কলকাতা, 10 নভেম্বর: রাজ্যের পরিবহণ ব্যবস্থা কি ক্রমশ সাধারণ মানুষের কাছে ত্রাস হয়ে উঠছে ? শহর যত উন্নত হচ্ছে তত গতি বাড়ছে। বাড়ছে জনসংখ্যাও। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে যানবাহনের সংখ্যা। রাস্তাকে মানুষের জন্য নিরাপদ করে তুলতে বসানো হয়েছে স্পিডো মিটার। প্রতিটি ট্রাফিক সিগনালে লাগানো হয়েছে সিসিটিভি ক্যামেরা।
রাত হলেই বিভিন্ন রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশের তরফে ব্রেথ অ্যানালাইজার দিয়ে চালকের নিশ্বাস পরীক্ষা করা হচ্ছে। ট্র্যাফিক বিভাগের পক্ষ থেকে চালকদের প্রশিক্ষণ শিবিরও শুরু করা হয়েছে। তবুও কমছে না পথ দুর্ঘটনা। বরং সম্প্রতি রোড ট্রান্সপোর্ট অ্যান্ড হাইওয়ে বা কেন্দ্রীয় সড়ক পরিবহণ ও মহাসড়ক মন্ত্রক পক্ষ থেকে রোড অ্যাক্সিডেন্টস ইন ইন্ডিয়া রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে যে রাজ্যে গতবছরের তুলনায় বেড়েছে পথ দুর্ঘটনা। তাহলে সমস্যা কোথায়?
সাধারণ মানুষের জন্য কতটা নিরাপদ রাস্তা-ঘাট? সম্প্রতি বেহালার বাস দুর্ঘটনা আবারও সেই প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। রাস্তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আর গণপরিবহনের উন্নয়নের জন্য কি যথেষ্ট সচেতন প্রশাসন? এই নিয়েও উঠছে প্রশ্ন। রোড ট্রান্সপোর্ট অ্যান্ড হাইওয়ে মন্ত্রকের পক্ষ থেকে রোড অ্যাক্সিডেন্টস ইন ইন্ডিয়ার রিপোর্ট অনুসারে রাজ্যে পথ দুর্ঘটনার সংখ্যা যথাক্রমে:
2018 সালে 12 হাজার 705টি
2019 সালে 12 হাজার 658টি
2020 সালে 10 হাজার 863টি
2021 সালে 11হাজার 937টি
2022 সালে 13 হাজার 686টি, অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে 21 থেকে 22 এর মধ্যে এক লাফে পথ দুর্ঘটনার সংখ্যা বেড়েছে 1হাজার 749টি। দেশের সবকটি রাজ্যের মধ্যে পথ দুর্ঘটনার খতিয়ান অনুসারে পশ্চিমবঙ্গের স্থান রয়েছে 11 নম্বরে। এই তালিকায় একেবারে উপরে রয়েছে উত্তরপ্রদেশ।
রাজ্যে সরকারের পরিবহণ বিভাগের তরফে প্রকাশিত 'ড্রাইভিং ম্যানুয়াল'-এর তথ্য অনুসারে পথ দুর্ঘটনার কারণ অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানো, কোনও কারণে চালকের মানসিক চাপ, মদ্যপান করে গাড়ি চালানো, লালবাতি না মানা, সিট বেল্ট না পড়া, হেলমেট না পড়া ছাড়াও কারণ হিসাবে উটে এসেছে গাড়ি বা মোটরবাইক চালাবার সময় মোবাইলে কথা বলা, সুনির্দিষ্ট লেন না মানা, গাড়ির ত্রুটিপূর্ণ অবস্থা, খারাপ রাস্তা-সহ আরও একাধিক বিষয় দর্শানো হয়েছে।
এই বিষয় পাবলিক ভেহিকেল বিভাগের এক আধিকারিক জানিয়েছেন, প্রায় 90 হাজারের মত গাড়িতে এখন ভিএলটি (ভেহিকেল লোকেশন ট্র্যাকিং) ডিভাইস বসানোর কাজ শেষ হয়ে গিয়েছে ৷ তাই বাসগুলো ঠিকঠাক পরিষেবা দিচ্ছে কি না, কোনও বাস অতিরিক্ত বেগে গাড়ি চালাচ্ছে কি না, সেটা নজরে রাখা সম্ভব হয়েছে। এছাড়াও সরকারের তরফে চালক এবং ড্রাইভিং স্কুলের শিক্ষকদেরও প্রশিক্ষণ দেওয়া চলছে। এখানে শুধু দক্ষ চালক তৈরি করা নয়, একজন চালক যখন গাড়ি চালাচ্ছেন তাঁর মানসিক অবস্থা কেমন থাকতে হবে সেই নিয়েও আলোচনা করা হয়।
পরিবহণ ব্যবস্থাকে আরও উন্নত করতে পরিবহণ দফতর 'আইরেড' (irad) অ্যাপ ব্যবহার করে। মূলত, একটি পথ দুর্ঘটনা হলে পুলিশ, চিকিৎসক এবং মোটর ভেহিকেল বিভাগের পক্ষ থেকে পৃথক ভাবে রিপোর্ট দেওয়া হয়। প্রতিটি রিপোর্ট এই অ্যাপে আপলোড করতে হয়। অর্থাৎ প্রতিটি দুর্ঘটনার চুলচেরা বিশ্লেষণ করা সম্ভব হয়। কী কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে, এর থেকে তথ্য বের করে প্রশিক্ষণের ম্যানুয়াল তৈরি করা হয়।
ট্রান্সপোর্ট ডিরেক্টরেট থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে দেখা যাচ্ছে যে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা হচ্ছে জাতীয় ও রাজ্য সড়কে । রাতের তুলনায় সকালে দুর্ঘটনার সংখ্যা তুলনায় বেশি ৷ শুধু তাই নয়, সেই দুর্ঘটনার জন্য বেশিরভাগ সময়ে দায়ী থাকছে মোটারবাইকের চালক ৷ আরও সহজ ভাবে বোঝালে, শীতের সময় কুয়াশা ও বর্ষার সময় ভেজা রাস্তার জন্য মোটরাবাইকের গতি কম থাকে ৷ কিন্তু আকাশ পরিষ্কার বা রৌদ্রজ্জ্বল আবহাওয়া হলে মোটারবাইকের চালকরা গতি বাড়িয়ে দিচ্ছেন ৷ এক্ষেত্রে তাঁদের বাইকে থাকে না স্পিডো মিটারও ৷ ফলে মোটরবাইকের সঙ্গে উলটো দিক থেকে আসা গাড়ির সঙ্গে ধাক্কা লেগে দুর্ঘটনা বাড়ছে ৷
অন্যদিকে, অনেক ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, দুর্ঘটনার কবলে পড়া কোনও একটি গাড়ির উপরে একাধিক পুলিশের কেস রয়েছে। তা সত্ত্বেও সেইভাবেই গাড়িগুলি রাস্তায় চলছে। এই বিষয়ে বাস মিনিবাস সমন্বয়ে সমিতির সাধারণ সম্পাদক রাহুল চট্টোপাধ্যায় বলেন, "এক একটি বাসে হাজার বা দু'হাজারের উপর কেস রয়েছে। তবে এটা খতিয়ে দেখার দরকার আছে যে এর মধ্যে কতগুলি প্রকৃত মামলা। অনেক সময় বিনা কারণে চালকদের উপর জুলুম চালানো হয়। এইসব মামলার আইনি বাস্তবতা নিয়ে আমাদের আপত্তি রয়েছে। বারে বারে এই বিষয়গুলি প্রশাসনের নজরে আনা সত্বেও কোনও কাজ হয়নি।"
তিনি আরও জানিয়েছেন, যখন একই রুটে অনেক বেশি সংখ্যক বাস দেওয়া হয়, তখন সেই রুটে যাত্রী সংখ্যার অনুপাতে বাসের সংখ্যা অনেক বেশি। এরফলে স্বাভাবিকভাবেই সবক'টা বাসই অনেক বেশি পরিমাণে যাত্রী তোলার চেষ্টা করে। এর ফলে দু'টি বাসের মধ্যে রেষারেষি হয়। এই বিষয়টি প্রশাসনে জানানো হয়েছে, কিন্তু কোনও সুরাহার পথ মেলেনি।
যদিও পরিবহণ বিভাগের এক আধিকারিক এই বিষয়টি মানতে নারাজ। পক্ষান্তরে তিনি জানান যে বাসের ক্ষেত্রে কোনও রুটেই প্রয়োজনের থেকে বেশি বাস দেওয়া হয় না। কলকাতার রাস্তার ক্ষেত্রে বরং এক একটি রুটে যতগুলি বাস প্রয়োজন তার চেয়ে কম বাস চালানো হয়। বরং দু'টি বাস অনেক সময় রেষারেষি করে কোনও কারণ ছাড়াই ৷ যার ফলে দুর্ঘটনা ঘটে৷ এছাড়াও সাধারণ মানুষের হাঁটার জন্য ফুটপাথ রয়েছে।
কিন্তু প্রশাসনের ঢিলেঢালা মনোভাবের জন্য এখন হকাররা ফুটপাথ দখল করে রেখেছে। তাই অগত্যা পথচারীদের যানবাহন যাওয়ার রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হচ্ছে। অসাবধানতাবশত বাড়ছে পথ দুর্ঘটনা ৷ এছাড়াও অভিযোগ উঠেছে ট্রাফিক পুলিশের বিরুদ্ধেও ৷ পরিবহণ বিভাগের আধিকারিক জানান, ট্রাফিক পুলিশের কাজ যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করা। কিন্তু তা না করে তাঁরা টাকা তুলতে ব্যস্ত থাকেন। তাই অকারণে বিভিন্ন অবাস্তব কেসও দেওয়া হয় গাড়িগুলিকে।
প্রসঙ্গত, কেন্দ্রীয় রিপোর্ট অনুসারে গোটা দেশে 2022 সালে 4 লাখ 61হাজার 312টি পথ দুর্ঘটনা ঘটেছে। মৃত্যু হয়েছে 1 লাখ 68 হাজার 491 জনের। সব চেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটছে জাতীয় সড়কগুলিতে 1 লাখ 51 হাজার 997টি। 2022 সালের এই সংখ্যা অন্য বছরগুলি তুলনায় 11.9 শতাংশ বেশি। পাশাপাশি মৃত্যুর ঘটনা বেড়েছে 9.4 শতাংশ। আহতের সংখ্যা বেড়েছে 15.3 শতাংশ। অর্থাৎ পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশে প্রতি 3 মিনিটে একজনের মৃত্যু হয়েছে পথ দুর্ঘটনায়। কিন্তু কেন ঘটছে এত দুর্ঘটনা? মানুষের প্রাণ বাঁচাতে কি উদ্যোগ নিচ্ছে পুলিশ ? লালবাজর ট্রাফিক বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে বিষয়টি নিয়ে কোনও স্পষ্ট প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।
আরও পড়ুন:
দশমীতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখে ফেরার পথে দু’টি বাইকের ধাক্কা, মৃত 4
নতুন বাইক চালিয়ে ঠাকুর দেখা শেষে আর বাড়ি ফেরা হল না দুই ভাইয়ের!