কোনও একটা নেমন্তন্ন বাড়িতে আমায় দেখেছিলেন বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত (Buddhadeb Dasgupta) ৷ তখন আমার বয়স 6-7 বছর ৷ আমার বাবা হঠাত্ একদিন বললেন, তোমায় এক জায়গায় নিয়ে যাব ৷ তখন বুদ্ধ কাকু যতীন দাস রোডে থাকতেন ৷ গিয়ে দেখলাম ঘরটায় প্রচুর বই ছড়ানো ৷ আমাকে বললেন, "তুমি সিনেমা করবে ?" আমি তো অবাক হয়ে গেলাম ৷ বললাম, হ্যাঁ করব ৷ তখন তিনি আমায় বললেন, "একটু কাঁদো তো ৷" বাচ্চারা যেমন কাঁদে, সে ভাবে চোখে আঙুল দিয়ে কাঁদলাম ৷ তিনি তো দারুণ খুশি ৷ বাবাকে বলে দিলেন কোন দিন শ্যুটিং হবে ৷
সেই সময় অনেকদিন স্কুল যাইনি ৷ প্রায় মাসখানেক শ্যুটিং চলে ৷ স্কুলের টার্মিনাল পরীক্ষাও দিতে পারিনি ৷ তখনকার দিনে স্কুলে না গিয়ে সিনেমায় শ্যুটিং করতে যাওয়াটা অনেকেই ভালো চোখে দেখতেন না ৷ তবে বাবা খুব উত্সাহী ছিলেন ৷ শ্যুটিং হয়েছিল বলরাম বসু ঘাট রোডে ও বালিগঞ্জের কাছে জামিরলেনের একটি বাড়িতে ৷ কিছু শট ছিল তপসিয়ার একটি স্কুলে ৷ প্রেক্ষাপট ছিল এটাই যে, বাবা মা আর দুই মেয়ের জীবন কাহিনী ৷ আমরা খেতে পেতাম না ৷ খুবই গরিব ৷ কিছুই জোটে না ৷ আমি হয়েছিলাম ছোট মেয়ে ৷ আমার চরিত্রের নাম ছিল লতি ৷ আর আমার দিদির নাম যুথি ৷ বাবার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন সুনীল মুখোপাধ্যায় এবং মায়ের চরিত্রে ছিলেন মণিদ্বীপা রায় ৷ একটি সংলাপের কথা এখনও মনে পড়ে ৷ আমাদের দেখানো হয়েছিল মরা গরিব হিসেবে ৷ আকাশে একদিন মেঘ ভাসতে দেখে আমি মানে লতি বলে ওঠে, "মুসুর ডালের মেঘ, মাছের ঝোলের মেঘ ৷" এতটাই অপূর্ব ছিল তাঁর উপস্থাপনা ৷ তিনি চাইল্ড সাইকোলজি খুব ভালো বুঝতেন ৷ আমাকে সুন্দর করে শট বোঝাতেন ৷ আমার জন্য খুব কম শটই রিটেক হয়েছে ৷
আরও পড়ুন: ব্যতিক্রমী বিদ্বজ্জন বুদ্ধদেবের মৃত্যুতে শোকাহত অপর্ণা, বিকাশ
আর একটি স্মৃতির কথা খুব মনে পড়ে ৷ আমার কান্নার একটি দৃশ্য ছিল ৷ পরে জানতে পেরেছি বুদ্ধ কাকু মণিদ্বীপা মাসিকে বলেছিলেন, আমাকে শ্য়ুটিং-এর সময়ে খুব জোরে একটা চড় মারতে ৷ আমি তখন সে সব জানতাম না ৷ মাসি এত জোরে চড়টা মেরেছিলেন, এখনও ভুলতে পারিনি ৷ আমায় কেউ কোনওদিন আর ও ভাবে মারেনি ৷ চিত্কার করে কেঁদে উঠি ৷ ফল যা হওয়ার তাই হয়েছে ৷ দৃশ্যটি দারুণ শ্যুট হয়েছে ৷ কিন্তু আমি খুব রেগে যাই ৷ আর সিদ্ধান্ত নিই আর শ্যুটিং করব না ৷ পরের দিন গাড়ি আমাকে নিতে এলেও আমি যাইনি ৷ বুদ্ধকাকু নিজে এসে আমাকে চকোলেট দিয়ে বুঝিয়ে পরে নিয়ে যান ৷ সেই ছবিই জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পায় ৷ জাতীয় পুরস্কারের আসরে শিশুশিল্পী বিভাগের জন্য মনোনীতও হয়েছিলাম ৷ তবে সেটা পাইনি ৷ হিন্দির এক অভিনেত্রী পেয়েছিল ৷ তবে নামী সব পত্রিকায় আমার ছবি দিয়ে প্রতিবেদন ছাপানো হয় ৷ সেটা আমার খুব ভালো লাগে ৷ বড় হয়ে যখন ছবিটা দেখি, তখন বুঝতে পারি, কত ভালো হয়েছিল দৃশ্যটা ৷ আগে ভাবতাম শ্যুটিং করা মানেই সুন্দর জামাকাপড় পরা, সেটা শুধু হয়নি ৷ চুলে ধুলো মাখিয়ে শুষ্ক করে, ছেঁড়া নোংরা টেপজামা পরা অবস্থায় ছিল আমার দৃশ্যগুলি ৷
আরও পড়ুন : অধ্যাপক থেকে পরিচালক, বুদ্ধদেবের প্রয়াণে শেষ 'তাহাদের' যুগ
নিম অন্নপূর্ণার ডাবিং করতে এনটিওয়ান স্টুডিয়োতে গিয়েছিলাম ৷ তখনও একজন টেকনিশিয়ান দৌড়ে এসে বললেন, "উত্তম কুমারকে দেখবি ?" বলি, হ্যাঁ দেখব ৷ আমায় তিনি নিয়ে গেলেন ৷ রাস্তাতেই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে দেখলাম ৷ সে দিনই উত্তম কুমারকে দেখতে যাওয়ার সময় মিঠুন চক্রবর্তীকেও দেখি ৷ কলঙ্কিনী কঙ্কাবতীর শ্যুটিং হচ্ছিল ৷ উত্তম কুমারকেও সামনে থেকে দেখি প্রথমবার ৷ তাঁর পাশে ছিলেন সুপ্রিয়া দেবী ৷ দারুণ এক্সাইটেড ছিলাম ৷ বুদ্ধ কাকুর হাত ধরেই ফিল্ম জগতটাকে চিনি ৷ গোটা ইউনিটটা যে একটা পরিবারের মতো এটা খুব মনে হত ৷ আমি ছোট ছিলাম বলেই সবাই আমার খুব যত্ন নিত ৷ এই ছবি দেখেই বছর দুই পর গৌতম ঘোষ তাঁর 'দখল' নামে একটি ফিল্মে আমায় অভিনয় করার সুযোগ করে দেন ৷
আরও পড়ুন: তোমার কাজের মধ্যে দিয়েই আমাদের মাঝে থেকো বুদ্ধ দা : প্রসেনজিত্
বুদ্ধ কাকু খুবই বন্ধুত্বপূর্ণ ছিলেন ৷ যখন কলেজে পড়ি, তখনও দেখা করতে যেতাম ৷ তাঁর স্ত্রী পর্ণামাসিও খুব স্নেহ করতেন ৷ তাঁদের দুই মেয়ে বাবলি ও শিউলি আমার থেকে ছোট ৷ দেখা করতে গেলেই অনেক গল্প করতেন বুদ্ধ কাকু ৷ জিজ্ঞেস করতেন, আমি কী করছি, আর কী করব ৷ বড় হয়ে তাঁর ছবিগুলি যখন দেখেছি, তখন বুঝেছি তিনি কতটা বড় মাপের পরিচালক ছিলেন ৷ তখন খুব গর্ব হয়েছিল ৷ তাঁর মতো একজনের সঙ্গে কাজ করেছি এটা সত্যিই গর্বের ৷ সেটে সবার সঙ্গে খুব ভালো ভাবে কথা বলতেন তিনি ৷ কখনও খুব বেশি রেগে যেতে কখনও দেখিনি ৷ তবে খুব পার্টিকুলার ছিলেন ৷ এ জন্য লোকেশনে গিয়েও বসে থাকতে হত অনেক সময়ে ৷ সূর্যের আলো সঠিক সময় না আসা পর্যন্ত তিনি শ্যুট করতেন না ৷ যখন সেই আলো পেতেন, তখন শটটা দিতে হত ৷
তিনি অসুস্থ ছিলেন শুনেছিলাম, খবরটা পেয়ে খুবই ভেঙে পড়ি ৷ মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছে ৷ এটা একটা অপূরণীয় ক্ষতি ৷ বাংলা সিনেমার জগত্ একজন বিরাট মাপের মানুষকে হারাল ৷