চব্বিশ ঘণ্টা উদারপন্থীদের প্রতিরোধ, আর তা নিয়ে মার্কিন সংবাদমাধ্যমের লাগাতার প্রচার, সবকিছুকে প্রতিহত করে ডোনাল্ড ট্রাম্প ওয়াশিংটনের স্থানীয় সময় অনুযায়ী বুধবার সকালে আমেরিকার 47তম প্রেসিডেন্ট হিসাবে পুনরায় নির্বাচিত হলেন ।
বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের পক্ষে হলিউডের অসংখ্য তারকা ছিলেন ৷ তাঁদের সমর্থন নিয়ে হ্যারিস খুবই উদ্যমী প্রচার চালিয়েছিলেন । টেলর সুইফট, বিয়ন্সে, জেনিফার লোপেজ, এমিনেম, বিলি আইলিশ, কার্ডি বি, হ্যারিসন ফোর্ড, রিচার্ড গেরে ও অপরা উইনফ্রেরা হ্যারিসকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদে বসানোর জন্য যথাসাধ্য প্রচার চালিয়েছেন ৷
রাজনৈতিক দিক থেকে প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও বিল ক্লিনটন এবং তাঁদের স্ত্রী মিশেল ওবামা ও হিলারি ক্লিনটন সক্রিয়ভাবে হ্যারিসের পক্ষে প্রচার চালিয়েছিলেন । প্রাক্তন ভাইস প্রেসিডেন্ট ডিক চেনি এবং তাঁর মেয়ে লিজ চেনি-সহ আমেরিকার জাতীয় নিরাপত্তা কমপ্লেক্সের 150টিরও বেশি সদস্য এবং আরও কয়েকশো রিপাবলিকানও হ্যারিসকে সমর্থন করেছিলেন ।
শেষ পর্যন্ত সবই ব্যর্থ হয়েছে ।
ট্রাম্প হ্যারিসকে ইলেক্টোরাল কলেজে 295-226-এ পরাজিত করেছেন ৷ দু’টি প্রদেশ, অ্যারিজোনা ও নেভাদায় এখনও ভোট গণনা চলছে । দু’টি প্রদেশেই ট্রাম্প এগিয়ে ৷ তাই তাঁর প্রাপ্ত ভোট আরও 20টির মতো বৃদ্ধি পেয়ে 312 পর্যন্ত যেতে পারে ৷ যাকে বিভক্ত মতামতের দেশে একটি অসাধারণ প্রাপ্তি বলা যেতেই পারে ৷ যদিও বিজয়ী হওয়ার জন্য একজন প্রার্থীর প্রয়োজন ছিল 270টি ইলেক্টোরাল কলেজ ভোট ।
ট্রাম্প একটি পরিচিত নাম
আমেরিকায় সবচেয়ে ধনী রাজনীতিবিদদের একজন হিসাবে ট্রাম্প বিশ্বব্যাপী গল্ফ রিসর্ট, বিলাসবহুল হোটেল এবং অ্যাপার্টমেন্টের মালিক । তিনি এনবিসি/ইউনিভার্সাল-এর একটি রিয়েলিটি শো-এর তারকা হিসেবেও পরিচিতি পান ৷ 2021 সালে ফেসবুক এবং এক্স (তখন টুইটার ছিল) থেকে তাঁকে নিষিদ্ধ করা হয় ৷ তার পরপরই তিনি ট্রুথ সোশাল নামে একটি সংস্থার নিয়ন্ত্রণ নেন ৷ তার পর সেটিকে নিজের সোশাল মিডিয়া কোম্পানি হিসেবে চালু করেন ৷ সেই কোম্পানির মূল্য 7 বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি । 2016 সালে তিনি সরাসরি মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন ৷ তার আগে তিনি কোনও রাজনৈতিক পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেননি ৷ প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন তিনি হোয়াইট হাউস থেকে বছরে মাত্র 1 ডলার বেতন হিসেবে নিতেন ৷
ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে আমেরিকার সীমান্ত নিরাপদ ছিল ৷ সেখানে সবচেয়ে কম অবৈধ অভিবাসী প্রবেশ করতে পেরেছিল ৷ মুদ্রাস্ফীতি কম ছিল এবং তাঁর পুরো মেয়াদে কোনও নতুন যুদ্ধ হয়নি । আমদানির উপর নির্ভর না-করেই প্রয়োজনীয় সমস্ত তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপাদনের মাধ্যমে ডিসেম্বর 2019-এ আমেরিকা প্রথমবারের মতো শক্তিক্ষেত্রে স্বাধীন হয়েছিল । ট্রাম্প একটি শক্তিশালী আমেরিকান সামরিক বাহিনীতে বিশ্বাস করেন এবং দেশের বিমান বাহিনীর পরিপূরক হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ বাহিনী তৈরি করেন ।
ম্যাগা (মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন) ম্যাজিক
ট্রাম্প ভোটারদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে তিনি আমেরিকাকে আবার মহান দেশে (মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন বা ম্যাগা) পরিণত করবেন ৷ একজন প্রাক্তন ব্যবসায়ী ও দ্য আর্ট অফ দ্য ডিল-এর লেখক হিসাবে তিনি আমেরিকাকে ব্যবসার মতো চালাতে চান ৷ বিদেশি সরকার এবং সংস্থাগুলির সঙ্গে এমন শর্তে তিনি চুক্তি করতে চান, যেখানে সাধারণ জ্ঞানের উপর ভিত্তি করে সবসময় ইনসেনটিভ ও ট্যারিফ বা শুল্কের মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনুকূলে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় ৷
গত মাসে শিকাগোর ইকোনমিক ক্লাবে বক্তৃতায় তিনি প্রকাশ করেছিলেন কীভাবে তিনি তাঁর দ্বিতীয় মেয়াদ চালাবেন । টয়োটার মতো কোনও বিদেশি গাড়ি প্রস্তুতকারক সংস্থা যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটি নতুন কারখানায় বিনিয়োগ করে, তাহলে তাদের শুধুমাত্র 15 শতাংশ হারে কর দিতে হবে । অথচ আমেরিকার বর্তমান কর্পোরেট করের হার 21 শতাংশ । যদি কোনও দেশ নিজেদের লাভের জন্য আমেরিকাকে সস্তায় পণ্য দেয়, তাহলে সেই দেশকে বেশি শুল্ক দিতে হবে ৷
দ্বিতীয় ট্রাম্প প্রশাসনের সময় ভারতের জন্য কী অপেক্ষা করছে ?
ট্রাম্প-মোদি বন্ধুত্ব সাহায্য করতে পারে
একজন ব্যবসায়ী হিসাবে ট্রাম্প যেকোনও সম্পর্কের মূল্যায়ন করেন ৷ আর একজন ভারতীয় নেতা এবং একজন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট, ট্রাম্প-মোদির মধ্যে সম্পর্ক বেশ উল্লেখযোগ্য । ট্রাম্প 2019 সালের সেপ্টেম্বরে হিউস্টনে হাউডি মোদি সমাবেশে যোগ দিয়েছিলেন ৷ সেটাই প্রথমবার ছিল, যখন কোনও মার্কিন প্রেসিডেন্ট কোনও সম্প্রদায়ের সমাবেশে অংশ নিয়েছিলেন । পাঁচ মাস পরে কোভিড-19 সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ার ঠিক আগে ট্রাম্প প্রথমবার ভারত সফরে আসেন এবং নরেন্দ্র মোদি ক্রিকেট স্টেডিয়ামে ‘নমস্তে ট্রাম্প’ সমাবেশে যোগ দেন । দু’টি সমাবেশেই অসাধারণ দর্শক সমাগম হয়েছিল ৷
মোদি ট্রাম্পের কাছ থেকে কিছু ক্ষেত্রে ছাড় পেতে পারেন ৷ যেমন শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক শক্তির জন্য প্রযুক্তি হস্তান্তর ৷ তার পরও ভারতের সতর্কতার সঙ্গে এগিয়ে যাওয়া উচিত ৷ মনে রাখা উচিত যে ট্রাম্প ভারতকে শাস্তি দিতে দ্বিধা করবেন না, যদি কোনও ক্ষেত্রে ট্রাম্প মনে করেন যে সেই সিদ্ধান্ত আমেরিকার সর্বোত্তম স্বার্থে হবে ।
ট্রাম্প ভারতীয় রফতানিতে শুল্ক আরোপ করতে পারেন
ট্রাম্পের অর্থনৈতিক রূপান্তর দলের প্রধান হাওয়ার্ড লুটনিক সিএনবিসি-তে একটি সহজ নিয়মের রূপরেখা দিয়েছেন, যা শুল্ক সম্পর্কে ট্রাম্পের দর্শন ব্যাখ্যা করে ৷ তিনি বলেন, "আমাদের তৈরি করা জিনিসগুলিতে শুল্ক আরোপ করা উচিত এবং আমরা যা করি না, তার উপর শুল্ক বসানো উচিত নয় ।"
কোন ভারতীয় রফতানি এতে প্রভাবিত হতে পারে ? 2022-2023 সালে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভারতের রফতানি প্রায় 80 বিলিয়ন মার্কিন ডলার অনুমান করা হয়েছিল । ফার্মা সেক্টরে রফতানির পরিমাণ প্রায় 12 বিলিয়ন মার্কিন ডলার ৷ এক্ষেত্রে শুল্ক আরোপ করার সম্ভাবনা নেই ৷ কারণ, আমেরিকাতে স্বাস্থ্য পরিষেবার খরচ ইতিমধ্যেই বেশি । বেশি শুল্কের জন্য ভারতীয় নির্মাতারা আমেরিকান ক্রেতাদের জন্য দাম বৃদ্ধি করুক, সেটা ট্রাম্প চাইবেন না ৷ আমাদের মনে রাখা উচিত যে ট্রাম্পের দৃষ্টিভঙ্গিতে আমেরিকা সর্বদা প্রথমে আসে ।
রত্ন ও গয়না শিল্প, বিশেষ করে হিরে রফতানিতে শুল্ক আরোপ করার সম্ভাবনা নেই ৷ কারণ, আমেরিকায় এই ধরনের কোনও শিল্প নেই ৷ এই শিল্পে প্রতি বছর 10 বিলিয়ন মার্কিন ডলার রফতানি হয় ৷
ট্রাম্প যদি উদ্বিগ্ন হন যে আমেরিকান কোম্পানিগুলি ভারতে অত্যধিক প্রযুক্তি এবং ব্যাক-অ্যান্ড কাজ আউটসোর্স করছে, যার ফলে আমেরিকানরা চাকরি হারাচ্ছে, তাহলে তিনি ভারতীয় প্রযুক্তি বিক্রেতাদের উপর শুল্ক আরোপ করতে পারেন । এই ধরনের পদক্ষেপ ভারতের লাভ কমিয়ে দেবে ৷ আমেরিকান গ্রাহকদের কাছ থেকে ওই শুল্কের টাকা ঘুরপথে নিয়ে একমাত্র সেই ধাক্কা সামলানো যেতে পারে ৷ কিন্তু এই কাজ করা বেশ কঠিন । ভারতে কম অপারেটিং মার্জিনের অর্থ হতে পারে আরও বেশি চাহিদাপূর্ণ কর্মক্ষেত্র, এমনকি বর্তমানের চেয়েও বেশি হতে পারে ।
বস্ত্র ও পোশাক (রফতানির পরিমাণ 16-18 বিলিয়ন মার্কিন ডলার), অটোমোবাইল ও উপাদান (রফতানির পরিমাণ 5-7 বিলিয়ন মার্কিন ডলার) এবং মশলা ও সামুদ্রিক খাবারের মতো কৃষি পণ্য (রফতানির পরিমাণ 5 বিলিয়ন মার্কিন ডলার) - এগুলির উপর ট্রাম্প শুল্কের বোঝা চাপাতে পারেন ৷ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ট্রাম্পের সঙ্গে আলোচনা করলে এই সমস্যার সমাধান হতে পারে ৷
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ হবে
ট্রাম্প বারবার রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য ইউক্রেনে বিলিয়ন বিলিয়ন অর্থ পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ৷ তিনি 24 ঘন্টার মধ্যে যুদ্ধ শেষ করে দেবেন বলেও জানিয়েছিলেন । আমেরিকা ইতিমধ্যেই যুদ্ধের জন্য 200 বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় করেছে ৷ ট্রাম্প মনে করেন আমেরিকার পরিকাঠামোর উন্নতিতে ওই টাকা ব্যবহার করলে আরও ভালো হতো ।
রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা করার পর থেকে প্রধানমন্ত্রী মোদি একটি সূক্ষ্ম ভারসাম্য বজায় রেখে কাজ করেছেন । মোদি কখনও বলেননি যে রাশিয়ার দোষ ছিল ৷ কিন্তু ধারাবাহিকভাবে বলেছেন যে যুদ্ধ বন্ধ করে শান্তি আলোচনা শুরুর উপর নজর দেওয়া উচিত ৷ বাইডেন-হ্যারিস প্রশাসন রাশিয়া নিয়ে ভারতের অবস্থানকে ঘৃণা করেছিল ৷ এমনকী ভারতের বিরুদ্ধে গৌণ অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার হুমকিও দিয়েছিল ৷ এই নীতি হ্যারিস জয়ী হলে অব্যাহত থাকত ।
যুদ্ধ শেষ হলে ট্রাম্প আমেরিকার নিষেধাজ্ঞার শাসনকে সরিয়ে দেবেন ৷ রাশিয়ান তেল সরবরাহের ক্ষেত্রকে আরও সহজ করবেন ৷ বিশ্বব্যাপী তেলের উৎপাদন বৃদ্ধি করবেন ও পাম্পের দাম কমিয়ে দেবেন । ভারতের অর্থমন্ত্রক চায় পাম্প থেকে জিএসটির মাধ্যমে রাজস্ব আসতে থাকে ৷ তাই বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমলেও পেট্রল, ডিজেল এবং গ্যাসের দাম কমানোর সম্ভাবনা নেই ৷ তবে এটা ট্রাম্পের সঙ্গে সম্পর্কিত নয় ৷ এটা ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় ।
সরবরাহ শৃঙ্খলে বৈচিত্র আনার প্রচেষ্টা ভারতকে সাহায্য করবে
ট্রাম্প চিনকে একটি উল্লেখযোগ্য হুমকি হিসেবে দেখেন এবং বিশ্বের সরবরাহ শৃঙ্খলকে চিন থেকে দূরে সরিয়ে বৈচিত্র্য আনতে ভারতে বিনিয়োগ করতে ইচ্ছুক । ট্রাম্প প্রশাসন আমেরিকান কোম্পানিগুলিকে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক প্রসারিত করতে এবং একটি প্রাণবন্ত উৎপাদন অর্থনীতি হিসাবে ভারতের অবস্থান বৃদ্ধিতে সাহায্য করতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে ৷
এইচ-1বি, গ্রিন কার্ড ও ফ্যামিলি ভিসা
ট্রাম্প বারবার বলেছেন যে তিনি অবৈধ অভিবাসীদের নির্বাসন দেবেন, তবে তিনি বৈধ অভিবাসনের পক্ষে । ট্রাম্প ইলন মাস্কের একজন ভক্ত, যিনি দক্ষিণ আফ্রিকায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হয়েছিলেন । পেপ্যাল, টেসলা, স্পেসএক্স ও স্পেসলিংকের প্রতিষ্ঠাতা এবং এক্স-এর মালিক মাস্ক ট্রাম্পের অন্যতম উৎসাহী সমর্থক । মাস্ক বারবার বলেছেন যে গ্রিন কার্ড দেওয়ার সময় মেধার ব্যাপারটা থাকা উচিত । ট্রাম্প মার্কিন কংগ্রেসের সঙ্গে একত্রে একটি চুক্তি করতে পারেন, যেখানে অবৈধ এবং আইনি অভিবাসন উভয় সমস্যারই সমাধান করা হবে ।
হ্যারিসের চেয়ে ট্রাম্প ভারতের অনেক ভালো অংশীদার
কমলা হ্যারিসের মা একজন দক্ষিণ ভারতীয় তামিল ব্রাহ্মণ ৷ হ্যারিস নিজেকে কৃষ্ণাঙ্গ হিসাবে চিহ্নিত করেছিলেন ৷ তিনি ভারত-মার্কিন সম্পর্ককে এগিয়ে নিতে অর্থবহ কিছুই করেননি ।
অভিনন্দন, মিস্টার প্রেসিডেন্ট-ইলেক্ট !