কলকাতা, 4 নভেম্বর: ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে কয়েকদিন আগেই বাংলার জয়জয়কার হয়েছে ৷ কারণ সেরা দশ ভারতীয় চলচ্চিত্রের তালিকায় প্রথম সারিতে আজও স্থান করে নিয়েছেন সত্যজিৎ রায়-ঋত্বিক ঘটক-মৃণাল সেনরা ৷ কয়েকদিন আগে হওয়া এই সমীক্ষায় প্রথম স্থান পেয়েছে 'পথের পাঁচালি', দ্বিতীয় স্থানে 'মেঘে ঢাকা তারা' আর তৃতীয়তে জায়গা করে নিয়েছে 'ভুবন সোম' ৷ এই তিন অনবদ্য় সৃষ্টির কোনটি যে কার তা বোধহয় বাঙালিকে না-বলে দিলেও চলে ৷ একসময় ঋত্বিক বলতেন, "ভাবো ভাবো, ভাবা প্র্যাকটিস করো..." অর্থাৎ বোঝাতে চাইতেন ভাবনাও একটি অনুশীলনের বিষয় ৷ ঠিক সেই রসদই রেখে গিয়েছেন তিনি তাঁর ছবির মধ্যে ৷ যা আজও ভাবাচ্ছে বাঙালিকে(Ritwik Ghatak Birthday) ৷
সালটা ছিল 1925 । দিনটা 4 নভেম্বর ৷ ঢাকার রাজশাহী শহরের মিয়াঁপাড়ায় জন্ম কিংবদন্তি পরিচালক ঋত্বিক ঘটকের (Remembering Ritwik Ghatak on His Birthday)৷ মা ছিলেন ইন্দুবালা দেবী আর বাবা সুরেশ চন্দ্র ঘটক ৷ এইসব তথ্য় কমবেশি সকলেরই জানা ৷ বাবা সুরেশচন্দ্র পেশায় ম্যাজিস্ট্রেট হলেও নেশায় ছিলেন কবি ৷ আর সাহিত্যের এই জটিল মায়াপাশ এড়াতে পারেননি ঋত্বিক নিজেও ৷ 1946 সালে রাজশাহী কলেজ থেকে আই.এ এবং 1948 সালে বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজ থেকে বি.এ ডিগ্রি লাভ করার পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে মাস্টার ডিগ্রিতে ভর্তি হন ঠিকই কিন্তু পরীক্ষা আর দেওয়া হয়নি(Career Of Ritwik Ghatak) ।
চারদিকে তখন দেশভাগের যন্ত্রণা ৷ কলকাতার অলিগলিতে ভিটে মাটি হারানো মানুষের ভিড় ৷ খাবার নেই । পরনের কাপড় নেই ৷ এই যন্ত্রণা নিতে পারেননি ঋত্বিক ৷ অশোক মিত্রের মতো 'কবিতা থেকে মিছিলে'-ও যেমন তিনি সঙ্গী হয়েছেন, তেমনই মিছিলকেও তুলে এনেছেন তাঁর কলমে ৷ হাজারো প্রেমিকার প্রতি-প্রেমিকা হয়ে যাওয়ার এই দিনে তিনি বানিয়েছেন 'সুবর্ণরেখা'-র মতো ছবি ৷ যা ধাক্কা দিয়ে খসিয়ে দিতে চেয়েছে সভ্যতার নিটোল মুখোশ ৷
তাঁর মৃত্যুর পর বহু প্রবাদপ্রতীম মানুষের গলায় চিৎকার হয়ে উঠেছিল একটাই লাইন, "ঋত্বিক খুন হয়েছেন, একথা আমরা যেন ভুলে না যাই ৷" এই লাইন নিয়ে বিতর্ক হয়তো আছে ৷ কারণ সামাজিক যন্ত্রণায় নিষ্পেষিত হতে হতে যন্ত্রণার মৃত্যুকে হত্যা বলা যায় কি না, তা নিয়ে নানা মুনির নানা মত ৷ কিন্তু শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মতো কবি যখন লেখেন, "তুমি গেছ স্পর্ধা গেছে বিনয় এসেছে বাংলায় ৷" তখন আপামর বাঙালিকে আর বুঝিয়ে দিতে হয়না ঋত্বিক কোন কোহিনুর হীরার নাম ৷
বাংলা ভাগের যন্ত্রনা মানতে পারেননি ঋত্বিক ৷ ওপার বাংলা বললেই বারবার বলতেন, "বাংলার আবার এপার ওপার হয় নাকি মশাই ৷" ঋত্বিক সেই নদী যার বুকের ওপর দিয়ে আজও বয়ে যায় দুই বাংলার জল ৷ এই কিংবদন্তি পরিচালকের প্রথম ছবির নাম 'নাগরিক' ৷ যদিও শেষমেষ 1977 সালে মুক্তি পায় 1952 সালে তৈরি করা ঋত্বিকের এই ছবিটি ৷ এর আগে অবশ্য নিমাই ঘোষের 'ছিন্নমূল' ছবিতে সহকারী পরিচালক এবং অভিনেতা হিসাবে কাজ করেছেন তিনি ৷
এরপর তিনি সৃষ্টি করেন 'অযান্ত্রিক' এবং 'বাড়ী থেকে পালিয়ে'-র মতো ছবি ৷ আর তারপর একে একে তৈরি হয় 'মেঘে ঢাকা তারা', 'কোমল গান্ধার' এবং 'সুবর্ণরেখা' ৷ তবে 'মেঘে ঢাকা তারা' বাঙালির মন জয় করতে পারলেও বাকি ছবিগুলি প্রেক্ষাগৃহে সাফল্য এনে দিতে পারেনি ৷ কিন্তু ব্য়বসা সফল না-হলেও আজও বাঙালিকে ভাবনার খোরাক দেয় ঋত্বিকের এই কালজয়ী কাজগুলি ৷
আরও পড়ুন: শুটিংয়ের ফাঁকে লন্ডনে ছুটির মেজাজে করিনা করিশ্মা
1977 সালে মুক্তি পায় তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাজ 'যুক্তি তক্কো আর গপ্পো' ৷ যেখানে ঋত্বিক তাঁর দর্শন আর ভাবনাকে সুন্দরভাবে উজার করে দেন রূপোলি পর্দায় ৷ শুধু তাই নয় সময়ের এই দলিলে নিজের দ্বিধা দ্বন্দের বিষয়টিও খোলামনে তুলে ধরেছেন ঋত্বিক ৷ এই কিংবদন্তিকে সম্মানিত করা হয়েছে একাধিক পুরস্কারে ৷ 'যুক্তি তক্কো আর গপ্পো' ছবিটি শ্রেষ্ঠ কাহিনীকার বিভাগে ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জিতে নেয়। এছাড়া 'তিতাস একটি নদীর নাম' ছবির জন্য সেরা পরিচালক হিসাবে বাচসাস পুরস্কার লাভ করেন ঋত্বিক । তাঁকে সম্মানিত করা হয়েছে পদ্মশ্রী সম্মানেও ৷ তবে আজও ঋত্বিক একটি যন্ত্রণার নাম ৷ যে যন্ত্রণার কাঁটাতার বিছিয়ে রয়েছে সীমান্ত জুড়ে, তাঁর সঙ্গেই অঙ্গাঙ্গি হয়ে জড়িয়ে আছেন ঋত্বিক ঘটকও ৷