কলকাতা, 7 মার্চ : বাসচালকের আসনে মহিলাদের সচরাচর দেখা যায় না । তবুও বাসে উঠে যদি দেখেন কোনও মহিলার হাতে স্টিয়ারিং, তাহলে ভ্রু কুঁচকাতে বাধ্য । আবার কখনও তা দেখে মুখ থেকে সম্ভ্রম মাখানো শব্দও বেরিয়ে আসতে পারে । নারী দিবসে রইল এমনই এক মহিলা বাসচালকের কাহিনী ৷
স্ত্রী ও বৃদ্ধা মাকে নিয়ে অভাবের সংসার ছিল নিমতার মিনিবাস চালক শিবেশ্বর পোদ্দারের ৷ এরপর দুই মেয়ের জন্ম হওয়ায় তীব্র সমালোচনার মুখে পড়তে হয় শিবেশ্বর ও স্ত্রী প্রতিমা পোদ্দারকে । তখন থেকেই স্ত্রীকে পেশাদার করে তোলার ভাবনা জেঁকে বসে শিবেশ্বরের মনে ৷ আর তারপর থেকে আজ 10 বছর কেটে গিয়েছে ৷ সেই থেকে আজও একসঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে স্বামীর অনুপ্রেরণায় কাজ করে চলেছেন নিমতা-হাওড়া রুটের মিনিবাসের মহিলা চালক প্রতিমা পোদ্দার । কখনও চালকের আসনে তো কখনও কন্ডাকটারের ব্যাগ কাঁধে যাত্রীদের থেকে ভাড়া নিচ্ছেন ৷ শহরের বাস চালকদের দুনিয়ায় প্রতিমা পোদ্দার এক বিরল চরিত্র ।
নিমতার পাইকপাড়ার মিনিবাস চালক দম্পতি প্রতিমা এবং শিবেশ্বরের সংসারে রয়েছে বৃদ্ধা মা ও দুই মেয়ে ৷ বড় মেয়ে অঙ্ক নিয়ে পড়াশোনা করেছেন আর ছোট মেয়ে দশম শ্রেণিতে । পরপর দুই মেয়ের জন্ম হওয়ায় বহু গঞ্জনা সহ্য করতে হয় পোদ্দার দম্পতিকে । সঙ্গে নানা কারণে শিবেশ্বরের ব্যবসার টালমাটাল পরিস্থিতি । সংসার বাঁচাতে ব্যবসা ছেড়ে প্রথমে অটো-রিক্সা চালানো থেকে শুরু করে অ্যাম্বুলেন্স ও বর্তমানে বাস ৷
আরও পড়ুন : নারীদিবসে দশভূজাদের শ্রদ্ধা জানাল উইন্ডোজ়
পরিশ্রম করলেও একার উপার্জনে সংসারের খরচ উঠছিল না ৷ এই অবস্থায় স্ত্রী প্রতিমাকে পাশে দাঁড়ানোর অনুরোধ করেছিলেন শিবেশ্বর । শখের বশে ড্রাইভিং শেখা স্ত্রী প্রতিমা তখনও বুঝে উঠতে পারেননি এই ড্রাইভিংই তাঁর জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে যাবে ৷ স্বামীর অনুপ্রেরণায় শখে শেখা ড্রাইভিংও জীবনের পথে কাজে লাগে প্রতিমার ।
স্বামীর প্রস্তাব প্রথম খারিজ করে দিলেও পরে সংসারের কঠিন পরিস্থিতির কথা চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নেন বাসচালক হিসেবে কাজ শুরু করার ৷ তবে বাস চালাতে গিয়েও কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয় প্রতিমাকে ৷
শিবেশ্বর বলেন,"একটা সময় চালকের আসনে মহিলা বসে রয়েছে দেখে অনেকেই বাসে উঠতে চাননি । উঠলেও নেমে গিয়েছেন । তবু আমরা হাল ছাড়িনি ৷ আজ 10 বছর হয়ে গেল ৷ এখন প্রতিমাকে দেখে অনেকেই বাহবা দেয় । আশীর্বাদ করে ।"
আরও পড়ুন : নারী দিবসে মালদা ডিভিশনে চলল সম্পূর্ণ মহিলা পরিচালিত ট্রেন
ভোর সাড়ে তিনটের সময় বাস নিয়ে নিমতা থেকে হাওড়ার উদ্দেশ্যে রওনা হন শিবেশ্বর । এরপর সংসারের সমস্ত কাজ সামলে সকাল সাতটায় বাসের স্টিয়ারিং ধরেন প্রতিমা । একটা ট্রিপ স্বামী চালান আর একটা ট্রিপ প্রতিমা । "ওর ড্রাইভিংয়ের সময় আমি কনডাক্টরের দায়িত্ব সামলাই । আবার আমি যখন চালকের আসনে বসি তখন প্রতিমা কনডাক্টরের কাজ করে," বলছেন শিবেশ্বর ৷
কিন্তু স্ত্রীকে এমন পুরুষশাসিত পেশায় নিয়ে আসাতে দুশ্চিন্তা হয়নি ? শিবেশ্বরের উত্তর, "ব্যবসায়, অফিসে যদি স্বামী-স্ত্রী পাশাপাশি কাজ করতে পারে তাহলে এই পেশায় নয় কেন ৷ এই ভাবনা থেকেই দু'জনে এক সঙ্গে কাজ করছি ।"
পেশায় লিঙ্গ বৈষম্য নেই বলে সোচ্চার হলেও অনেক পেশায় আজও পুরুষ-নারীর বিভেদ রয়ে গিয়েছে । বাস চালাতে গিয়ে তাই প্রতিমাদেরকেও অনেক অসুবিধার সামনে পড়তে হয় । পরিকাঠামোগত দৈন্যতার কারণেই এই অসুবিধা । অসুবিধা, সমস্যা তো জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে রয়েছে । তবুও দমে না গিয়ে প্রতিমা পোদ্দাররা এগিয়ে যান বলেই রচিত হয় ধন্যি মেয়ের লড়াই উপাখ্যান ।
আরও পড়ুন : লোক দেখানো নারীদিবস পালন করে কী হবে ? ভিডিয়োয় বেসুরো মধুমিতা