর্গামন্দির । সেই সময় গঙ্গার দানে এই এলাকায় গরিব মানুষ ছিল না বললেই চলে । পলি ধোওয়া সোনার জমিতে সোনার ফসল । তাই প্রথম থেকে গ্রামে পাকা দুর্গামন্দির । দিন বদলের গান গেয়েছে গঙ্গাও । এখন সেই মন্দিরের দরজায় কার্যত ধাক্কা মারছে গঙ্গা । কখন যে সে মায়ের মন্দির নিজের গর্ভে টেনে নেবে, তার অপেক্ষায় প্রহর গুনছে গ্রামবাসী । আগামী বছর এই মন্দিরে দুর্গার আরাধনা করা যাবে কি না, তা নিয়ে রয়েছে আশঙ্কা রয়েই যাচ্ছে ।
আরও পড়ুন : Mamata Banerjee : শক্তিরূপেন সংস্থিতা ; মালদায় কন্যাশ্রী, যুবশ্রী সহযোগে দশভুজা মমতা
সরকারটোলা সর্বজনীন দুর্গোৎসব কমিটির সদস্য ভীম মণ্ডল জানাচ্ছেন, "2016 থেকে গঙ্গা গ্রাম কাটছে । এখন গ্রামের এক চতুর্থাংশ অংশই বেঁচে রয়েছে । আজ পুজো হচ্ছে । কিন্তু জানি না, এবারের পুজো সম্পূর্ণ করতে পারব কি না ৷ কারণ, যে কোনও মুহূর্তে নদী রুদ্ররূপ ধরতে পারে । এক ঘণ্টা পরেই নদী ফের পাড় কাটতে পারে । কিন্তু এই ভাঙন রোধ করার জন্য এখনও পর্যন্ত কোনও সরকারি উদ্যোগ দেখতে পাইনি আমরা । এই পুজোয় প্রায় 150 পরিবার অংশগ্রহণ করে । নিজেরা চাঁদা দিয়েই পুজো করি । কিন্তু আগামী বছর পুজো করতে পারব কি না, জানি না । এই পুজো 117 বছরে পা রাখল । নদী মন্দির টেনে নিলে পুজো যে আর হবে না, তা নিশ্চিত ।"
আরেক গ্রামবাসী উৎপল মণ্ডলের বক্তব্য, "এবারের ভাঙনে গ্রামের স্কুলটা প্রায় নদীতে চলে গিয়েছে । কিছু মানুষ এখনও ওই স্কুলে আশ্রয় নিয়ে রয়েছে । সবসময় মনে নদী ভাঙনের আতঙ্ক । তার মধ্যেও মায়ের পুজো করে যাচ্ছি । দুর্গাপুজো আমাদের কাছে আতঙ্কের উৎসব । গতকাল যখন সন্ধিপুজো চলছিল, তখনও নদী পাড় কেটেছে । পাশের পাড়ার 4-5 টি বাড়ি গঙ্গায় চলে গিয়েছে । পুজোয় ব্যস্ত থাকায় রাতে সেখানে যেতে পারিনি । সামনের বছর পুজো হবে কি না, তা নিশ্চিত নয় ।"
মহানবমী তিথিতে আপামর বাঙালির মন খারাপ । সবারই আর্তি, 'ওরে নবমী নিশি, না হইও রে অবসান' ৷ কিন্তু আর্তি যতই থাক, নিশির শেষ হবেই, সে যাবে । পতিগৃহে ফিরে যাবেন মা । বাঙালি অপেক্ষা করবে আরও একটি বছর । কারণ, সবাই জানে, দেবী শুধু মণ্ডপ ছেড়ে যাবেন । আনন্দের আলোকশিখা নিয়ে তিনি সবার মনে বিরাজ করবেন । সেই আলোকশিখা যেন সামনের বছর আবার গাঁয়ের মন্দিরে উদ্ভাসিত হয়, সেই আর্তিই জানাচ্ছে সরকারটোলা ।