নিউ সায়েন্টিস্ট, যুক্তরাজ্য : সুইডেনের উপাসালা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যালেওন্টোলজিস্ট পার আলবের্গ সত্যিই কপরোলাইটস সম্বন্ধে অনেক কিছু জানেন । এই জীবাশ্মের মলগুলি প্রায় 200 বছর ধরে বিজ্ঞানের কাছে জানা ছিল । তবে দীর্ঘকাল ধরে তাকে প্যালেওন্টোলজির শেষ হিসাবে বিবেচনা করা হয় । আলবের্গ বলেন, ‘‘এগুলি খুব আকর্ষণীয় জীবাশ্ম নয় এবং এগুলিকে সাধারণত নজরই দেওয়া হয় না ।’’ কিন্তু গ্রেনোবলের এক্স-রে এর দৌলতে তারা এখন স্বর্ণযুগ উপভোগ করছে ।
কপরোলাইটস প্রথমবার প্রকাশ্যে এসেছিল 1820 সালে । যুক্তরাজ্যের লাইম রেগিসে জীবাশ্মের মলের মধ্যে প্রথমবার ফোলা কিছু একটা অংশ দেখতে পান অপেশাদার প্যালেন্টোওলজিস্ট ম্যারি অ্যানিং এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ববিদ উইলিয়াম বাকল্যান্ড । এই আবিষ্কারের ফলে অপেশাদার জীবাশ্ম সন্ধানকারীদের মধ্যে ‘কপরোম্যানিয়া’ নিয়ে লড়াই শুরু হয়ে যায় । তবে পেশাদার বিজ্ঞানীরা বিষয়টিকে গুরুত্বই দিতে চাননি ।
1990 সালে বোল্ডারের কোলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের কারেন চিন কপরোলাইটস নিয়ে বৈজ্ঞানিক আগ্রহ তৈরি করতে সমর্থ হন । কারণ, তিনি তাঁর কাগজপত্রে কানাডার একটি ‘বেশ বড় আকার’ এর নমুনার কথা উল্লেখ করেন । যাকে তিনি টাইরেনোসরাস রেক্সের মল বলেই ব্যাখ্যা করেন । এটা 44 সেন্টিমিটার লম্বা, 16 সেন্টিমিটার চওড়া এবং 13 সেন্টিমিটার উচ্চ এবং সেটা ছিল পুরোটাই চটকানো একটা হাড়, যা দেখে ট্রিসেরাটপস প্রজাতির কম বয়সী ডাইনোসরের বলেই মনে হচ্ছিল । যেটা কিছুটা হজম করে নেওয়া হয়েছিল ।
তারপর থেকে কপরোলাইটস একের পর এক অসাধারণ তথ্য সামনে আনছে । তার মধ্যে রয়েছে হজম না করা ডাইনোসরের মাংস, প্রাচীনতম স্তন্যপায়ী প্রাণী হিসেবে পরিচিত প্রাণীর খুলির কিছুটা অংশ, চুল, পালক, কীটপতঙ্গের অংশাবশেষ এবং ক্ষুদ্রান্তের অনেক প্যারাসাইট । এছাড়াও প্রথম দিকের টার্ড, যা কীটপতঙ্গ ধরত । 2009 সালে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আসা 2 লক্ষ বছরের পুরনো একটি হোমিনিন চুলের মধ্যে হায়নার কপরোলাইট পাওয়া যায় । হয়তো আমাদের পূর্বপুরুষদের কাউকে খাওয়ার পর এটা সেখানে আটকে গিয়েছিল ।
আরও পড়ুন : ঝাড়খণ্ডে মিলল 20 কোটি বছর পুরোনো পাতার জীবাশ্ম !
একদিক থেকে দেখতে গেলে এটা মোটেই আশ্চর্যজনক নয় যে পুরনো ফেলে দেওয়া জিনিসের মধ্যেই ঐশ্বর্য লুকিয়ে রয়েছে । কার্নিভোর মল জীবাশ্মের জন্য বিশেষত খুব ভালো হয় । কারণ, এগুলি মাংস এবং হাড় থেকে প্রচুর খনিজ নিয়ে থাকে । আলবের্গ বলেন, ‘‘সেখানে প্রচুর পরিমাণে ফসফেট থাকে । যা তাড়াতাড়ি খনিজ তৈরি করতে পারে । এটা ক্রিস্টালের মতো আকার তৈরি করে এবং পুরো জিনিসটাকে বেঁধে ফেলতে পারে । নরম টিস্যু সহ এটা পুরো বিষয়টি রক্ষা করতে পারে ।’’
মল এত ভালো সংরক্ষণ করে বলে, কপরোলাইটগুলিতে প্রায়শই এমন উপাদান থাকে যা জীবাশ্ম না রাখে বা কখনও কখনও বিশদ তথ্য থাকে । সেই কারণে যার উপর এগুলি পাওয়া যায়, সেগুলিকে সাধারণত কোনজারভেট-ল্যাগেরস্টাটে হিসেবে ধরা হয় । এটা ওই অংশের বৈজ্ঞানিক নাম যেখানে জীবাশ্ম, বিশেষ করে নরম টিস্যুগুলি খুব ভালো করে সংরক্ষিত করে রাখা হয় । এর জন্যই কপরোলাইটকে অ্যাম্বার, জীবাশ্মের গাছের সঙ্গে তুলনায় করা হয় । যার মধ্যে প্রাচীন প্রাণীরা আটকে গিয়ে থাকতে পারে । নেকলেসের মাঝখানটি যেমন হয়, তেমনভাবে কপরোলাইট শেষ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম থাকে ।
অ্যাম্বারের মতো কপরোলাইটও তৎকালীন সময়ের ইকোসিস্টেম সম্পর্কে তথ্য দিতে পারে । যেমন – কে কাকে খেত । আর সম্পূর্ণ পরিবেশের একটা ঘনীভূত ছবি ধরা থাকে । উদাহরণ হিসেবে ইনসেক্টিভোরের কথা বলা যায় । যা বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে পতঙ্গ খেয়ে বেড়ায় । তারপর সেগুলিকে একজায়গায় এমনভাবে জড়ো করে রাখে যে, তা ভবিষ্যতের প্যালাওন্টোলজিস্টদের কাজে লেগে যায় । আলবের্গ বলেন, ‘‘জীবন্ত ইকোসিস্টেমে কীভাবে কাজ হত, তার বিস্তারিত তথ্য এমনভাবে থাকে, যা কোনও সূত্রের তথ্যে পাওয়া যায় না । এটা একটা অভূতপূর্ব তথ্যের উৎস । একটি সসেজ-আকৃতির ল্যাজারস্টেট ।’’
তবে অ্যাম্বারে যত ভালো সংরক্ষণ হয়, এটাতে ওত ভালো হয় না । কারণ, বস্তুগুলিকে চেবানো হয়েছিল বা আংশিকভাবে হজম করা হয়েছিল । কিন্তু অন্যদিক থেকে কপরোলাইটের প্রান্ত রয়েছে । কপরোলাইট সমস্ত ধরনের প্রাণীতে থাকে । তার মধ্যে পতঙ্গ, সরীসৃপ, মাছ, স্তন্যপায়ীও পাখি । আর মলত্যাগের অভ্যাস এদেরকে এক সারিতে নিয়ে আসে । অ্যাম্বার অতীতের কিছু বিশেষ বিষয়কে সামনে এনেছে । শুধুমাত্র যে সময় গাছের জীবাশ্ম তৈরি হয়েছে, সেই সময়টিই ধরা পড়েছে । কিন্তু কপরোলাইটের ক্ষেত্রে জীবাশ্মের তথ্য একেবারে সঠিক থাকে । এটা অনেক প্রাচীন হতেই পারে । 400 মিলিয়ন বছর আগে ডোভেনিয়ন পিরিয়ডে যখন প্রথম প্রাণের সৃষ্টি হয়েছিল, সেই সময়ে পৌঁছে যাওয়া যেতে পারে ।
কিন্তু সমস্যা হল কপরোলাইট সব সময়ই ধরা যায় না । এর ভিতরের সম্পদ উদ্ধার করতে হলে, প্রথমে আমাদের এটা কেটে ফেলতে হয় । তারপর মোটা মোটা করে কেটে অপটিক্যাল মাইক্রোস্কোপের নিচে ফেলতে হয় । অথবা এগুলিকে ভেঙে ফেলে আরো শক্ত ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপে ফেলে দেখতে হয় । এই পদ্ধতিতে শেষ পর্যন্ত তোমার হাতে যে তথ্য আসে, তা ব্যাখ্যা করা কঠিন ৷ এমন ছবি এবং সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ বাদ পড়ে যাওয়ার ভয় থাকে । আর একটা উপায় হল ওই কপরোলাইটকে একেবারে ভিজিয়ে দেওয়া । কিন্তু এতে সূক্ষ্ম বস্তুগুলি নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে ।
সবচেয়ে ভালো হয় যদি আমরা কপরোলাইটকে না ভেঙে ওটার ভিতরে দেখতে পারি । এটা একটা ইমেজিং পদ্ধতি আছে, তার মাধ্যমে করা যায় । যাকে বলা হয় প্রোপাগেশন ফেজ-কনট্রাস্ট সিনকোট্রোন মাইক্রোটোমোগ্রাফি বা সংক্ষেপে পিপিসি-এসআরমিউসিটি । এটা লেজারের মতো এক্স রে দিয়ে নমুনার উপর খুব শক্তিশালীভাবে কাজ করে । এটা মাধ্যমের ঘনত্ব অনুযায়ী বিচ্ছুরিত করে । এর মাধ্যমে খুব সূক্ষ্ম ভিতরের বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায় । নমুনাকে যত ঘোরানো হয়, তত স্ক্যানার বিভিন্ন কোণ থেকে বহু ছবি তুলে নেয় । ত্রিমাত্রিক ব্যবস্থার মাধ্যমে সফটওয়্যারের মধ্য থেকেই তথ্যসংগ্রহ করে নেয় ।
আরও পড়ুন : এবার ইট্যালিতে কোরোনার নতুন স্ট্রেনের হদিশ
প্রথম যে দুটি কপরোলাইটকে আলবের্গ ও তাঁদের দলের সদস্যরা ইমেজিং করে এই পদ্ধতিতে, সেই দুটি হল পোল্যান্ডের ক্রাসেইজোর জীবাশ্ম । যার সময়কাল 200 মিলিয়ন বছর আগে ট্রিয়াসিক পিরিয়ডে । আলবের্গ বলেন, ওই কাজটা ছিল শুধুমাত্র নীতির প্রমাণ । কিন্তু স্ক্যান করার পর বোঝা গেল যে নতুন পদ্ধতি কতটা কার্যকর হতে পারে । এটা দেখালো যে প্রথম নমুনাটা কার্যত পুরো একটা মাছ । এর সঙ্গে দেখানো আঁশযুক্ত ত্বক, হাড় ও ভেঙে যাওয়ার ঝিনুক জাতীয় কিছু । দলবল এই সিদ্ধান্তে পৌঁছালো যে এটা নেওয়া হয়েছিল বড় কোনও লাংফিশ থেকে ।
দ্বিতীয়টিতে ছিল গুবরে পোকার একাধিক অংশ । যার মধ্যে পাখনা, পায়ের অংশবিশেষও ছিল । কপরোলাইটের আকারের দিক থেকে দেখতে গেলে এটা একটা পতঙ্গভুক তৈরি করেছিল । পতঙ্গভুক স্তন্যপায়ী বা টিকটিকির থেকে এটা আকারে অনেকটাই বড়ো । দলের সদস্যরা পরে এর সম্ভাব্য উৎস হিসেবে মনে করে ডাইনোসোরের মতো সরীসৃপকে । যাকে সিলেসোরাস বলা হত । কপরোলাইটগুলি অ্যাম্বারের সাথে তুলনীয়, যদিও কোনও নেকলেসে শেষ হওয়ার সম্ভাবনা কম ।
অ্যালবের্গ ও তাঁর সহকর্মীরা তারপর থেকে অনেক কপরোলাইটের ইমেজিং করেছে । এরমধ্যে একটা হল ডাইনোসোরের মতো। যার নাম স্মোক ওয়ায়েলস্কি (এর নাম দেওয়া হয় পোল্যান্ডের লোকসঙ্গীতের একটি ড্রাগনের নাম অনুসারে) । এটা পোল্যান্ডের একটি ভিন্ন প্রজাতির ট্রিয়াসিক । স্ক্যানের পরে জানা যায় যে এটা টি রেক্সের মতো হাড় গুঁড়ো করে ফেলতে পারে । এবং নিজের দাঁত খেয়ে ফেলার অভ্যাস ছিল ।
গবেষকরা উড়ন্ত সরীসৃপ পটেরোসোরের মল পরীক্ষা করে দেখেছেন । আর তাঁরা নিশ্চিত হয়েছেন যে এটা আধুনিক পেলিকেনদের মতো ফিল্টার ফিডার । আলবের্গ বলেন, ‘‘এখন আমরা পুরোটা জানতে পারি যে কপরোলাইটের ভিতরে কী আছে । এগুলি এখন খুব তথ্য সমৃদ্ধ হয়ে গিয়েছে ।’’ সহমত পোষণ করে চিন বলেন, ‘‘এর ফলে কপরোলাইট সম্পর্কে নতুন দিগন্ত খুলে গিয়েছে ।’’ এখন আলবের্গ ও তাঁর দলই একমাত্র পিপিসি-এআরমিউসিটি নিয়ে কপরোলাইট সম্পর্কে গবেষণা চালাচ্ছেন । কিন্তু তিনি বলেন, অন্যরা নিজেদের হাত নোংরা করতে চাইছে । একটা কপরোলাইটকে স্ক্যান করতে কয়েক মিনিট মাত্র সময় লাগে । এরমধ্যেই বড় আকারে জমা করতে পারেন । আলবের্গ বলেন, ‘‘আমরা এগুলিকে বড় প্লাস্টিকের টিউবে রেখে দিই । 25 থেকে 30টা একসঙ্গে স্ক্যান করি ।’’
সর্বশেষ ছবি তৈরি করা এবং সেগুলিকে বিশ্লেষণ করা যথেষ্ট সময় সাপেক্ষ । আলবের্গ বলেন, তিনি সারা জীবনের তথ্য একেবারে একটি দুপুরে সংগ্রহ করে ফেলতে পারেন । আর অনেক কপরোলাইট, ফলে কোনটায় আগে হাত দেওয়া উচিত, সেই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া খুবই কঠিন । কিন্তু যেটাতেই নজর দেওয়া হোক না কেন, তার মধ্যে সম্পদ ভরতি থাকে । এটা অনেকটা গোবরকে পিতলে রূপান্তর করার মতো ব্যাপার ।
(সি) 2020 নিউ সায়েনটিস্ট লিমিটেড
ডিসট্রিবিউটেড বাই ট্রিবিউন কন্টেন্ট এজেন্স, এলএলসি