গঙ্গারামপুর, 15 ডিসেম্বর: রাস্তায় আটকে ঘুষ চেয়েছিল পুলিশ ৷ এক’দু টাকা নয় ৷ 1 লাখ 20 হাজার টাকা ৷ অভিযোগ, কর্নেল কিস্কু নামে ওই ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ব্রাউন সুগারের পুরিয়া পেয়েছিল পুলিশ ৷ পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে নাকি 72 হাজার টাকা তাদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন ওই ব্যবসায়ী ৷ বাকি টাকা একদিন পরে দেওয়া হবে সেই শর্তে 33 বছরের ওই ব্যবসায়ীকে বাড়ি যেতে দিয়েছিল ৷ কিন্তু অভিযোগ, খাকি উর্দির সেই চাপ সহ্য করতে পারেননি কর্নেল ৷ বাড়ি ফিরেই শোওয়ার ঘরে আত্মঘাতী হন তিনি ৷ এই ঘটনা নিয়ে বুধবার থেকেই উত্তপ্ত দক্ষিণ দিনাজপুরের গঙ্গারামপুর থানার নন্দনপুর গ্রাম (Gangarampur Businessman Death) ৷
অভিযুক্ত পুলিশ অফিসারের নাম তাপস রায় ৷ তাঁকে ইতিমধ্যেই সাসপেন্ড করা হয়েছে (Police suspended in Gangarampur) ৷ জেলা পুলিশ সুপার রাহুল দে’র নির্দেশে তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্তও শুরু হয়েছে ৷ গঙ্গারামপুর মহকুমা পুলিশ আধিকারিক দীপাঞ্জন ভট্টাচার্য এই প্রসঙ্গে বলেন, “এই ঘটনায় এক পুলিশকর্মীকে সাসপেন্ড করা হয়েছে ৷ গোটা ঘটনার বিভাগীয় তদন্ত শুরু হয়েছে ৷”
পঞ্চায়েত ভোটের আগে এই ঘটনায় লেগেছে রাজনীতির রঙ ৷ বুধবার আত্মঘাতী কর্নেলের বাড়িতে যান এলাকার বিজেপি বিধায়ক সত্যেন্দ্রনাথ রায় ৷ দলের রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারের জেলায় ঘটে যাওয়া এই ঘটনা নিয়ে গেরুয়া শিবির যে অন্যরকম কিছু ভাবছে, তা বিধায়কের শরীরী ভাষাতেই পরিষ্কার ৷
জানা গিয়েছে, আদিবাসী কর্নেল কিস্কু সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলে ৷ তাঁর বাবা ছিলেন শিক্ষক ৷ কয়েকবছর আগে তিনি প্রয়াত হয়েছেন ৷ মা চিত্রা মার্ডি ছিলেন পেশায় নার্স ৷ বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত ৷ দুটি বিয়ে করেছিলেন কর্নেল ৷ প্রথম স্ত্রী গুরুতর অসুস্থ হয়ে বাবার বাড়িতে চলে গিয়েছিলেন ৷ তাঁর 12 বছরের ছেলে বাবার কাছেই থাকত৷ স্ত্রী আর ফিরে আসেননি ৷ ছেলের কথা ভেবে দ্বিতীয় বিয়ে করেছিলেন তিনি ৷ মঙ্গলবার তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রীও বাবার বাড়িতে ছিলেন ৷ পাশাপাশি মুর্শিদাবাদের ফরাক্কাতেও কর্নেল কিস্কুর একটি বাড়ি রয়েছে ৷ মায়ের পোস্ট অফিস সংক্রান্ত কাজে মঙ্গলবার ফরাক্কার বাড়িতে গিয়েছিলেন তিনি ৷ চারচাকা গাড়িতে সেখান থেকে বাড়ি ফিরছিলেন ৷ দক্ষিণ দিনাজপুরের ঠ্যাঙাপাড়ায় তাঁর পথ আটকায় পুলিশ ৷ সেখানেই তাঁর মোটরবাইক রাখা ছিল ৷ তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় বংশীহারী থানায় ৷ সেখানে তাঁর কাছ থেকে ব্রাউন সুগারের পুরিয়া উদ্ধার হয় ৷ এর জন্য মোটা টাকা দাবি করেন এক পুলিশ অফিসার ৷ তেমনটাই অভিযোগ মৃতের মায়ের ৷ তাঁর দাবি, পুলিশ তাঁর ছেলের কাছে এক লাখ 20 হাজার টাকা দাবি করেছিল ৷ ছেলের কাছ থেকে রাতে 72 হাজার পুলিশ নিয়েও নেয় ৷ একদিনের মধ্যে বাকি টাকা দেওয়ার শর্তে পুলিশ তাঁর ছেলেকে বাড়ি আসার অনুমতি দেয় ৷
আরও পড়ুন: ঘুষের জন্য পুলিশের চাপ, আত্মঘাতী গঙ্গারামপুরের ব্যবসায়ী
বুধবার সকালে কর্নেল কিস্কুর ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার হতেই এলাকা জুড়ে তীব্র উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে৷ খবর পেয়ে গঙ্গারামপুর থানার পুলিশ মৃতদেহ উদ্ধার করতে গেলে পুলিশকর্মীদের ঘিরে বিক্ষোভ দেখান গ্রামবাসীরা ৷ পরিস্থিতি বেগতিক দেখে আইসি শান্তনু মৈত্রের নেতৃত্বে বিশাল পুলিশ বাহিনী গ্রামে ছুটে যায় ৷ বাহিনী নিয়ে ঘটনাস্থলে চলে আসেন বংশীহারী থানার আইসি মনোজিৎ সরকারও ৷ আসেন গঙ্গারামপুর মহকুমা পুলিশ আধিকারিক দীপাঞ্জন ভট্টাচার্য ৷ বিধায়ক সত্যেন্দ্রনাথ রায় ও পুলিশকর্তাদের সঙ্গে কর্নেল পরিবারের দীর্ঘ আলোচনা হয় ৷
মৃতের মা চিত্রা মার্ডি বলেন,“আমি ফরাক্কায় কাজ করতাম ৷ ওখানে বাড়ি, চারচাকার গাড়ি-সহ আমাদের অনেক কিছু আছে ৷ সেসব দেখতেই ছেলে সেখানে গিয়েছিল৷ পোস্ট অফিসে আমার কিছু টাকা রয়েছে ৷ সেখান থেকে বারবার ফোন আসছিল ৷ তাই ছেলেকে বলি, সেই কাজটাও করে আসতে ৷ ছেলের সঙ্গে আমার কাজের লোকও ফরাক্কায় গিয়েছিল ৷ একটি ছোট গাড়ি ভাড়া নিয়ে ওরা ফরাক্কা গিয়েছিল ৷ ফরাক্কা ব্যারেজে কাজ চলায় পোস্ট অফিস পৌঁছোতে ওদের দেরি হয়ে যায় ৷ তবুও সেখানকার কাজ করতে পেরেছিল৷ আমার ছেলে ব্রাউন সুগারের নেশা করে ৷ গতকাল বাড়ি ফেরার সময় হয়তো ও ব্রাউন সুগার খেয়েছিল ৷ ওর বন্ধুরা ওর কাছ থেকেই ব্রাউন সুগার নিয়ে খেত৷ ওই বন্ধুরাই পুলিশকে ওর গাড়ি ধরার জন্য খবর দিয়েছিল ৷ যতদূর মনে হয়, পুলিশেরও এর মধ্যে কমিশন ছিল৷ এত ভাগ বাটোয়ারা করে খাওয়ার কথা ভেবেছিল ওরা৷ ঠ্যাঙাপাড়া থেকে ছেলে বাইক নিয়ে বাড়ির রাস্তা ধরে ৷ পিছন থেকে তাড়া করে পুলিশ ওকে আটকায়৷ ওর কাছ থেকে পুলিশ দুটো অথবা তিনটে ব্রাউন সুগারের পুরিয়া পেয়েছিল ৷ এরপর ছেলে, কাজের লোক, গাড়ির চালক, চারচাকার গাড়ি, এমনকি ছেলের মোটরবাইকটাও পুলিশ গঙ্গারামপুর থানায় নিয়ে যায় ৷ রাত 11টা থেকে রাত 2টো পর্যন্ত ওদের থানায় রাখা হয় ৷ ছেলের কাছে তখন 21 হাজার টাকা ছিল ৷ সেই টাকা পুলিশ নিয়ে নেয় ৷
পুলিশ তখনই আরও 50 হাজার টাকা চায় ৷ ছেলের কাছে নগদ টাকা ছিল না৷ তখন পুলিশই ছেলেকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে ওর এটিএম কার্ড দিয়ে 50 হাজার টাকা তোলায়৷ এরপর ওরা টোটো ভাড়া করে বাড়ি আসে ৷ বাড়ি ফিরে টোটো ভাড়া আমাকে দিতে বলে ৷ আমার সন্দেহ হলেও কিছু বলিনি ৷ ছেলে নিজের ঘরে ঢুকে যায় ৷ কাজের ছেলে কিংবা গাড়ির চালক আমাকে তখনও গোটা ঘটনা জানায়নি ৷ আমরা তখন বাড়ির বারান্দাতেই বসে ছিলাম ৷ ছেলে ঘরে ঢুকে অনেক জোরে টিভি চালিয়ে দেয় ৷ একা থাকলে ও দরজা বন্ধ করেই ঘুমোয় ৷ কিন্তু সকাল হলেও ও দরজা না খোলায় আমার সন্দেহ হয় ৷ জানালা দিয়ে দেখি, ছেলে ঘরের ভিতর ঝুলছে ৷ তখন গাড়ির চালক আর কাজের ছেলে সব কথা খুলে বলে ৷ পুলিশ ওর কাছে এক লাখ ২০ হাজার টাকা দাবি করেছিল ৷ পুলিশের চাপেই আমার ছেলে আত্মহত্যা করেছে ৷ টাকার জন্য পুলিশের এত চাপ আমার ছেলে সহ্য করতে পারেনি ৷ গতকাল আমি পুলিশকে ছেলের মৃতদেহ নিয়ে যেতে বাধা দিই ৷ যে অফিসার আমার ছেলেকে টাকার চাপ দিয়েছিল, আমি তাকে দেখতে চেয়েছিলাম ৷ আমার ছেলে ব্রাউন সুগার খাওয়ার জন্য পুলিশ এত টাকা দাবি করেছে ৷ আর যারা এসব জিনিসের ব্যবসা করছে, তাদের পুলিশ কিছু করে না ৷ পুলিশও এখানে ব্রাউন সুগার খায়৷ ছেলেই আমাকে বলেছিল৷ গতকাল পুলিশ 72 হাজার টাকা আর গাড়ি ফেরত দিয়ে গিয়েছে৷ আমার একটাই ছেলে ছিল ৷ পুলিশের জন্য ও চলে গেল৷ এবার আমাকে কে দেখবে? আমি সুবিচার চাইছি ৷”
অন্যদিকে, কর্নেলবাবুর স্ত্রী কায়েম টুডু বলেন,“আমার স্বামীর বন্ধুরাই পুলিশে খবর দিয়েছিল ৷ ঠ্যাঙাপাড়ায় আমার স্বামীর মোটরবাইক রাখা ছিল ৷ সেখান থেকে বাইক চালিয়ে ও বাড়ি ফিরছিল ৷ তাড়া করে গঙ্গারামপুর থানার পুলিশ ওকে ধরে ৷ ওই থানার পুলিশ অফিসার তাপস রায় আমার স্বামীর উপর মানসিক অত্যাচার চালায়৷ ওর কাছ থেকে 72 হাজার টাকা নেয় ৷ একদিনের মধ্যে বাকি 50 হাজার টাকা দেওয়ার চাপ দেয় ৷ নইলে দেখে নেওয়ার হুমকি দেয় ৷ ব্রাউন সুগার খাওয়ার জন্য পুলিশ ওকে ধরে অভিভাবকদের খবর দিল না কেন ? ওর বিরুদ্ধে মামলা করল না কেন ?”