মালদা, 11 জুলাই : সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে করোনার তৃতীয় ঢেউ আছড়ে পড়ার আশঙ্কা করছেন চিকিৎসকরা । তাতে বেশি সংক্রমিত হতে পারে শিশুরা । এদিকে ঠিক সেই সময় চলে আসছে বাঙালির প্রাণের উৎসব, দুর্গাপুজোও । তবে কি এবারও গত বছরের মতোই ব্যবসার পরিস্থিতি হবে? আশঙ্কায় ঘুম উড়েছে বস্ত্র ব্যবসায়ীদের । আশঙ্কার বাইরে নন মালদার ব্যবসায়ীরাও ৷
তাঁরা এবার পুজোর জন্য পোশাক আগাম মজুত করবেন কি না তা নিয়েও দ্বিধাগ্রস্ত । অধিকাংশই জানাচ্ছেন, এবার আগে পোশাক মজুত করা যাবে না । তাতে ক্ষতির আশঙ্কা আরও বেড়ে যাবে । একই বক্তব্য বস্ত্র ব্যবসায়ী সংগঠনেরও ।
গত বছরের মার্চে দেশে ধাক্কা দিয়েছিল করোনা । দেশব্যাপী লকডাউন । বন্ধ হয়ে গিয়েছিল যাবতীয় কাজকর্ম । এরপর কেটে গিয়েছে প্রায় দেড়টা বছর । এরই মধ্যে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে মৃত্যুমিছিল দেখেছে দেশ । ধ্বস্ত দেশের অর্থনীতি । পেট্রোপণ্যের লাগামছাড়া মূল্যবৃদ্ধিতে মানুষের বেঁচে থাকাটাই এখন সমস্যার । তবে ধীরে ধীরে করোনার প্রকোপ কমছে । এ’রাজ্যে বিধিনিষেধও অনেকটা শিথিল করা হয়েছে । কিন্তু নিজেদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় কবে ফিরে যাওয়া যাবে, তা সবারই অজানা । কারণ, এখন ভাইরাসের তৃতীয় ধাক্কার অপেক্ষায় গোটা দেশ ।
গত বছর দুর্গাপুজো, ইদ কিংবা চৈত্র সেলে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছিলেন জেলার বস্ত্র ব্যবসায়ীরা । তবুও তার মধ্যে কিছু ব্যবসা হয়েছিল । কারণ, তখনও মানুষের পকেট পুরোপুরি ফাঁকা হয়ে যায়নি । কিন্তু এবার ইদে বোঝা গিয়েছে, মানুষের জমানো অর্থ শেষ । গতবারের থেকেও এবারের ইদে কাপড়ের ব্যবসা কম হয়েছে । এরই মধ্যে এগিয়ে আসছে পুজো । ঠিক যে সময় করোনার তৃতীয় ঢেউ আছড়ে পড়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা । সাধারণত, রথযাত্রার পরেই পুজোর কাপড় মজুত করতে শুরু করেন বস্ত্র ব্যবসায়ীরা । গোটা জেলায় প্রায় 1 হাজার 600 কোটি টাকার ব্যবসা হয় শুধু পুজোর মরশুমে । এবার পুজোয় সেই ব্যবসা যে তার ধারেকাছেও যাবে না, তা বুঝেছেন সবাই । তাই এবার পুজোর পোশাক আগাম মজুত করার কথা এখনও চিন্তা করছেন না তাঁরা ।
শহরের নেতাজি মার্কেটের বস্ত্র ব্যবসায়ী গৌতম কুণ্ডু । একই সঙ্গে পাইকারি ও খুচরো ব্যবসা করেন । তিনি বলছেন, “গত বছর উৎসব মরশুমে আমাদের ব্যবসা পুরোপুরি মার খেয়েছিল । এই মার্কেটটা মূলত পাইকারি । বাইরের লোকজন বেশি আসে । সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে করোনার তৃতীয় ঢেউ আসার কথা বলা হচ্ছে । তাতে যদি ফের লকডাউন হয়ে যায়, তবে আমাদের ব্যবসা আরও খারাপ হয়ে যাবে । কাপড়ের উৎপাদকরাও এবার উৎপাদন করতে ভয় পাচ্ছেন । নতুন মাল তৈরি করছেন না বললেই চলে । আমরা পুজোর মাল মজুত করার কথা এখন ভাবছিই না । ভয় পাচ্ছি । তাছাড়া মানুষের হাতে পয়সা নেই । পয়সা না থাকলে লোকে কেনাকাটা কীভাবে করবে? অন্যান্য বছর আমরা পুজোয় নতুন ডিজাইনের মাল তোলার চেষ্টা করি । এবার সেসব নিয়ে ভাবছি না ।”
আর এক ব্যবসায়ী শ্রীপদ কুণ্ডু বলেন, “করোনা না হলে এবার পুজোয় টুকটাক ব্যবসা হবে । কিন্তু করোনার তৃতীয় ঢেউ এলে ব্যবসা কিছুই হবে না । এই করোনার জন্যই এবার মালদার আমের ব্যবসা ঠিকমতো হয়নি । আম সেভাবে বাইরে পাঠানো যায়নি । পরিযায়ী শ্রমিকরা কাজে যেতে পারছে না । ফলে আমাদেরও দোকানে বসেই দিন কাটাতে হচ্ছে । এই সময় ব্যবসা ক্ষতির মধ্যে চলছে । পুজোর মাল আগাম তুলব কি না, তা নিয়ে ভাবছি । হয়তো কিছু মাল তুলব । কিন্তু সাহস পাচ্ছি না । কারণ, আমাদের মহাজনরা বিক্রি হওয়া মাল ফেরত নেয় না । বিক্রি না হলে সেই মালই সারা বছর ধরে বিক্রি করতে হবে ।”
শহরের আর এক পাইকারি ও খুচরো বস্ত্র ব্যবসায়ী সুজিত কুণ্ডু জানাচ্ছেন, “গত বছর পুজোর ব্যবসায় মার খেয়েছি। এবারও পরিস্থিতি খুব ভাল ঠেকছে না। সবাই আতঙ্কে রয়েছে। বেশিরভাগ মানুষই বাড়ি থেকে বেরোচ্ছে না। আমাদের ব্যবসা মূলত মহিলাদের উপর ভিত্তি করে হয়ে থাকে। কিন্তু মহিলারাই আতঙ্কে নিজেদের ঘরবন্দি করে রেখেছেন। তাই এই মুহূর্তে পুজোর মাল আগাম মজুত করার কোনও চিন্তাভাবনা আমাদের নেই। পরিস্থিতি দেখে সিদ্ধান্ত নেব। গতবার কিছু মাল ফোনের মাধ্যমে তুলেছিলাম। কিছু মাল বিক্রিও হয়েছিল। কিন্তু এবার এখনই ব্যবসা চলছে না। ইদ, পয়লা বৈশাখে কার্যত ব্যবসাই হয়নি। মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ছে। তাদের হাতে পয়সা নেই। এবার মালদার আম বাইরে যেতে পারেনি। চাষিদের হাত ফাঁকা। শ্রমিকরাও কাজে যেতে পারছে না। তারাও কোনও রকমে বেঁচে রয়েছে। তাই এবার আগাম পুজোর মাল তোলার ভরসা পাচ্ছি না।”
মালদা ক্লথ মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক স্বপন বারোরি বলছেন, “করোনার প্রকোপ কিছুটা যে কম হয়েছে তা ঠিক। কিন্তু গ্রাম থেকে খদ্দেররা আসছে না। বাজার প্রায় ফাঁকা। দু’বছর আগেও আমরা রথযাত্রার পর থেকেই পুজোর ব্যবসার প্রস্তুতি শুরু করে দিতাম। কিন্তু এবার চৈত্র সেল, পয়লা বৈশাখ, ইদের বাজার পুরো মার খেয়েছি। বিভিন্ন জায়গা থেকে ঋণ নিয়ে আমরা মাল তুলেছিলাম। সেই মালই এখনও বিক্রি করা যায়নি। আমরা হতাশায় ভুগছি। জেলার পরিযায়ী শ্রমিকরা ভিনরাজ্যে কাজে যেতে পারছে না। তাদের কাজ নেই। এবার মালদার আমের ব্যবসা ভাল হয়নি। বাজারে এখন 5-6 টাকা কিলো দরেও আম বিক্রি হচ্ছে না । ফলে আমের সঙ্গে জড়িত সবাই মার খেয়েছে । তাহলে তারা জামাকাপড় কিনবে কেমন করে? এই পরিস্থিতিতে আমরা কীভাবে পুজোর মাল তোলার ঝুঁকি নেব! কে আমাদের ঋণ দেবে? সরকার আমাদের ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করলে আমরা উপকৃত হব। তা না হলে আমরা শেষ হয়ে যাব। আমাদের দোকান বন্ধ করে দিতে হবে। আগে আমাদের জেলায় পুজো মরশুমে প্রায় 1 হাজার 600 কোটি টাকার ব্যবসা হত। গত বছর করোনা থাকা সত্ত্বেও প্রায় ৯০০ কোটি টাকার ব্যবসা হয়েছে। কিন্তু এখন পরিস্থিতি আরও খারাপ। মানুষের হাতে যেমন পয়সা নেই, তেমনই পুজোর আগে কিংবা তার মধ্যেই করোনার তৃতীয় ঢেউ আসছে। আমরা বাঁচব কি না সেটাও জানি না। মানুষ তো ভয় পাবেই।”