আসানসোল, 25 জানুয়ারি: ইংরেজি মাধ্যমকে টেক্কা দিতে এবার সরকারি বাংলা মিডিয়াম স্কুলে চলছে বিদেশি ধাঁচের শিক্ষা ৷ আনন্দের সঙ্গে খেলাধুলো, গানবাজনার সঙ্গে পড়াশুনো করছে ছাত্রছাত্রীরা ৷ একদম অন্যরকমের এই ভাবনা জামুড়িয়া নামোপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের । এখানকার প্রধান শিক্ষক 'রাস্তার মাস্টার' নামে পরিচিত দীপ নারায়ণ নায়ক এমন নতুন উদ্যোগ নিয়েছেন স্কুলে । এর ফলে স্কুলছুটরা আবারও ফিরে আসছে স্কুলে বলে দাবি তাঁর ৷
সরকারি মাধ্যম স্কুলে পড়াশুনো নিয়ে "গেল-গেল" রব উঠেছে । রাজ্যে বহু স্কুল বন্ধ হওয়ার তালিকায় । বহু স্কুল ছাত্র-ছাত্রীর অভাবে ধুঁকছে । যাঁরা একটু মধ্যবিত্ত, তাঁরা কষ্টসৃষ্টে হলেও নিজের ছেলেমেয়েকে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়াচ্ছেন । একটাই উদ্দেশ্য পঠন-পাঠনে ছেলেমেয়েরা যেন বড় হয়ে ওঠে । ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের স্মার্ট ক্লাস থেকে শুরু করে শিক্ষাপদ্ধতি, সময়ানুবর্তিতা সবকিছু নিয়েই ছাত্র-ছাত্রীরা আলাদা উৎসাহ পায় স্কুলে যাওয়ার জন্য । সে তুলনায় গ্রামে গ্রামে যে সমস্ত স্কুল চলছে, তাতে শিক্ষকেরা তাঁদের মতো, ছাত্র-ছাত্রীরা নিজেদের মতো সময় কাটিয়ে বাড়ি চলে যায় বলেই অভিযোগ । পড়াশুনোর বালাই নেই ।
এবার সেখান থেকেই একদম অন্যরকমের ভাবনা । সরকারি স্কুলে বিদেশি শিক্ষার আদলে শিক্ষায় এমন পরিবর্তন নিয়ে এলেন প্রধান শিক্ষক ৷ যার জন্য এবার স্কুলছুটরাও ফিরে আসছে স্কুলে । শুধু তাই নয়, প্রতিদিন হাজিরা খাতায় ছাত্রছাত্রীদের উপস্থিতির হার বাড়ছে জামুড়িয়া নামোপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ।
স্কুলের প্রধান শিক্ষক দীপ নারায়ণ নায়ক তাঁর অভিনব থ্রি জেনারেশন শিক্ষা পদ্ধতির জন্য তিনি ফিনল্যান্ডের হেলসিংকিতে ডাক পেয়েছিলেন সংবর্ধনা নেওয়ার । শিক্ষার রাজধানী বলে পরিচিত ফিনল্যান্ডে গিয়ে তিনি দেখলেন, সেখানকার শিক্ষা পদ্ধতি একেবারেই অন্যরকম এবং তিনি উৎসাহ প্রকাশ করে সেখানকার স্কুল-কলেজ ইউনিভার্সিটিতে পরিদর্শনে যান । পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দেখেন কীভাবে পড়াশোনা করানো হচ্ছে সেখানকার ছাত্রছাত্রীদের । আর তারপর নিজে ফিরে এসে সরকারি স্কুলে সেই শিক্ষা পদ্ধতি প্রয়োগ করছেন দীপনারায়ণ ।
কী সেই শিক্ষা পদ্ধতি?
দীপ নারায়ণ নায়ক ইটিভি ভারতকে বলেন, "আমি ফিনল্যান্ডে গিয়ে দেখতে পাই প্রত্যেকটি ছাত্রছাত্রীকে আলাদা করে নজর দেওয়া হয় । শুধু তাই নয়, সেখানে পড়াশোনা করা হয় আনন্দের সঙ্গে । যাকে বলা হয় হ্যাপি লার্নিং । সেখানে বিভিন্ন মডেল সহযোগে পড়াশোনা করা হয় । যেমন ধরুন আমাদের ছাত্রছাত্রীরা জানে মা কেন জল হাতে বিদ্যুৎ সুইচে হাত দিলে সেখানে কারেন্ট মারে । পানীয় জল নষ্ট হয়ে পড়ে যাচ্ছে টাইমকলে । কিন্তু ছাত্রছাত্রীরা সচেতন নয় । আর তাই বিদেশি শিক্ষায় অনুপ্রাণিত হয়ে মডেল সহযোগে হাতে কলমে শিক্ষা শিখছে । আমাদের ক্লাস ফাইভের ছাত্রছাত্রীরা এখন সুইচ বোর্ডে সুইচ লাগাতে জানে । প্লাম্বিংয়ের কাজ জানে । আরও কত কী শিখছে তারা ।"
'রাস্তার মাস্টার'-এর দাবি, এর ফলে স্কুল ছুট ছাত্রছাত্রীরা ফিরে আসছে । যারা নিয়মিত ক্লাস করত না তারাও এখন রোজ স্কুলে আসছে । তারা এখন আনন্দের সঙ্গে খেলাধূলা, গানবাজনার পাশাপাশি পড়াশুনো করছে । প্রধান শিক্ষক দীপ নারায়ণ নায়কের দাবি যে অমূলক নয় তা তার স্কুলে গিয়েই বোঝা গেল । ছাত্রছাত্রীরা বেশ আনন্দে মেতে উঠেছে খেলাধূলা, গান বাজনা ও পড়াশোনায় ।
জামুড়িয়া নামোপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রী ঐন্দ্রি বন্দ্যোপাধ্যায় ও অন্বেষা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, "আমরা নিজে হাতের কাজ তৈরি করি । কাগজের নৌকো বানাই, ফুল বানাই । এখানে আমরা খেলাধূলা করি, গান-বাজনা করি । খুব আনন্দ পাই । রোজ স্কুলে আসি এখন । যে বন্ধুরা স্কুলে আসত না, তারাও ফিরে আসছে ।"
জামুড়িয়া নামোপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছেন এলাকাবাসী থেকে অভিভাবকরা ৷ স্থানীয় বাসিন্দা বামপদ মুখোপাধ্যায় বলেন, "এই স্কুলের নতুন শিক্ষা পদ্ধতিতে ছাত্রছাত্রীরা খুব আনন্দিত । শুধু ছাত্রছাত্রীরা নয়, অভিভাবকরাও খুব আনন্দিত । তারা রোজ তাদের ঘরের বাচ্চাকে স্কুলে পাঠাচ্ছে । শুধু তাই নয়, বাচ্চারা নিজেরাই স্কুলে ফিরে আসছে ।"
অন্য স্কুলকে দিশা দেখাবে দীপ নারায়ণের এই মডেল বলে আশাবাদী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জামুড়িয়া চক্রের স্কুল পরিদর্শক অরিজিৎ মণ্ডল ৷ তিনি বলেন, "জামুড়িয়া নামোপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যে শিক্ষা পদ্ধতি চালু হয়েছে তা অত্যন্ত বাস্তবসম্মত এবং এর ফলে ছাত্রছাত্রীরা নতুন করে স্কুলে ফিরে আসার উৎসাহ পাচ্ছে । এই শিক্ষা মডেলকে অন্যান্য স্কুলেও যাতে চালু করা যায় সে বিষয়ে আমরা চেষ্টা করব ।"