মালদা, 2 জুলাই : কোরোনায় ধাক্কা খেয়েছে অর্থনীতি ৷ কাজ হারিয়েছে বহু মানুষ ৷ অবসাদে আত্মহত্যার ঘটনাও বাড়ছে বিশ্বজুড়ে ৷ এই প্যানডেমিক যে শুধু মানুষের উপর প্রত্যক্ষ প্রভাব ফেলছে তা নয় ৷ মানুষের শৈল্পিক মননও প্রভাবিত হয়েছে ৷ তারই ফলস্বরূপ মালদার গম্ভীরা লোক সংস্কৃতির শিকড় উপড়ে এসেছে ৷ অভাবে পেশা বদলেছে বহু শিল্পী ৷ বর্তমান পরিস্থিতিতে তাই প্রশ্ন উঠছে যে, বিশ্বে সমাদৃত এই লোক সংস্কৃতি ইতিহাসের খাতায় নাম লেখাবে না তো ?
পশ্চিমবঙ্গের লোকসংস্কৃতির মধ্যে বীরভূমের বাউল, পুরুলিয়ার ছৌয়ের মতো মালদার গম্ভীরার বিশ্বজুড়ে খ্যাতি রয়েছে ৷ গম্ভীরা শব্দটির উৎস ‘গম্ভীর’ থেকে, যার অর্থ শিব ৷ গম্ভীরা প্রকৃত অর্থে শিবের উপাসনা ৷ মালদার বিশিষ্ট লোকসংস্কৃতি গবেষক সুস্মিতা সোম জানান, মালদা ও দিনাজপুর সংলগ্ন এলাকা একসময় পৌন্ড্রবর্ধনভুক্ত ছিল ৷ এই পৌন্ড্রবর্ধনের অন্তর্গত বরেন্দ্রভূমির প্রাচীন জনগোষ্ঠী হল পৌন্ড্রিক, পৌন্ড্র, পৌন্ড্র-ক্ষত্রিয় ইত্যাদি ৷ মালদা জেলার পুরাতন মালদা, গাজোল, বামনগোলা ও হবিবপুর এলাকা বরিন্দ নামে পরিচিত ৷ বরিন্দ এলাকায় রাজবংশী, দেশিপলি, বাবুপলি, সাধুপলি প্রভৃতি জনগোষ্ঠীর বসবাস ৷ কোচ, পৌন্ড্র ইত্যাদি জনগোষ্ঠীর সঙ্গে এদের সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ৷ কোচ, ক্ষত্রিয়, রাজবংশী, দেশিপলি গোষ্ঠীর সম্মিলিত উৎসবই হল গম্ভীরা ৷ তবে, পরবর্তী সময়ে এই বরিন্দ এলাকার মধ্যে বাংলাদেশের কিছু অংশও অন্তর্ভুক্ত হয় ৷
বাংলা বছরের শেষ দিন, মহাবিষুব বা চৈত্র সংক্রান্তিতে বাংলাদেশের গ্রামেগঞ্জে যেসব উৎসব হয় মালদা জেলায় তারই নাম গম্ভীরা ৷ গম্ভীরা উৎসবের দুটি দিক ৷ একটি আচারগত, অন্যটি ব্যবহারিক ৷ গম্ভীরার আচারগত দিকটি অতি প্রাচীন ৷ বৌদ্ধ সংস্কৃতির অন্যতম একটি শাখা ৷ শিব পুরাণেও এর অস্তিত্ব পাওয়া যায় ৷ তুলনায় ব্যবহারিক দিকটি অনেকটাই নবীন ৷ বর্তমানে যে গম্ভীরা মানুষের সামনে প্রদর্শিত হচ্ছে, তার উৎপত্তি 500 বছর আগে ৷ এই উৎসবে সং সাজা একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ৷ সারা বছরের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সং-এর মাধ্যমেই প্রদর্শিত হয় ৷ তবে, এখন সে সব বৈশিষ্ট্য আর লক্ষ করা যায় না ৷ যে কোনও বিষয়কেই এখন সংয়ের মাধ্যমে তুলে ধরা হয় ৷
এই গম্ভীরা গানের আসরে শিব একটা বড় ভূমিকা পালন করেন ৷ তিনি সমাজের শীর্ষে অবস্থানের প্রতীক ৷ গায়করা সমাজের বিভিন্ন সমস্যা, শাসকদের নানাবিধ সিদ্ধান্তের কথা শিবের সামনে উপস্থাপন করেন ৷ কোরোনা আঘাত হেনেছে এই প্রাচীন ঐতিহ্যের শিকড়ে ৷ এমনিতেই বিজ্ঞানের দূরন্ত গতির কাছে বেশ কিছু বছর ধরেই একটু একটু করে হার মানতে শুরু করেছে এই লোকসংস্কৃতি ৷ যার জেরে একসময় গোটা জেলায় অসংখ্য গম্ভীরা দল থাকলেও এখন সেই সংখ্যাটা মাত্র 18 ৷ অনেক শিল্পী সম্পূর্ণভাবে এই গান গেয়েই নিজেদের অন্ন সংস্থান করেন ৷ কিন্তু লকডাউনের জেরে গত তিন মাস ধরে তাঁদের গান গাওয়া বন্ধ ৷
যেসব শিল্পীর কাছে রাজ্য সরকারের কার্ড রয়েছে তাঁরা মাসে 1 হাজার টাকা করে ভাতা পান ৷ কিন্তু তাঁরা বাদেও অনেক গম্ভীরা শিল্পী রয়েছেন ৷ পেট চালাতে এখন তাঁদের অনেকে বিকল্প পেশা বেছে নিয়েছেন ৷ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তাঁরা যে ফের এই শিল্পের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করবেন তা নিয়েও যথেষ্ট অনিশ্চয়তা রয়েছে ৷ ফলে কিনারায় দাঁড়িয়ে রয়েছে এই প্রাচীন সংস্কৃতি ৷ তবে, বর্তমান পরিস্থিতিতে মালদার একটি দল এখনও গম্ভীরা লোক সংস্কৃতিকে আঁকড়ে রেখেছে ৷ নাম কুতুবপুর গম্ভীরা দল ৷ এই দলের পরিচালক প্রশান্ত শেঠ বলেন, "তিন মাস ধরে আমরা কোথাও কোনও অনুষ্ঠান করতে পারছি না ৷ কোরোনার প্রভাব কবে কাটবে তাও আমরা বুঝতে পারছি না ৷ আমাদের মধ্যে বহু শিল্পী রয়েছেন যাঁরা পুরোপুরি গম্ভীরার উপর নির্ভরশীল ৷ তাঁরা এখন চরম দুর্দশায় রয়েছেন ৷ আমাদের দলে 12 জন শিল্পী ৷ তার মধ্যে চার জন কোনও ভাতা পান না ৷ তাঁদের আমরাই নিজেদের ভাতা থেকে সাহায্য করি ৷ এছাড়াও এই জেলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে প্রচুর লোকশিল্পী সরকারি কার্ড পাননি ৷ তাই তাঁরা ভাতাও পাচ্ছেন না ৷ এদিকে আমাদের কাজ মানুষকে নিয়ে ৷ আমরা খোলা মঞ্চে গম্ভীরা করি ৷ কিন্তু বর্তমানে কোনও জমায়েত করা যাবে না ৷ শারীরিক দূরত্ববিধি মেনে গম্ভীরা গানের আসর চিন্তাই করা যায় না ৷ কবে যে আমরা আবার নিজেদের এই শিল্পকে মানুষের সামনে তুলে ধরতে পারব জানি না ৷ এমনিতেই এই লোক সংস্কৃতিতে নতুন প্রজন্ম সেভাবে উৎসাহ দেখাচ্ছে না ৷ তারা এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত হতে চাইছে না ৷ তার উপর এই কোরোনা আবহ এই শিল্পকে আরও পিছনে ঠেলে দিল বলেই আমি মনে করি ৷"
এক গম্ভীরা শিল্পী সুবীর দত্ত বলেন, "কোরোনা আবহে গম্ভীরা শিল্পীদের অবস্থা খুবই খারাপ ৷ তিন মাস ধরে আমাদের অনেকেই একবেলা খেয়ে কিংবা না খেয়ে দিন কাটাচ্ছেন ৷ গম্ভীরা গান গেয়েই আমরা সংসার চালাই ৷ এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে গম্ভীরার ভবিষ্যৎ কী হবে তা আমরা কেউ জানি না ৷ আমাদের সরকারি কার্ড নেই ৷ ফলে সরকারি কোনও সহায়তা পাই না ৷ আমাদের এই কার্ড হবে কি না তাও জানি না ৷ জেলার প্রাচীন ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখার সঙ্গে নিজেদের অন্ন সংস্থানের কথা ভেবে আমরা এই সংস্কৃতির সঙ্গে নিজেদের জড়িয়েছিলাম ৷ কিন্তু শুধু গম্ভীরা গেয়ে যে জীবন চালানো যাবে না তা আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছে কোরোনা ৷ এভাবে বেশিদিন চললে এই শিল্পের মৃত্যু প্রায় নিশ্চিত ৷ একমাত্র সরকারি সহায়তাই সুপ্রাচীন এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে ৷ তা না হলে আমাদের সবাইকেই পেশা বদল করতে হবে ৷"
একই কথা শিল্পী অদ্বৈত বিশ্বাসেরও ৷ তিনি বলেন, "শিল্পীদের পেটের সঙ্গে মনের খোরাকও প্রয়োজন ৷ কোরোনা দুই খোরাকই কেড়ে নিয়েছে ৷ মাছ যেমন জল ছাড়া বাঁচে না, শিল্পীও তেমন গান ছাড়া বাঁচে না ৷ তাই পেটের খিদে নিয়েও আমরা মাঝেমধ্যে শারীরিক দূরত্ববিধি মেনে গম্ভীরার অনুশীলন চালিয়ে যাচ্ছি ৷ মালদা জেলায় বৈশাখ মাস থেকেই গম্ভীরা গান শুরু হয়ে যায় ৷ বৈশাখ থেকে আষাঢ়, কখনও শ্রাবণ পর্যন্ত চলে গম্ভীরার মূল মরশুম ৷ এবার কোরোনা সেই মরশুম শেষ করে দিয়েছে ৷ এখন লকডাউন কিছুটা শিথিল করা হলেও গম্ভীরার আসর বসানোর উপায় নেই ৷ কারণ, এই আসর বহু মানুষের সমাহারে হয়ে থাকে ৷ ভাইরাস শিল্পকেও ছেড়ে কথা বলছে না ৷"
জেলার গম্ভীরা গবেষক, অধ্যাপিকা সুস্মিতা সোম বলেন, "বিপর্যয় বহুবিধ ৷ তা অর্থনৈতিক, সমাজিক, প্রাকৃতিক বা অন্য কিছু হতে পারে ৷ কিন্তু বিপর্যয় সাময়িক ৷ আমরা অচিরেই বিপর্যয় থেকে বেরিয়ে এসে নিজেদের জীবনের ছন্দে ফিরে যাই ৷ কিন্তু কোরোনার সমস্যাটা একটু ভিন্ন ৷ এই সমস্যা একটা নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় ৷ যখন কোনও বিপর্যয় একটা জাতির সংস্কৃতি পর্যন্ত পৌঁছে যায় তখন সেটা সত্যিই দুঃসময় ৷ ছোটো এই জেলা গোটা বিশ্বে তার গম্ভীরা গানের জন্য পরিচিতি পেয়েছে ৷ এই গানের ব্যবহারিক দিকটি 500 কিংবা তার কিছু বেশি পুরানো ৷ কিন্তু এর আচারগত দিকটি অন্তত হাজার বছরের পুরানো ৷ এত পুরানো একটি সংস্কৃতি কিংবা ঐতিহ্যের শিকড় যে একটা মহামারীতে নষ্ট হয়ে যাবে তা আমরা ভাবতে চাই না ৷ এর আগেও মহামারি হয়েছে ৷ তাতে কিছুদিন মানুষ বিপর্যস্ত হয়েছে ৷ অচিরেই মানুষ তার পুরানো ছন্দ ফিরে পেয়েছে ৷ আমরা দেখেছি, যখনই কোনও শিল্প আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে, পরবর্তীতে তা নিজের আঙ্গিক পরিবর্তন করে ফিরে এসেছে ৷ কোরোনা গম্ভীরাকে কতটা প্রভাবিত করবে তা সময় বলবে ৷ এই প্রাচীন সংস্কৃতিকে নিয়ে আমরা সবাই ভাবছি ৷ আমরা নিশ্চিত, এই দুঃসময় আমরা কাটিয়ে উঠব ৷ যেসব গম্ভীরা শিল্পীরা বর্তমান পরিস্থিতিতে নিজেদের পেশা বদল করেছেন তাঁরা ফের এই শিল্পের আঙিনায় ফিরে আসবেন ৷ তার জন্য আমাদের সবাইকেই উদ্যোগ নিতে হবে ৷"
মালদা জেলার প্রাচীন এই লোকসংস্কৃতিকে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দিয়েছিলেন প্রয়াত যোগেন্দ্রনাথ চৌধুরি ৷ এই শিল্পের আঙিনায় মটরবাবু নামেই তিনি পরিচিত ৷ শুধু রাজ্য কিংবা দেশ নয়, তিনি গম্ভীরা গানকে নিয়ে গিয়েছিলেন ব্রিটেন, রাশিয়া, ইট্যালি, পোল্যান্ড-সহ একাধিক দেশ ৷ পরবর্তীতে নীরুবাবু, সুকুমারবাবু-সহ অনেকেই এই শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন ৷