হায়দরাবাদ: ‘লিও’ ৷ লাতিন শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ সিংহ, পশুরাজ ৷ অর্থাৎ, যিনি রাজা ৷ যিনি নেতৃত্ব দেন সামনে থেকে, আগলে রাখেন বাকিদের ৷ ব্যক্তিগত সাফল্য আকাশ ছুঁলেও যার পা আটকে থাকে মাটিতেই ৷ যেরকম লিওনেল আন্দ্রেস মেসি ৷ বাহ্যিক রূপে অবশ্য কোনওভাবেই মেসিকে সিংহ বলা চলে না ৷ আপাত শান্ত, নিরিহ মহাতারকা যেন প্রাজ্ঞ, বিচক্ষণতার প্রতিভূ ৷ যিনি মাঠে অকারণ তান্ডব নন, নিজের জাদুকাঠিতে সবুজ গালিচায় আল্পনা আঁকায় বেশি বিশ্বাসী ৷ গতি নয়, শিল্পে বিধ্বস্ত করেন প্রতিপক্ষকে ৷ যার ধ্বংসলীলা চোখকে আরাম দেয় ৷ যার খেলোয়াড়ী শৈলীতে বুঁদ হয়ে তাঁকে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে বসিয়েছে ইউরোপও।
ইউরোপের দলের বিরুদ্ধে যেকোনও খেলাই লাতিন আমেরিকার কাছে সংগ্রাম ৷ অত্যাচারী শাসকের দম্ভের বিরুদ্ধে বসন্তের একটুকরো হাওয়া নিয়ে আসার লড়াই ৷ আর ধনকুবের ইউরোপীয়ানদের সেই লড়াইয়ে পরাস্ত করার আনন্দ ? সে তো ‘ফকল্যান্ডের যুদ্ধে হেরে, ইংল্যান্ডকে দিল মেরে’র মতোই আবেগের ৷ সেই উল্লাস ‘শোধবোধ অস্ত্রবিনা’র মতোই সুন্দর ৷ সবুজ গালিচায় গোলাকার স্বপ্নকে ঘিরে তো শুধু 11 জন নয়, প্রতিশোধের আগুনে ফোটে গোটা লাতিন আমেরিকা ৷ এই একদিন সবুজ-হলুদ কিংবা নীল-সাদা নয়, শাসকের সামনে একজোট হয়ে চোখে চোখ রেখে লড়াই করার দিন ৷ বছরের পর বছর ধরে এমনটাই তো মনে করে এসেছেন লাতিনরা ৷ গত কয়েকবছরে যেই যুদ্ধে নেতৃত্ব দিচ্ছেন মহাদেশের বর্তমানের ফুটবল জাদুকর স্বয়ং ৷ যার উত্থান ইউরোপে হলেও কেরিয়ারের প্রায় সায়াহ্নে এসে তিনি আরও অনেক বেশি করে একাত্ম হয়েছেন নীল-সাদা জার্সির সঙ্গে, শাপমোচনও হচ্ছে ৷
2006 সালে বিশ্বকাপে অভিষেক ৷ আর্জেন্তিনার তৎকালীন কোচ হোসে পেকারম্যান চিনতেই পারেননি ‘বিস্ময় বালক’কে ৷ 2008 সালে বেজিং অলিম্পিকসে সোনাজয়ী লা-আলবিসেলেস্তে'র সদস্য ছিলেন মেসি ৷ তারপর থেকে দেশের জার্সিতে শুধুই ব্যর্থতা ৷ 2010 বিশ্বকাপে জার্মানির কাছে বিধ্বস্ত হওয়া । 2014 বিশ্বকাপে ব্রাজিল মাতিয়ে দিয়েছিলেন আধুনিক ফুটবলের বরপুত্র । কিন্তু ফাইনালে ন্যুয়েরকে টপকাতে পারেননি । গোৎজের শেষ মুহূর্তের গোলে হেরে যায় আর্জেন্তিনা । 2018 বিশ্বকাপে ফ্রান্সের কাছে লজ্জার হার ৷ টানা দু’টি কোপা আমেরিকার ফাইনালে হার, টাইব্রেকারে পেনাল্টি মিস ৷ ক্লাবের জার্সিতে সফল মেসিই ছিলেন দেশের জার্সিতে ‘ট্যাজিক হিরো’ ৷ গত দু'বছরে শেষ ছবিটাই আমুল বদলে গিয়েছে ।
2021 কোপা আমেরিকা: ডি'মারিয়ার গোলে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্রাজিলকে উড়িয়ে দিলেও দলের প্রাণভোমরা ছিলেন 10 নম্বর জার্সিধারী। মেসির ম্যাজিকে 28 বছর পর আর্জেন্তিনা শুধু কোপা ঘরে তোলেনি, শাপমুক্তি হয়েছিল মেসিরও । নীল-সাদা জার্সি গায়ে আকাঙ্খিত সাফল্য ধরা দিয়েছিল মেসির পায়ে ।
2022 লা ফাইনালিসিমা: আর্তেমিয়ো ফ্রানসি কাপ ৷ বর্তমানের লা ফাইনালিসিমা ৷ যার পোশাকি নাম কনমেবল-উয়েফা কাপ অফ চ্যাম্পিয়ন্স ৷ শেষবার এই কাপ হাতে তুলেছিলেন এক আর্জেন্তনীয় ৷ 10 নম্বর ওই জার্সিধারীর নাম ছিল দিয়েগো আর্মান্দো মারাদোনা ৷ তারপরেই বন্ধ হয়ে যায় ওই কাপ ৷ 2022 সালে ফের চালু হয়েছে এই টুর্নামেন্ট । পুনর্জন্মের প্রথম বছরেই সেই ট্রফি ঘরে তুলেছেন লিও মেসি । কোপা আমেরিকার পর দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে নীল-সাদা জার্সির ধ্বজা উড়িয়েছিলেন ইউরোপীয়ান ক্লাব দুনিয়ার অন্যতম সফল ৷
2022 কাতার বিশ্বকাপ: কাতারের আমির ট্রফি তোলার আগে উটের লোম এবং ছাগলের পশম দিয়ে তৈরি রয়্যালটিদের পোশাক 'বিষ্ট' পরিয়ে দেন লিওনেল মেসিকে । ঠিক যেমনটা দেখা যায় ম্যাজিশিয়ানদের গায়ে । মেসি তো ম্যাজিশিয়ানই । যার বাঁ-পায়ের শিল্প ভুলিয়ে দেয় সব দুঃখ। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা টালমাটাল । নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস অগ্নিমূল্য । মুদ্রাস্ফীতির হার তিন অঙ্কে পৌঁছে গিয়েছিল । আধুনিক ফুটবল ঈশ্বরের বাঁ-পায়েজ জাদুতে অবশ্য সব ভুলেছিল আর্জেন্তাইনরা । ঘুচে গিয়েছিল যাবতীয় দুঃখ । মেসি-ম্যাজিকে শান্ত হয়েছিল দেশ ।
শুধু দেশকে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে বসানোই নয়, ব্যক্তিগত সাফল্যের ঝুলিটাও ভরিয়েছিলেন লিও । ক্রোয়েশিয়ার বিরুদ্ধে সেমিফাইনালে কেরিয়ারের 11তম গোল করেন লিওনেল মেসি ৷ সেই সঙ্গে গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতাকে ছাপিয়ে আর্জেন্তিনার হয়ে সর্বাধি গোলের রেকর্ড করেন তিনি ৷ ফাইনালে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে আরও 2টি গোল যোগ হয়েছে সেই তালিকায় ৷ একটি ম্যাচের শুরুতে পেনাল্টি থেকে এবং দ্বিতীয়টি অতিরিক্ত সময়ে ৷ সব মিলিয়ে বিশ্বকাপে 13টি গোল করেছিলেন মেসি ৷
কম এবং বেশি বয়সি ফুটবলার হিসেবে রেকর্ড: ফিফা বিশ্বকাপে একই ম্যাচে গোল করা এবং গোলের অ্যাসিস্ট অনেকেই করেছেন ৷ কিন্তু, সবচেয়ে কম বয়সি ফুটবলার এবং সবচেয়ে বেশি বয়সের ফুটবলার হিসেবে এই কাজটা শুধুমাত্র লিওনেল মেসিই করে দেখিয়েছেন ৷
বিশ্বকাপের প্রতিটি রাউন্ডে গোলের রেকর্ড: ফ্রান্সের বিরুদ্ধে 2টি গোল করেছেন লিও ৷ সেই সঙ্গে প্রথম কোনও প্লেয়ার যিনি বিশ্বকাপের প্রতিটি রাউন্ডের ম্যাচে গোল করার রেকর্ড করেছেন ৷ বিশ্বকাপে লিওনেল মেসি গ্রুপ স্টেজ, রাউন্ড 16, কোয়ার্টার ফাইনাল, সেমিফাইনাল এবং ফাইনালে গোল করেছেন ৷
বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি সময় খেলার রেকর্ড: ক্রোয়েশিয়ার বিরুদ্ধে সেমিফাইনাল ম্যাচের পর লিওনেল মেসি মাত্র 23 মিনিট দূরে ছিলেন, বিশ্বকাপের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সময় খেলার রেকর্ড ছুঁতে ৷ ফাইনালের প্রথমার্ধে সেই রেকর্ডও তাঁর নামের সঙ্গে জুড়ে যায় ৷
বিশ্বকাপে সর্বাধিক ম্যাচ খেলা ফুটবলার: 2006 সালে আর্জেন্তিনার জার্সিতে বিশ্বকাপ অভিষেক হয়েছিল লিওনেল মেসি ৷ 2022 সালে কাতারে মেসি তাঁর পঞ্চম বিশ্বকাপ খেলতে নেমেছিলেন ৷ আর 5টি বিশ্বকাপে মোট 26টি ম্যাচ খেলে ফেলেছেন মেসি ৷ যা বিশ্বকাপে কোনও ফুটবলারের সর্বাধিক ম্যাচ ৷ যা এর আগে দীর্ঘ দিন লোথার ম্যাথাউজের নামে ছিল ৷
বারবার ব্যর্থ হয়ে অবসর নিয়েছেন ৷ হতোদ্যম হয়ে জানিয়ে দিয়েছেন নীল-সাদা জার্সির তুলে রাখার কথা ৷ আবার ফিরে এসেছেন । দেখিয়েছেন কেন তিনিই শ্রেষ্ঠ, কর্তৃত্ব ফলিয়েছেন। প্রতিভা এবং পরিশ্রমের যুগলবন্দি ফুল ফুটিয়েছে সবুজ গালিচায় । জীবনের সায়াহ্নে ভক্তরা বুঁদ হয়ে জাদুকরের স্বপ্নের পারফর্ম্যান্সে । শান্ত অথচ সিংহের মতোই কেশর ফুলিয়ে জয় করেছেন বিশ্ব । কেরিয়ারের শেষ লগ্নে এসে 'চেরি অন দ্য কেক' আরও লালিত করছে তাঁর খ্যাতিকে ।"
আরও পড়ুন: ‘মেসি ইজ ইনফিনিটি’, দিয়েগোর জন্মদিনে লিও’র ঝুলিতে অষ্টম ব্যালন ডি’অর