কলকাতা, 15 জুলাই : একাধিক টেস্টের রিপোর্ট বলছে, ক্যান্সার নয় । অথচ, মানতে চাইছেন না চিকিৎসকরা । কারণ, এভাবে অগ্ন্য়াশয়ের নিচের দিকে পচন ধরে জলভরা তালশাঁসের মতো হয়ে ওঠার বিষয়টি অ্যাকিউট প্যানক্রিয়াটাইটিস হতে পারে না । এরপর চলে আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা । যার জেরে, পাওয়া গেল অগ্ন্য়াশয়ের বিরল ক্যান্সারের খোঁজ । অবশেষে, অস্ত্রোপচার করে 69 বছরের বৃদ্ধাকে প্রাণে বাঁচালেন চিকিৎসকরা । ঘটনা কলকাতার ।
গত মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময় গড়িয়ার বাসিন্দা আরতি জানার পেটে অসহ্য যন্ত্রণা হতে শুরু করে । তাঁকে ভরতি করানো হয় বেসরকারি একটি হাসপাতালে । সেখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চিকিৎসকরা জানান ওষুধের মাধ্যমে সুস্থ হয়ে উঠবেন বৃদ্ধা । চলতে থাকে ওষুধ । এর মাস খানিক পরে ফের পেটে অসহ্য যন্ত্রণা শুরু হয় তাঁর । ওষুধে কাজ না হওয়ায় অন্য চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া হয় রোগীকে । আলট্রাসনোগ্রাফি এবং সিটি স্ক্যান করা হয় । এই দুই টেস্টের রিপোর্টে জানানো হয়, বৃদ্ধা অ্যাকিউট প্যানক্রিয়াটাইটিসে আক্রান্ত । দেখেশুনে, অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন বলে জানান চিকিৎসকরা । এই সময় অন্য এক চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া হয় । আলট্রাসনোগ্রাফি এবং সিটি স্ক্যানের রিপোর্ট দেখে সন্দেহ হয় তাঁর । এন্ডো- আলট্রাসনোগ্রাফি করানো হয়। এই টেস্টের রিপোর্টও বলে, ক্যান্সার নয় ।
মানতে নারাজ এই চিকিৎসক শুদ্ধসত্ত্ব সেন । তিনি বলেন, "পচে যাওয়া প্যানক্রিয়াসের নিচের অংশ জলভরা তালশাঁসের মতো হয়ে গিয়েছিল। এন্ডো-আল্ট্রাসনোগ্রাফির রিপোর্ট-ও বলল, এটা ক্যান্সার নয়, প্যানক্রিয়াসের পচন। রেডিওলজির তিনটি পরীক্ষায় ক্যান্সার বলা না হলেও, ফ্লুইড স্টাডিতে কিছু ক্যান্সার সেল মার্কারের খোঁজ পাওয়া গেছে । এটা অনেকটা বেশি হওয়ায় সন্দেহ প্রগাঢ় হল, এটা একটি সিস্টিক প্যানক্রিয়াটাইটিস টিউমার। এটা সাধারণ প্যানক্রিয়াস ক্যান্সারের মতো নয় ।"
এই সন্দেহের জেরে আবার একটি সিটি স্ক্যান করানো হয় । তাও সন্দেহ থেকে যায় । এরপর চিকিৎসকরা সিদ্ধান্ত নিলেন, প্যানক্রিয়াসে পচন এবং ক্যান্সার, এই দুটোই থাকতে পারে । আর, সমস্যা এখানেও । কারণ, এই দুই ক্ষেত্রের চিকিৎসা পুরোপুরি আলাদা । চিকিৎসক শুদ্ধসত্ত্ব সেন বলেন,"প্যানক্রিয়াসে পচন থাকলে নেক্রোসিস টিস্যুগুলি বাদ দিয়ে বাইপাস করে দেওয়া হবে । এর চিকিৎসা এখানেই শেষ । কিন্তু, যদি ক্যান্সার থাকে, তাহলে বাইপাস করলে অসম্পূর্ণ সার্জারি হবে । এবং ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা বেশি থাকবে । অনেক ভাবনা-চিন্তা, আলোচনা করে স্থির করা হয়, এই রোগীর স্প্লিন, প্যানক্রিয়াসের লেজের দিকের পচে যাওয়া অংশ, জলভরা তালশাঁসের মতো হয়ে ওঠা টিউমার, সব বাদ দেওয়া হবে অপারেশনের মাধ্যমে । এ দিকে, শেষের সিটি স্ক্যানের রিপোর্টে দেখা যায়, রক্তের প্রধান দুটি নালীকেই ধরে নিয়েছে টিউমার, প্রায় খেয়ে ফেলেছে ।"
তিনি বলেন, "এক্ষেত্রে আগেকার দিনে বলা হত অপারেশন সম্ভব নয় । এখনকার দিনে বেশিরভাগ সেন্টারেও এই অপারেশন সম্ভব নয় । কারণ, এর জন্য অ্যাডভান্সড প্রসিডিউর রয়েছে । এই অপারেশন খুব কঠিন, খুবই ক্রিটিক্যাল ছিল ।"
গত 24 জুন এই রোগীকে ভর্তি করানো হয় দক্ষিণ কলকাতায় অবস্থিত বেসরকারি একটি হাসপাতালে । সেখানে গত 26 জুন তাঁর অপারেশন করা হয় । এক সপ্তাহের মধ্যে রোগী সুস্থ হয়ে ওঠেন, হাসপাতাল থেকে বাড়িও ফিরে যান । এই রোগীর অপারেশনের সময় রক্তের প্রয়োজন পড়েনি, তাঁকে ICU কিংবা, ভেন্টিলেটরের সাপোর্টেও রাখার প্রয়োজন পড়েনি । এমনকী যেখানে 15-20 দিন পরে হাসপাতাল থেকে বাড়িতে ফেরেন রোগী, সেখানে এই ছয় দিনের মধ্যে হাসপাতাল থেকে বাড়িতে যাওয়ার ছাড়পত্র পেয়ে যান রোগী ।
চিকিৎসক শুদ্ধসত্ত্ব সেন বলেন,"কয়েক দিন আগে এই রোগীর বায়োপসি রিপোর্ট এসেছে। এই রিপোর্টে দেখা গিয়েছে আমাদের সন্দেহ সঠিক ছিল । এটা অ্যাকিউট প্যানক্রিয়াটাইটিস ছিল না, এটা ক্যান্সার ছিল । প্যানক্রিয়াসে পচন এবং ক্যান্সার, দুই-ই ছিল ।"
রোগীর ছেলে অভিষেক জানা বলেন, "গত মার্চের মাঝামাঝি সময় আচমকা মায়ের পেটে অসহ্য যন্ত্রণা শুরু হয় । বেসরকারি একটি হাসপাতালে চিকিৎসা শুরু হয় । সিটি স্ক্যান করে দেখা হয় প্যানক্রিয়াসে সিস্টের মতো রয়েছে । ওষুধ চলতে থাকে । এক মাস পরে আবার একই ধরনের সমস্যা দেখা দেয় । আমরা খুব লাকি যে, লকডাউনের মতো এই রকম এক টাফ সিচুয়েশনে আমরা চিকিৎসকের কাছে পৌঁছতে পেরেছি। আমরা যদি চিকিৎসকের কাছে না পৌঁছতাম, তা হলে ক্যানসার আরও ছড়িয়ে পড়ত। অপারেশনর পরে মা এখন ভালো আছেন ।"
চিকিৎসক শুদ্ধসত্ত্ব সেন বলেন, "এই যে প্যানক্রিয়াটিক নেক্রোসিস, অ্যাকিউট প্যানক্রিয়াটাইটিসের দিকে এটা একটা বিনাইন রোগ । আর, IPMN হল রেয়ার সিস্টিক প্যানক্রিয়াটিক ক্যানসার । সাধারণত এই দুটির কম্বিনেশন হয় না । হতে পারে IPMN প্যানক্রিয়াটাইটিস হল, কিন্তু সেটা সাধারণত মাথার দিকে হয়, লেজের দিকে ওই রকম নেক্রোসিস ক্যাভিটির মতো হয় না । এই রোগীর ক্ষেত্রে IPMN উইথ প্যানক্রিয়াটাইটিস অ্যান্ড নেক্রোসিস হয়েছিল । এটা বিরল ঘটনা । অপারেশন না হলে অথবা, প্যানক্রিয়াসের পচন ভেবে বাইপাস অপারেশন হলে ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়ত, এই রোগীকে বাঁচানো সম্ভব হত না । এই রোগী এখন ভালো আছেন । এই রোগীর ক্ষেত্রে আগামী দিনে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠার সম্ভাবনাও রয়েছে ।"