কলকাতা, 3 জুন : "একসঙ্গে বেশিদিন থাকতে পারেননি । কিন্তু, কিশোরদা, রুমাদির সম্পর্ক কোনওদিনই খারাপ হয়নি । একটা মানসিক সম্পর্ক থেকেই গিয়েছিল ।" দুই প্রবাদপ্রতিম শিল্পীর সম্পর্ক নিয়ে বলতে গিয়ে নস্টালজিক হয়ে পড়লেন সংগীতশিল্পী কল্যাণ সেন বরাট । বললেন, রুমা গুহঠাকুরতার প্রয়াণ শুধু একটা সম্পর্কের শেষ নয়, এটা তাঁর কাছে মাতৃ বিয়োগের সমান ।
সালটা 1946 । মায়ের পাশে বসে আদুল গায়ে গান শুনছে ছোট্ট মেয়েটি । মা সতী দেবী সেসময়ের বিখ্যাত গায়িকা । সেদিনের ছোট্ট মেয়েটিই রুমা গুহঠাকুরতা । বড় হয়ে যিনি সংগীত আন্দোলনে নেতৃত্ব দেবেন । সলিল চৌধুরির সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে গড়ে তুলবেন ক্যালকাটা ইয়ুথ কয়্যার ।
রুমা গুহঠাকুরতার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক অনেক দিনের । একসঙ্গে স্টেজ শেয়ার করেছেন । শেষদিন পর্যন্ত পেয়েছেন বিরামহীন অনুপ্রেরণা । সম্পর্কটা ছিল অনেকটা মা-ছেলের । ETV ভারতের প্রতিনিধির মুখোমুখি হয়ে তাঁর রুমাদির স্মৃতিচারণায় নস্টালজিক হয়ে পড়লেন কল্যাণ সেন বরাট ।
রুমাদির সঙ্গে সম্পর্কের সূচনা
কল্যাণ সেন বরাটের কথায়, "রুমাদির অনুষ্ঠান শোনার পর এক মাসের মধ্যে আমি আসানসোলে ঐকতান নাম দিয়ে একটি কয়্যার করেছিলাম । তার সমস্তই রুমাদির গাওয়া গান । তখনও নিজের গান তৈরি হয়নি । আমি ওঁর গান গাইতাম । 1978-র শেষে কলকাতায় ফিরে আসি । পরের বছর তৈরি হয় ক্যালকাটা কয়্যার । অনেকের ধারণা আমি ক্যালকাটা ইয়ুথ কয়্যার থেকে কয়্যারে এসেছিলাম । তা কিন্তু নয় । আমি ক্যালকাটা ইয়ুথ কয়্যারে কখনই ছিলাম না । রুমাদির সঙ্গে আমার মা-ছেলের সম্পর্ক ছিল। আজ আমার মাতৃ বিয়োগ হল । একসঙ্গে অনেক অনুষ্ঠান করেছি । আমাকে এতটাই ভালবাসতেন রুমাদি । সব সময় অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন ।"
শিল্পী রুমা গুহঠাকুরতা
ক্যালকাটা কয়্যারের 50 বছরে কল্যাণ সেন বরাট ও রুমা গুহঠাকুরতা যৌথভাবে অনুষ্ঠান করেন । "আমাদের একটি দেশ" অনুষ্ঠানে কল্যাণ সেন বরাটের সুরে কণ্ঠ দিয়েছিলেন রুমা গুহঠাকুরতা । একে অপরের পরিপূরক ছিলেন বলা চলে । কল্যাণবাবু বলেন, "এমন সাবলীল অভিনয় খুব কম লোক করতে পারে । গানের মধ্যে যে অভিনয়ের প্রয়োজন হয়, সেটা রুমাদি ছাড়া আর কেউ জানত না ।"
তিনি আরও বলেন, "এমন শিল্পী আর কখনও হবে না । আলমোড়াতে নাচ শিখেছেন । খুব ভালো নৃত্যশিল্পী ছিলেন রুমাদি । সব চেয়ে বড় কথা তিনি ছিলেন শিল্পী সংগঠক । এটা খুব সহজ ব্যাপার নয় । ওঁকে মানুষ ভালোবাসত, শ্রদ্ধা করত । গণ সংস্কৃতি, জাতীয়তাবাদী গানে রুমা গুহঠাকুরতার অবদান অসামান্য । অনেক সময় আমাদের মধ্যে মনোমালিন্য হয়েছে । মনোমালিন্য তো তাঁর সঙ্গেই হয়, যার সঙ্গে সম্পর্ক মধুর থাকে । আজ মাথার উপর থেকে ছাতা সরে গেল । বড় একা হয়ে গেলাম । আমার আর কেউ রইল না । রুমাদি এবার কী করব ? জিজ্ঞেস করার লোক রইল না ।"
কিশোর কুমারের সঙ্গে কেমন ছিল রুমা গুহঠাকুরতার সম্পর্ক ?
কিশোর কুমারের প্রথম স্ত্রী ছিলেন । সম্পর্ক সাত বছরের বেশি টেকেনি । আলাদা হয়ে গেছিলেন তাঁরা । কল্যাণ সেন বরাট বলেন, "কখনও কিশোরদা ও রুমাদিকে একসঙ্গে দেখিনি । পৃথকভাবেই সারাজীবন দেখে এসেছি দুই শিল্পীকে । রুমাদির অনবদ্য ব্যক্তিত্ব ছিল । অত্যন্ত স্বাধীনচেতা ছিলেন । যা করেছিলেন ভেবেচিন্তেই করেছিলেন । পরবর্তীকালে অনেক ভালো ছিলেন রুমাদি । কিশোরদা, রুমাদির সম্পর্ক কোনওদিনই খারাপ হয়নি । একটা মানসিক সম্পর্ক থেকেই গেছিল ।"
শেষদিন পর্যন্ত অটুট ছিল অমিত ও রুমাদির সম্পর্ক
কিশোর কুমার ও রুমা গুহঠাকুরতার সন্তান অমিত কুমার । মা-ছেলের সম্পর্ক নিয়ে বলতে গিয়ে কল্যাণবাবু বলেন, "ওঁর কাছে আমরা চির কৃতজ্ঞ । শেষটা ও যেভাবে মাকে দেখেছে তা সকলের মনে রাখার মতো ।"
রুমা গুহঠাকুরতা প্রসঙ্গে উঠলেই সামনে আসে কিশোর কুমারের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের কথা । সামনে আসে তাঁর শিল্পীসত্ত্বা । কিন্তু, "সবকিছুর ঊর্ধ্বে রুমাদির ক্যালকাটা ইউথ কয়্যার । ক্যালকাটা ইউথ কয়্যার একটা ইতিহাস । এই ইতিহাসকে ধরে রাখতেই হবে ।" সবচেয়ে কাছের মানুষের প্রয়াণে আবেগঘন আর্তি কল্যাণবাবুর ।
এই সংক্রান্ত খবর : প্রয়াত রুমা গুহঠাকুরতা