মালদা, 21 ফেব্রুয়ারি: হাতে রাজ্য সরকারের স্বাস্থ্যসাথীর কার্ড ৷ তবুও অসুস্থ মেয়ের চিকিৎসা করাতে সরকারি হাসপাতাল ও নার্সিংহোমগুলির দুয়ারে দুয়ারে ঘুরছেন বাবা-মা ৷ সব জায়গা থেকেই খালি হাতে ফিরে আসতে হয়েছে বলে দাবি তাঁদের ৷ এই পরিস্থিতিতে তাঁরা দ্বারস্থ হয়েছেন বিডিওর ৷ ব্লক প্রশাসনিক প্রধানকে লিখিতভাবে জানিয়েছেন, স্বাস্থ্যসাথীর কার্ডে মেয়ের চিকিৎসা করাতে না পারলে আত্মহত্যা করা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই তাঁদের ৷ সংবাদমাধ্যমের মাধ্যমে বিষয়টি জানানোর চেষ্টা করেছেন খোদ মুখ্যমন্ত্রীকে ৷ এদিকে, ঘটনা জানার পরই প্রয়োজনীয় ব্য়বস্থা নেওয়ার কাজ শুরু করে দিয়েছেন বিডিও ৷ ঘটনাটি ঘটেছে মালদার হরিশ্চন্দ্রপুর-1 ব্লকের বারোডাঙা গ্রামে ৷ ভোটের মুখে এমন ঘটনায় বেকায়দায় তৃণমূল ৷ কটাক্ষ বিজেপির ৷
অসুস্থ ওই তরুণীর নাম পিংকি দাস ৷ বয়স 26 বছর ৷ তাঁর বপেরবাড়ি বারোডাঙা গ্রামে ৷ বিয়ে হয়েছিল স্থানীয় তুলসিহাটা গ্রাম পঞ্চায়েতের মীরজাতপুর গ্রামে ৷ স্বামী রঞ্জিত দাস পেশায় ভিনরাজ্যের শ্রমিক ৷ তাঁদের দুই ছেলে ৷ কিন্তু স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির সদস্যদের অত্যাচারে বছর পাঁচেক ধরেই দুই ছেলেকে নিয়ে বাপেরবাড়িতে রয়েছেন পিংকি ৷ বাবা দীপক দাস পেশায় ভ্যানচালক ৷ একমাত্র ভাই বিট্টুও শ্রমিকের কাজ করেন ৷ অভাবের সংসারে কোনওরকমে দিন চলে ৷
এক বছরেরও বেশি সময় ধরে অসুস্থ পিংকি ৷ সারা শরীরে অসহ্য ব্যথা ৷ বিছানা ছেড়ে উঠতে পারেন না ৷ সঙ্গে শ্বাসকষ্ট-সহ অন্যান্য উপসর্গও রয়েছে ৷ প্রথমে হরিশ্চন্দ্রপুর গ্রামীণ হাসপাতালে তাঁর চিকিৎসা হয় ৷ সেখান থেকে তাঁকে রেফার করা হয় চাঁচল সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে ৷ পরে আরও উন্নত চিকিৎসার জন্য সেখান থেকে তাঁকে মালদা মেডিকেলে পাঠানো হয় ৷ মেয়েকে সুস্থ করে তুলতে বাবা-মা পিংকিকে মালদা মেডিকেলে নিয়ে আসেন ৷ কিন্তু সেখানে চিকিৎসা করানোর পরও মেয়ে সুস্থ না হওয়ায় তাঁরা মালদা শহরের একাধিক নার্সিংহোমে যোগাযোগ করেন ৷ চিকিৎসার জন্য তাঁদের একমাত্র ভরসা ছিল রাজ্য সরকারের দেওয়া স্বাস্থ্যসাথী কার্ড ৷
দাস দম্পতির অভিযোগ, মালদার কোনও নার্সিংহোম স্বাস্থ্যসাথী কার্ডকে গুরুত্বই দিতে চায়নি৷ তাই মেয়ের উন্নত চিকিৎসাও তাঁরা করাতে পারেননি ৷ শেষ পর্যন্ত তাঁরা দ্বারস্থ হন ব্লক উন্নয়ন আধিকারিকের ৷
পিংকি জানান, ‘‘তাঁর সারা শরীরে অসহ্য ব্যথা ৷ সবসময় গোটা শরীর জ্বালা করে ৷ বুকেও খুব কষ্ট হয় ৷ টাকার অভাবে চিকিৎসা হচ্ছে না ৷ তাই সাহায্য চাইতে ব্লকে এসেছি ৷ রাজ্য সরকার সবাইকে সাহায্য করছে ৷ আমাকেও সাহায্য করে দিক ৷ স্বাস্থ্যসাথী কার্ড থাকলেও তাতে আমার চিকিৎসা হচ্ছে না ৷ কেন, জানি না ৷ আমার দু’টো ছোট বাচ্চা ৷ আমি মরে গেলে ওদের কী হবে? ওরা অনাথ হয়ে যাবে ৷ আমার স্বামী কিংবা শ্বশুরবাড়ির কেউ আমাকে দেখে না ৷ আমার বাবা খুব গরিব ৷ চিকিৎসা করাতে করাতে বাবা-মা হেরে গিয়েছে ৷’’
পিংকির মা লক্ষ্মী দাস বলেন, ‘‘মেয়েটার খুব অসুখ ৷ অনেকদিন ধরে চিকিৎসা করাচ্ছি ৷ সুস্থ করতে পারিনি ৷ আর মেয়ের চিকিৎসা করাতে পারছি না ৷ আমরা গরিব মানুষ ৷ ওর বাবা ভ্যান চালিয়ে পেটের ভাত জোগাড় করে ৷ এখন কী করলে ভালো হয় বুঝতে পারছি না ৷ তাই মমতাদিদির কাছে আবেদন জানাচ্ছি, তিনি যেন আমার মেয়েকে বাঁচিয়ে তোলেন ৷ মেয়ের দুটো বাচ্চা ৷ ওদের কী হবে, জানি না ৷ স্বাস্থ্যসাথীর কার্ড থাকলেও নার্সিংহোমে বলছে, এই কার্ডে কাজ হবে না ৷ আমার মেয়ের চিকিৎসার ব্যবস্থা না করা হলে আমরা তিনজনই ফাঁসিতে ঝুলে পড়ব ৷ কী করতে বাঁচব? গরিবের পাশে সরকার না থাকলে আমরা কোথায় যাব?’’
হরিশ্চন্দ্রপুর-1 ব্লকের বিডিও অনির্বাণ বসু বলছেন, ‘‘এ নিয়ে আমরা একটা অভিযোগপত্র পেয়েছি ৷ তবে তাতে পরিষ্কারভাবে কিছু লেখা নেই ৷ আমরা বিষয়টি নিয়ে খোঁজখবর নিচ্ছি ৷ গরিব মানুষের পাশে প্রশাসন অবশ্যই দাঁড়াবে ৷ তবে একটা কথা বলতে পারি, যে সমস্ত বেসরকারি হাসপাতাল কিংবা নার্সিংহোমের নাম স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পে যুক্ত রয়েছে, তারা যদি এই কার্ডে মানুষের চিকিৎসা না করে, তবে তাদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার বিধি রয়েছে ৷ আমরা গোটা বিষয়টি জেলা প্রশাসনকেও জানাচ্ছি ৷’’
আরও পড়ুন: স্বাস্থ্যসাথী কার্ড থাকা সত্ত্বেও মেলেনি চিকিৎসা, প্রতিবাদে পথ অবরোধ স্থানীয়দের
এদিকে বিষয়টি নিয়ে একুশের ভোটের আগে তৃণমূল ও বিজেপি শিবিরের মধ্যে কথা চালাচালি শুরু হয়ে গিয়েছে ৷ হরিশ্চন্দ্রপুর-1 ব্লক তৃণমূল সভাপতি মানিক দাসের বক্তব্য, ‘‘ঘটনাটি সত্যিই বেদনাদায়ক ৷ ওই পরিবার আগেই আমার কাছে এসেছিল ৷ আমি তাদের হরিশ্চন্দ্রপুর গ্রামীণ হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দিই ৷ একই ব্যবস্থা করেছি চাঁচল সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালেও ৷ আমি তাদের কলকাতার পিজি হাসপাতালে যেতে বলেছিলাম ৷ সেখানে আমরা বিনা পয়সায় চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দেব ৷ কিন্তু পরিবারটি রোগীকে নিয়ে কলকাতা যায়নি ৷ বাড়িতে রেখে দিলে এই রোগীর চিকিৎসা হবে না ৷ আমরা ওই পরিবারের পাশে রয়েছি ৷’’
অন্যদিকে, এই ঘটনায় স্বাস্থ্যসাথী কার্ডের গ্রহণযোগ্যতা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন বিজেপির হরিশ্চন্দ্রপুর দক্ষিণ মণ্ডল সভপতি রূপেশ আগরওয়ালা ৷ তিনি বলেন, ‘‘তৃণমূলের সরকারটাই ভাঁওতাবাজির সরকার ৷ 2011 সালে রাজ্যের মানুষ দু’হাত দিয়ে এদের সমর্থন করেছিল ৷ মানুষের ভোটে তারা দু’বার ক্ষমতায় এসেছে ৷ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আয়ুষ্মান কার্ড বাতিল করে স্বাস্থ্যসাথী কার্ড তৈরি করেছেন ৷ কিন্তু এই কার্ডে কেউ বিনমূল্যে চিকিৎসা পাচ্ছেন না ৷ সংবাদমাধ্যম থেকে সোশাল মিডিয়ায় বার বার সেই অভিযোগ উঠে আসছে ৷ এই কার্ডে চিকিৎসা না পেয়ে বারোডাঙা গ্রামে একজন স্বেচ্ছামৃত্যুর আবেদন করছেন ৷ সারা পশ্চিমবঙ্গেই এক ছবি ৷ এই সরকার যদি সত্যিই কাজ করত, তাহলে আর দুয়ারে দুয়ারে যেতে হত না ৷ এই সরকার আর থাকবে না ৷ তাই এরা শুধু ভাঁওতাই দিয়ে চলেছে ৷’’