শুশুনিয়া, 4 সেপ্টেম্বর : শুশুনিয়া পাহাড়ের পাশেই রয়েছে ছোট্ট একটি গ্রাম, হাপানিয়া । এই গ্রামেই রয়েছে মারাংবুরু চাচো মার্শাল আশ্রম । নামে আশ্রম হলেও আসলে এটি কোনও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নয় । এটা আসলে একটা আবাসিক স্কুল । প্রচারের আড়ালে বাঁকুড়ার শুশুনিয়ায় গরিব দুস্থ আদিবাসী পড়ুয়াদের জন্য নিখরচায় এই আবাসিক স্কুল প্রায় দুই দশক ধরে চালিয়ে যাচ্ছেন বাবুনাথ টুডু । পেশায় প্রাথমিক শিক্ষক ৷
আশ্রমের যাত্রা শুরু 2001 সাল থেকে ৷ আশ্রম বলতে গোটা চারেক কাঁচা খড়ের ছাউনি দেওয়া বাড়ি । দরজা পর্যন্ত নেই । এখানেই বাবুনাথবাবু তাঁর স্ত্রী লক্ষ্মী টুডুকে সঙ্গে নিয়ে চালিয়ে যাচ্ছেন স্কুল ৷ রাজ্যের বিভিন্ন জেলার আদিবাসী গরিব পরিবারের ছেলে-মেয়েরা আবাসিক শিক্ষা পেয়ে থাকে এখানে । সেটাও আবার সম্পূর্ণ নিখরচায় । শুধু এরাজ্য নয়, ঝাড়খণ্ডেরও কয়েকজন পড়ুয়া রয়েছে এখানে । সব মিলিয়ে 83 জন আবাসিক ছাত্র-ছাত্রী এখানে থাকে ৷ এছাড়া 18 জন ছাত্র-ছাত্রী রয়েছে যারা স্থানীয় বা অনাবাসিক । মূলত প্রাথমিক স্তর থেকে এখানে পড়ানো হয় । সকালের জলখাবার থেকে শুরু করে মধ্যাহ্নভোজন, বিকেলের টিফিন এবং নৈশভোজ... সবকিছুরই ব্যবস্থা রয়েছে এখানে ৷
কী কারণে এই আবাসিক স্কুল শুরু করলেন বাবুনাথ টুডু ?
তিনি জানান, পড়াশোনার ক্ষেত্রে আদিবাসী ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে ভাষা সমস্যা একটি বড় সমস্যা । তিনি নিজের ব্যক্তিগত জীবনে এই সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন । নিজে ছোটোবেলা থেকে বাংলা মাধ্যমে পড়াশোনা করেছেন বটে, তবে গোটাটাই ছিল মুখস্থ বিদ্যা । এককথায়, কোনও কিছুর মানে না বুঝেই বুলি আওড়ে যাওয়া । যা তিনি পরবর্তীকালে বুঝতে পারেন । তাই একদিকে যেমন স্কুলছুট ও দিনমজুর পরিবারের ছেলে-মেয়েদের শিক্ষার আঙিনায় আনার লক্ষ্য ছিল তাঁর, পাশাপাশি লক্ষ্য ছিল মাতৃভাষায় শিক্ষা দেওয়া । যে কারণে এই স্কুলে তিনি অলচিকি হরফে পড়ান ছাত্রছাত্রীদের । পাশাপাশি বাংলা এবং ইংরাজি ভাষাও শেখানো হয় এইসব পড়ুয়াকে ।
তাঁর এই কর্মকাণ্ডে আজ তিনি একা নন । তাঁকে সর্বতোভাবে সহযোগিতা করে চলেছেন তাঁর স্ত্রী লক্ষ্মী টুডু । লক্ষ্মী টুডুর আক্ষেপ, সরকারের কাছে সহযোগিতার আবেদন করা হয়েছে। কিন্তু তার কোনও ফল মেলেনি । কম করে এইসব দুস্থ ছাত্র-ছাত্রীর জন্য যদি প্রশাসনিকভাবে মাথার ওপর পাকা ছাদের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয় তাহলে সমস্যার অনেকটাই সমাধান হয় ।
হাপানিয়ার এই মারাংবুরু চাচো মার্শাল আশ্রমে স্বপ্ন বুনছে অনেক খুদে ৷ কেউ স্বপ্ন দেখছে ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার... কেউবা পাইলট ৷ আর নিঃশব্দে এদের স্বপ্নকে পথ দেখিয়ে যাচ্ছেন বাবুনাথ টুডু ৷
কিন্তু কীভাবে চলে এই আশ্রম ?
বাবুনাথ টুডু জানালেন, কিছু অভিভাবক রয়েছেন যাঁরা নিজেদের সাধ্যমতো সামান্য কিছু আর্থিক সাহায্য করেন। বাকিটা বিভিন্ন শুভানুধ্যায়ীর দানের উপর ভরসা করতে হয় । এরপর যেটুকু ঘাটতি থাকে তা নিজের রোজগারের অর্থ দিয়ে চালিয়ে যাচ্ছেন এই আশ্রম।
এই আশ্রমে অনেকেই অর্থ অথবা প্রয়োজনীয় সামগ্রী দান করেন । তাঁরাও জড়িয়ে পড়েন এই আশ্রমের কচিকাঁচাদের ভালোবাসায়। পারিবারিক অনুষ্ঠানের সময় অনেকেই তা উপভোগ করতে ছুটে আসেন এই সমস্ত বাচ্চার কাছে। দিনভর তাদের সঙ্গে আনন্দ ভাগ করে নেন ।