রবি ঠাকুর মানে বাঙালির প্রেম । রবি ঠাকুর মানে মানুষের আবেগ । মানুষের মনের গভীরে ডুব দিয়েছিলেন তিনি । প্রেমের সূক্ষ্মতা ও তা কীভাবে সম্পর্কগুলির সঙ্গে জড়িত তা বোঝার ক্ষমতা রাখতেন কবিগুরু । তাঁর লেখা বেশিরভাগ গল্পের থিমই থাকত প্রেমকে কেন্দ্র করে । মজার বিষয় প্রতিটি প্রেমই একে অপরের থেকে আলাদা ।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বর্তমানে মানুষের কাছে একটি গবেষণার বিষয় । তাঁকে নিয়ে যেমন পড়াশোনা করা হয়, তেমনই পড়াশোনা করা হয় তাঁর লেখা নিয়েও । আজ 22 শে শ্রাবণ । রবি ঠাকুরের মৃত্যুদিনে দেখে নেওয়া যাক বাংলা চলচ্চিত্র জগৎ তাঁকে কতটা বাঁচিয়ে রেখেছ...
1. কাবুলিওয়ালা (1957)
রবি ঠাকুরের লেখা ছোটো গল্প 'কাবুলিওয়ালা'-র গল্পকে বড় পরদায় ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল । গল্পে রহমত নামে একজন আফগানি কাবুলিওয়ালার সঙ্গে বাচ্চা মেয়ে মিনির সম্পর্ককে দেখানো হয়েছে । মিনি রহমতকে তাঁর নিজের মেয়ের কথা মনে করাত । তাদের এই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক একজন অপরিচিতের কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল তা গল্পে দেখানো হয়েছে । ছবিটির পরিচালনা করেছিলেন তপন সিনহা । অভিনয় করেছেন ছবি বিশ্বাস, টিঙ্কু, রাধামোহন ভট্টাচার্য, কালী ব্যানার্জি, জওহর রায় । বাংলা ছাড়াও হিন্দি ও মলয়ালম ভাষাতেও ছবিটি তৈরি হয় । বেস্ট ফিচার ফিল্ম হিসেবে ন্যাশনাল ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড ও 7 তম বার্লিন ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভালে সিলভার বিয়ার এক্ট্রাঅর্ডিনারি প্রাইজ় অফ দা জুরি পায় 'কাবুলিওয়ালা' ।
2. তিন কন্যা (1961)
1961 সালে সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় 'তিন কন্যা' মুক্তি পায় । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 100 তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষেই তৈরি ছবিটি । রবি ঠাকুরের তিনটি ছোটো গল্প থেকে তৈরি সংকলন । তিনটি গল্পের প্রধান চরিত্রই নারী । এই তিন নারী চরিত্রকে বোঝানোর জন্য ছবির নাম দেওয়া হয় 'তিন কন্যা' । প্রথম গল্প 'পোস্টমাস্টার'-এ কন্যা খুব ছোটো, বয়স প্রায় 8-9 বছর । দ্বিতীয় গল্প 'মণিহারা'-তে কন্যা বিবাহিতা । আর তৃতীয় গল্প 'সমাপ্তি'-তে কন্যা ষোড়শী । ছবির তিনটি গল্পের তিন নারী চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন চন্দনা বন্দ্যোপাধ্যায়, কণিকা মজুমদার ও অপর্ণা সেন । ছবিটি বেস্ট ফিচার ফিল্মের জন্য ন্যাশনাল ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড পায় । এছাড়া বেস্ট ডিরেক্টর ও বেস্ট ভারতীয় সিনেমা হিসেবে 25 তম অ্যানুয়াল BFJA অ্যাওয়ার্ডও পায় 'তিন কন্যা' ।
৩. চারুলতা (1964)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড় গল্প 'নষ্টনীড়' অবলম্বনে তৈরি সত্যজিৎ রায় পরিচালিত 'চারুলতা' । ছবিটি বিশ্বে 'দা লোনলি ওয়াইফ' নামেও পরিচিত । ছবিতে চিত্রায়নের কারণে বইয়ের গল্প থেকে কিছুটা পরিবর্তন করা হয়েছিল । 'চারুলতা'-য় অভিনয় করেছিলেন মাধবী মুখোপাধ্যায়, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, শৈলেন মুখোপাধ্যায়, শ্যামল ঘোষাল । ছবিটি ওই বছরই বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভালে সিলভার বেয়ার পুরস্কার পায় । এছাড়া 1965-এ সেরা ছবি হিসেবে ন্যাশনাল ফিল্ম অ্যাওয়ার্ডের তরফে গোল্ডেন লোটাস অ্যাওয়ার্ড জিতে নিয়েছিল 'চারুলতা' ।
৪. অতিথি (1965)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি ছোটো গল্প অবলম্বনে পরিচালক তপন সিনহা তৈরি করেন 'অতিথি' । গল্পে একজন কিশোরকে দেখানো হয় যে গার্হস্থ্য জীবন ছেড়ে ভবঘুরে জীবন বেছে নেয় । 'অতিথি'-তে অভিনয় করেছেন পার্থ মুখার্জি, সমিতা বিশ্বাস, গীতা মুখার্জি, বাসবী ব্যানার্জি, সলীল দত্ত । দ্বিতীয় বেস্ট ফিচার ফিল্ম হিসেবে 13 তম ন্যাশনাল ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড জিতে নেয় ছবিটি । পরে 'অতিথি'-কে হিন্দি ভাষাতেও তৈরি করা হয় ।
৫. ঘরে বাইরে (1984)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা 'ঘরে বাইরে' অবলম্বনে তৈরি ছবি । ছবিটির পরিচালনা করেছেন সত্যজিৎ রায় । 'ঘরে বাইরে'-তে দেখা যায়, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায়, জেনিফার কাপুর ও স্বাতীলেখা সেনগুপ্তকে । শোনা যায়, সত্যজিৎ রায় তাঁর প্রথম ছবি 'পথের পাঁচালী' তৈরির অনেক আগে 'ঘরে বাইরে'-র চিত্রনাট্য লিখে রেখেছিলেন । ছবিটির বিষয় নারীমুক্তিকে কেন্দ্র করে, যা সত্যজিৎ রায়ের অন্যান্য অনেক ছবিতেই উঠে এসেছে । ছবিটি বেস্ট ফিচার ফিল্ম ইন বেঙ্গলি হিসেবে ন্যাশনাল ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড জিতে নেয় । এছাড়াও বেস্ট সাপোর্টিং অ্যাক্টর ও বেস্ট কস্টিউম ডিজ়াইনের জন্যও ন্যাশনাল ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড পায় 'ঘরে বাইরে' ।
৬. চোখের বালি (2003)
'চোখের বালি' রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা একই নামের উপন্যাস অবলম্বনে চিত্রায়িত । ছবিটির পরিচালনা করেন ঋতুপর্ণ ঘোষ । 'চোখের বালি'-তে অভিনয় করেছেন ঐশ্বরিয়া রায় বচ্চন, প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, রাইমা সেন ও টোটা রায়চৌধুরি । পরে ছবিটি হিন্দিতেও মুক্তি পায় এবং হিন্দিতেই আন্তর্জাতিক মুক্তি পায় । 'চোখের বালি'-কে নিয়ে অনেক ইতিবাচক সমালোচনা হয় । সেরা বাংলা ছবি হিসেবে ন্যাশনাল ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড পায় ।
৭. চতুরঙ্গ (2008)
'জ্যাঠামশাই', 'শচীশ', 'দামিনী' ও 'শ্রীবিলাস'- এই চার পর্বে বিভক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা উপন্যাস 'চতুরঙ্গ' । এই উপন্যাস অবলম্বনে চিত্র পরিচালক সুমন মুখোপাধ্যায় তৈরি করেন বাংলা ছবি 'চতুরঙ্গ' । ছবিতে মুখ্য ভূমিকায় দেখা গেছে ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত, ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়, কবীর সুমন, সুব্রত দত্ত ও জয় সেনগুপ্তকে । পুরুষ ও মহিলার জটিল যৌনমনস্তত্ত্ব ও আদর্শের সংঘাতই ছবির মূল বিষয় ।
8. নৌকাডুবি (2011)
ঋতুপর্ণ ঘোষের পরিচালনায় তৈরি 'নৌকাডুবি' । ছবিটিকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা একই নামের উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি করা হয়েছে । এটি একটি সামাজিক ও আবেগপ্রবণ ছবি । 'নৌকাডুবি'-তে অভিনয় করেছেন জিশু সেনগুপ্ত, রাইমা সেন, প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, রিয়া সেন ও ধৃতিমান চ্যাটার্জি । ছবির গান 'খোয়া কেয়া' 4 তম মির্চি মিউজ়িক অ্যাওয়ার্ড জিতেছিল ।
৯. এলার চার অধ্যায় (2012)
2012 সালে মুক্তিপ্রাপ্ত একটি বাংলা ছবি 'এলার চার অধ্যায়' । ছবির পরিচালক বাপ্পাদিত্য বন্দ্যোপাধ্যায় । ছবিটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা 'চার অধ্যায়' উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত । ছবির প্রেক্ষাপট 1940-র দশকের ব্রিটিশ ভারত । ইন্দ্রনাথ এক বিপ্লবী দলের নেতা । এলা এই দলের শিক্ষিকা । নিজের প্রেমিক অতীন্দ্র ও দেশের প্রতি কর্তব্য- এই দুইয়ের মধ্যে দ্বন্দ্বে এলা জর্জরিত । ছবিতে অভিনয় করেছেন পাওলি দাম, ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত, রুদ্রনীল ঘোষ, অরুণিমা ঘোষ সহ আরও অনেকে ।
10. তাসের দেশ (2013)
কিউ (কৌশিক মুখার্জি) 2012সালে তৈরি করেন 'তাসের দেশ' । এটি একটি বাংলা ফ্যান্টাসি ফিল্ম । রবীন্দ্রনাথের নৃত্যনাট্য 'তাসের দেশ' থেকে ছবিটিকে অ্যাডপ্ট করা হয়েছে । ছবিতে মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন সৌমক কান্তি দে বিশ্বাস, অনুব্রত বসু, তিলত্তমা শোম, ঋ, জয়রাজ ভট্টাচার্য, তিনু ভারঘিজ় ও ইমাদুদ্দিন শাহ । রোম ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভালে 'তাসের দেশ'-র আন্তর্জাতিক প্রিমিয়ার হয়েছিল । দেশে ছবিটি 2013 সালে মুক্তি পায় ।