কলকাতা, 26 জুলাই : সে দিনের সেই বিকেলটার কথা আজও ভুলতে পারেননি কেউ !
সালটা 1999৷ আগের দিনও বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা হয়েছিল 24 বছরের ছেলেটার ৷ খোঁজ নিয়েছিলেন বোনেদের ৷ কিন্তু, 21 মে বিকেল থেকে আর যোগাযোগ করা সম্ভব হচ্ছিল না ৷ বুকে একরাশ উদ্বেগ নিয়ে ছটফট করছিলেন বাবা কমলাকান্ত-মামা বিমানবিহারীরা ৷ ফোনের শব্দ শুনে আশায় মুখ জ্বলজ্বল করলেও, ক্ষণিকেই যেন তা মলিন হয়ে যাচ্ছিল মা পূর্ণিমার ৷ দু'চোখের পাতা এক করতে পারেনি বোনেরাও ৷
এ ভাবেই কেটে ছিল প্রায় মাস দুয়েক৷ 17 জুলাই, অবশেষে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরেছিলেন, কিন্তু, কফিন বন্দী হয়ে ৷ তেরঙ্গায় মোড়া দেহটা ঢেকে গেছিল তাজা ফুলে ৷
কণাদ ভট্টাচার্য ৷ কারগিল যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছিলেন 3/2 ডি বিটি রোডের এই যুবক ৷ ছেলের কফিন বন্দী দেহ আঁকড়ে ধরে যেন পাথর হয়ে গেছিলেন পূর্ণিমা ৷ সে দিনের কথা মনে পড়তেই আজও অস্পষ্ট স্বরে বলে ওঠেন, “তুই যে বাবা কথা দিয়েছিলি যুদ্ধ জিতে আমায় মেডেল এনে দিবি...৷"
দেখতে দেখতে কেটে গেছে কুড়িটা বছর ৷ পাড়া-প্রতিবেশীদের মন থেকে বিন্দুমাত্র মলিন হননি কণাদ ভট্টাচার্য ৷ ছোটো থেকে মামার বাড়িতেই বড় হয়েছিলেন ৷ এলাকাটা টালা বারোওয়ারি দুর্গাপুজো কমিটির এক্কেবারে পাশে । টালা ফ্রেন্ডস অ্যাসোসিয়েশনের মাঠে ক্যারাটে শিখতেন । ভালো ক্রিকেটও খেলতেন । কলকাতা ক্রিকেট লিগের প্রথম ডিভিশনের হয়ে মাঠে নামতেও দেখা গেছিল তাঁকে ৷ পাড়ার কেউ সমস্যায় পড়েছেন, কানে এলে সাহায্যের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তে বিন্দুমাত্র সময় নিতেন না কণাদ ৷
মাস দু'য়ের খবর না পাওয়ায় মনের মধ্যে কোথাও যেন কু-ডাকছিল ৷ যদিও আমল দিতে চাননি কেউই ৷ কিছু ভালো ঘটে, আশায় বুক বাঁধছিলেন সবাই ৷ কিন্তু, সেই আশা পূরণ হয়নি ৷ 15 জুলাইয়ের ফোনটা সব আশা ভেঙে দিয়েছিল ৷ সেনাবাহিনীর তরফে জানানো হয়েছিল, শহিদ হয়েছেন কণাদ ভট্টাচার্য ৷ দাবানলের মতো মুহূর্তে খবরটা ছড়িয়ে পড়েছিল ৷ বিমানবন্দরে কণাদের দেহ আনতে হাজির ছিলেন এলাকার মানুষজন থেকে রাজনৈতিক নেতারাও৷ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তখন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ৷ উপস্থিত ছিলেন তিনিও ৷
কুড়িটা বছর কেটে গেছে । কিন্তু সেদিনের স্মৃতি আজও বয়ে বেড়াচ্ছে টালা । সে দিনের সেই টিনের চালের ক্লাব ঘর এখন তিন তলা বিল্ডিং । এই ক্লাবেই ক্যারাটে শিখে ব্ল্যাক বেল্ট পেয়েছিলেন কণাদ । তাঁর স্মৃতিতে আজকের পাকা বিল্ডিংয়ের নাম দেওয়া হয়েছে কণাদ ভবন । ক্লাবের সামনে বসেছে আবক্ষ মূর্তি । ক্লাবের গ্রন্থাগারের নামও শহিদ কণাদের নামেই । টালা ব্রিজের উপরের বাস স্টপটাও তাঁর নামে, তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে । সম্পাদক অনুজিৎ নান বলছিলেন, “কণাদের জন্মদিন উপলক্ষ্যে আমরা রক্তদান শিবির করি । কোনও উপহার দেওয়া হয় না রক্তদাতাদের । নামটুকুই যথেষ্ট । একশোরও বেশি মানুষ সেই রক্তদান শিবিরের রক্ত দেন ।"
চোখের জলে আজও পাড়ার ছেলেটাকে সম্মান জানায় টালার মানুষজন ৷ কণাদের নামে আজও গর্ববোধ করে তারা ৷ সে দিন ছেলের কফিন বন্দী দেহ আঁকড়ে কমলাকান্ত ভট্টাচার্য বলেছিলেন, “কাঁদবেন না কেউ । ও দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছে । এ মৃত্যু গর্বের ।"
সত্যিই শহিদের গর্বে বুক বেঁধেছে টালার মানুষজন ৷