চন্দননগর, 12 জুলাই : করোনা পরিস্থিতিতে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে বাঙালির সবচেয়ে বড় উৎসব, দুর্গোৎসব । করোনার প্রথম ঢেউয়ে গত বছর দুর্গাপুজো অনেকটাই ধাক্কা খেয়েছিল । গোটা রাজ্যে জেলায় জেলায় করোনাবিধি মেনে কোনওক্রমে পুজো করেছিল কমিটিগুলি । সেই একই অবস্থা হয়েছিল চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পুজোতেও । এবার পরিস্থিতি আরও ঘোরালো ৷ করোনার তৃতীয় ঢেউয়ের সম্ভাবনা রয়েছে ৷ ফলে বারোয়ারি পুজোগুলি হবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে ৷
অন্যান্য বছরগুলিতে এই সময়টায় চন্দননগরের কুমোরপাড়ায় আনাগোনা লেগে থাকে পুজো উদ্যোক্তাদের ৷ কিন্তু এবছর আর সেই দৃশ্য দেখা যাচ্ছে না । ফলে কঠিন সমস্যার মধ্যে পড়েছে চন্দননগর কুমোর পাড়ার মৃৎশিল্পীরা । হুগলি জেলায় কয়েক হাজার মৃৎশিল্পী প্রতিমা তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করে । জেলা জুড়ে শ্রীরামপুর, চন্দননগর, চুঁচুড়া, মগরা সহ শতাধিক ঠাকুর তৈরির গোলা আছে ।বর্তমান পরিস্থিতিতে গতবারই বহু প্রতিমা তৈরি করা অবস্থায় পড়ে আছে বিভিন্ন গোলায় । এবছর তৃতীয় ঢেউয়ের কথা ভেবে প্রতিমার অর্ডার দিতে ভয় পাচ্ছেন অনেকেই ৷
তাই দিশাহীন অবস্থা মৃৎশিল্পীদের । অনেকেই পেশা বদলে রাজমিস্ত্রির কাজ, মাছ ও সবজি বিক্রি করছেন । অনেকে নিজের ঠাকুরের গোলা বন্ধ করে দিয়ে অন্যের ঠাকুর তৈরি করেছে । নিজেদের সংসার বাঁচাতে তাই খড়কুটো আঁকড়ে ধরে বাঁচার চেষ্টা করছে সকলে । তার মধ্যেও যাদের আর কোন উপায় নেই তাঁরা ঝুঁকি নিয়েই ঠাকুর তৈরির হাত লাগিয়েছে । আর আর্থিক মন্দার মধ্যে দুশ্চিন্তায় দিন গুনছেন তারা । গতবারই চন্দননগরের সাতটি পুজাে কমিটি ঘট পুজো করেছিল ৷ করোনার দাপটে এ বছরেও যদি আবারও ঘট পুজো হয় তাহলে সমস্যায় পড়ে যাবেন চন্দননগরে কুমোর পাড়ার শিল্পীরা ।
আরও পড়ুন, Durga Puja : কোভিড আবহেই খুঁটিপুজো হাওড়ার সদানন্দ স্মৃতি সংঘে
পরিস্থিতি দেখে মাথায় হাজারো দুশ্চিন্তা ৷ মৃৎশিল্পী সঞ্জয় পাল বলেছেন, "এবারের পরিস্থিতি আরও খারাপ । আমাদের পক্ষে দুর্গা বা জগদ্ধাত্রী প্রতিমার বায়না করতে কেউ আসছেন না । দড়ি, খড়, মাটি সমস্ত জিনিসের দাম বেড়েছে । কুমোরপাড়ায় মাটির জন্য হাহাকার করছে শিল্পীরা । নিজেরা ঝুঁকি নিয়ে একটু আধটু মূর্তির কাজ করছি । ঠাকুর বিক্রি হবে কিনা তাও জানি না আমরা । এটাই আমাদের রুজি-রোজগার যদি পুজোর না হলে আমরা ভেঙে পড়ছি ।"
আরও এক শিল্পী বাপি পাল বলেন, "ট্রেন সেভাবে চলছে না বলেই কর্মচারীরা কাজে আসতে পারছে না । এই ঠাকুরের গোলাগুলিতে প্রথমদিকে ঠাকুরের কাজ চালু হলেও মাটির সমস্যার কারণে সবকিছুই বন্ধ হয়ে পড়ে আছে। মাটি না পেলে কাজ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে । সরকারি তরফে করোনার বিধিনিষেধ হবে সেটাও বুঝতে পারছে না । কোনওভাবেই পুজো কমিটি দেখা করে গেলেও তারাও সঠিকভাবে কিছু বলতে পারছেন না । আমার নিজস্ব ঠাকুরের তৈরির কারখানা আছে । সেখানে কোনও কাজই আসছে না বলে অন্য গোলায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করছি ।"
অন্য এক মৃৎশিল্পী জগন্নাথ পাল বলেন, "এ বছরে কোনও পুজো উদ্যোক্তারা আসেনি । অন্য কোনও উপায় নেই আমাদের । কয়েকটা ঠাকুর করে রাখছি মাত্র । চন্দননগরেরই জ্যোতির মোড়ে সবচেয়ে বড় ঠাকুর করি আমি । কিন্তু এ বছরে জগদ্ধাত্রী পুজো নিয়ে কোনও আলোচনাই নেই । আমার কারখানাতে 10 থেকে 12 জন ছেলে কাজ করত । কিন্তু এখন কেউ রাজমিস্ত্রির কাজ করছে, কেউ সবজি বিক্রি করছে । করোনা পরিস্থিতির আগে কারখানা থেকেই দেড় লাখ থেকে দু লাখ টাকা পর্যন্ত ঠাকুর বিক্রি হত । এখন সেই ঠাকুর বিক্রি কমে হয়ে গিয়েছে 15 হাজার টাকায় । এর ফলে সমস্ত জিনিসপত্র কিনে লাভ করা খুব শক্ত হয়ে যাবে । আগামী দিনে মৃৎশিল্পী থাকবে কি না সেটাও সন্দেহ আছে । এই পরিস্থিতিতে সবাই যেমন অন্য পেশায় চলে যাচ্ছে । আমাদেরও বাধ্য হয়ে অন্য কাজ করতে হবে ।"