কলকাতা, 18 মার্চ : স্কুল বন্ধ হওয়ার 1 বছর অতিক্রান্ত । 11 মাস বন্ধ থাকার পর নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির পড়ুয়াদের জন্য স্কুলের দরজা খুললেও এখনও পর্যন্ত তা প্রাথমিক ও উচ্চপ্রাথমিকের পড়ুয়াদের জন্য বন্ধ । আর এই এক বছর স্কুলে না গিয়ে বাড়িতে বদ্ধ থাকার ক্ষতিকারক প্রভাব হিসেবে দেখা দিয়েছে, পড়ালেখায় অনীহা, জানা পড়া ভুলে যাওয়ার মতো একাধিক সমস্যা । এমনই অভিযোগ তুলছে শিক্ষক ও অভিভাবকদের একাংশ । শিক্ষকদের বক্তব্য, এই রকম চলতে থাকলে বাড়বে স্কুলছুট । ছাত্র-ছাত্রীদের ফের ক্লাসরুম শিক্ষায় অভ্যস্ত করা হয়ে উঠবে কঠিন ।
গত বছর 16 মার্চ থেকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল রাজ্যের সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান । চলতি বছরের 12 ফেব্রুয়ারি উচ্চ শ্রেণির পড়ুয়াদের জন্য খুলেছে স্কুল । চলছে সশরীরে ক্লাস ও পরীক্ষা । কিন্তু, প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণির পড়ুয়ারা 1 বছর ধরে ঘরেই বন্দি । অনলাইন মাধ্যমে বিভিন্ন পদ্ধতিতে চলছে তাঁদের পঠন-পাঠন । কিন্তু, তা সত্ত্বেও পড়াশোনা ভুলে যাচ্ছে তাঁরা । এমনই জানাচ্ছেন অভিভাবকরা । কলকাতার একটি সরকার পোষিত স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে সমিত চৌধুরির মেয়ে । তিনি বলেন, "আমার মেয়ে পড়া ভুলে যাচ্ছে । মেয়েকে রাস্তায় দেওয়ালে আঁকা পদ্মফুল দেখিয়ে এটা কী ফুল জিজ্ঞেস করলে সঠিক উত্তর দিচ্ছে । বলছে 'এটা পদ্মফুল' । কিন্তু, তারপরেই যখন জিজ্ঞেস করছি, ভারতের জাতীয় ফুলের নাম কী ? তখন আর উত্তর দিতে পারছে না । পদ্মফুল আর জাতীয় ফুলের মধ্যেই সংযোগটাই করতে পারছে না ।"
বাগবাজার মাল্টিপারপাস গার্লস স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে মাধুরী দত্তের মেয়ে । তিনি বলেন, "স্কুল থেকে পড়া হোয়াটসঅ্যাপে দেওয়া হচ্ছে । সেটা পড়ছেও । কিন্তু, স্কুলে গেলে পড়াশোনায় যে গতিটা দেখা যায় সেটা অনেকটাই কমে গেছে । স্কুলে গেলে খেলাধূলা, বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হওয়াটাও একটা আলাদা মজা ছিল । সেটাও এখন আর নেই । পড়া দেওয়া হলেও যেহেতু স্কুল নেই তাই চাপটাও কমে গেছে । পড়তে বসাতে গেলে অনেকটাই কষ্ট করতে হচ্ছে আমাদের । ওদের মনের মধ্যে চলে এসেছে স্কুল তো হবে না । তাই আজকের পড়াটা কালকে করলেও হবে । সবমিলিয়ে পড়াশোনার প্রতি একটা অনীহা চলে এসেছে দেখছি ।"
দক্ষিণ 24 পরগনার একটি স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে তরুণকান্তি দাসের ছেলে । তিনি বলেন, "দীর্ঘ একবছর হয়ে গেল । ছেলে বাড়িতে পড়াশোনা একদম করছে না । ডিসিপ্লিন মানছে না । স্কুলে একটা ডিসিপ্লিন, একটা চাপের মধ্যে থাকত । সেটা সম্পূর্ণ ব্যর্থ । এভাবে দীর্ঘদিন পড়াশোনার সঙ্গে বিচ্ছিন্ন থাকলে ওদের ভবিষ্যৎ কী হবে তা নিয়ে আমরা খুব চিন্তিত । বিদ্যালয়ে না গেলে পঠন-পাঠনের বাঁধন থাকছে না । বাড়িতে অভিভাবকদের কথা শুনছে না । বাড়িতে মোবাইল, আড্ডা, খেলাধূলা নিয়েই থাকছে । পড়াশোনা থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে ।"
অনলাইনে পঠন-পাঠন হলেও মোবাইল বা ইন্টারনেট পরিষেবার কারণে অনেকেই তাতে অংশগ্রহণ করতে পারছেন না । বিশেষত, যে সকল বাড়িতে একাধিক স্কুল পড়ুয়া রয়েছে । এমনও অভিযোগ উঠছে অভিভাবকদের তরফে । প্রধান শিক্ষক, শিক্ষিকারাও এতদিন স্কুল বন্ধ থাকার নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে যথেষ্ট চিন্তিত । তাই একাধিক শিক্ষক সংগঠনের তরফে ইতিমধ্যেই প্রাথমিক ও উচ্চপ্রাথমিক স্তরের পড়ুয়াদের জন্য স্কুল খোলার দাবি তোলা হয়েছে ।
বঙ্গীয় প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আনন্দ হাণ্ডা বলেন, "আমরা যখন মিড-ডে মিল বিতরণের জন্য স্কুলে যাই অভিভাবকরা তখন অভিযোগ করেন, বাচ্চারা তো পড়া ভুলেই যাচ্ছে । কারণ, স্কুলে যে খেলাধূলা, বন্ধুদের সঙ্গে মেলামেশা সেটা তো বন্ধ হয়ে গেছে । ফলে, তাদের স্বাভাবিক বিকাশটা বন্ধ হয়ে গেছে । বাড়ির লোকজন তাকে পড়ার কথা বলছে । এই পরিবেশটা তার কাছে অসহনীয় হয়ে উঠছে । চার দেওয়ালের মধ্যে এক বছরের বেশি সময় ধরে বদ্ধ হয়ে গেছে । তাই পড়াশোনাটা তার আর ভালো লাগছে না । শিক্ষা দফতরের উচিত সব অংশীদারদের সঙ্গে কীভাবে স্কুল খোলা যেতে পারে তা দেখা । কোনোভাবে স্কুল না চালু করলে শিশুরা মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত হয়ে উঠতে পারে ।"
অ্যাডভান্সড সোসাইটি ফর হেডমাস্টার্স অ্যান্ড হেডমিস্ট্রেসেসের সাধারণ সম্পাদক চন্দন কুমার মাইতি বলেন, "প্রাথমিক এবং উচ্চপ্রাথমিক বিভাগে আমরা স্কুলে এখনও চালু করতে পারিনি । বিদ্যালয়কে এই অংশটিকে বন্ধ রেখে একটি প্রজন্মকে মারাত্মক ক্ষতির মুখে ঠেলে দিচ্ছি আমরা । একবছর ধরে বাইরে থেকে স্কুলছুট হয়ে যাচ্ছে অনেকেই, তারা মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছে, বাড়িতে পড়াশোনা করছে না । এই ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে দ্রুত প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণির জন্য স্কুল খোলার দাবি জানাচ্ছি ।"
পশ্চিমবঙ্গ সরকারি বিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সৌগত বসু বলেন, "বিচ্ছিন্ন ইতিমধ্যেই হয়ে গেছে । তাদের জীবন থেকে যা হারিয়ে যাওয়ার তা হারিয়ে গেল । তারা আর কোনোদিন স্বাভাবিক ক্লাসে মনোযোগ দিতে পারবে না । খুব খারাপ কাজ হল । বাচ্চার স্কুল যাওয়াটা একটা অভ্যাস । সেটা নষ্ট হয়ে গেল । আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়াটা খুব কঠিন কাজ । স্কুল তো খুলতেই হবে । সেটা বিভিন্নভাবে করা যায় । সামাজিক দূরত্ব মেনে সপ্তাহে এক একদিন এক একটা ক্লাসকে আনা যেতে পারে । কিন্তু, স্কুল বলে যে একটা বস্তু আছে সেটা তো ভুলে গেছে । এরকম চলতে থাকলে এমন একটা সময় আসবে যখন বলা হবে, স্কুল রেখে লাভ কী? সবই তো অনলাইনে হয়ে যাচ্ছে ।"
তবে, শিক্ষক-শিক্ষিকারা স্কুল খোলা হোক চাইলেও, স্কুল খোলা উচিত কিনা তা নিয়ে এখনও ধোঁয়াশায় অভিভাবকরা । তাঁদের কেউ কেউ চাইছেন স্কুল খুলুক । চালু হোক ক্লাস । আবার বর্তমানে করোনা মহামারির পরিস্থিতি দেখে কেউ কেউ মনে করছেন আর একটা বছর স্কুল বন্ধ থাকলে থাক । কিন্তু, বাচ্চা সুস্থ থাকুক ।