কলকাতা, 10 ফেব্রুয়ারি: প্রায় 11 মাস পর পড়ুয়াদের জন্য ফের খুলছে স্কুল। তবে, আপাতত নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পঠনপাঠন চালু হচ্ছে। মহামারির কারণে প্রথমে লকডাউন, তারপর আনলক পর্ব। ধীরে ধীরে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরছে সবকিছু। এবার খুলে যাচ্ছে স্কুলও৷ এতদিন পর ফের স্কুলে যাওয়ার সুযোগ পেয়ে কোনও সমস্য়া হবে কি পড়ুয়াদের? কী বলছেন চিকিৎসকরা?
মনোবিদ সঞ্চিতা পাকড়াশি বলেন, ‘‘আমার মনে হয়, স্কুল খুললে পড়ুয়াদের মানসিক সমস্যাগুলি কমবে। দীর্ঘ লকডাউনে স্কুল-কলেজ, সব স্তরের পড়ুয়াদের মধ্যে মানসিক সমস্যা বেড়েছে৷ নিয়মিত আমাদের কাছে পড়ুয়ারা আসছে। সমস্যা বলতে ড্রাগ অ্যাডিকশন বেড়ে গিয়েছে, মোবাইল অ্যাডিকশন বেড়ে গিয়েছে৷ কিছু কিছু ক্ষেত্রে যাদের সোশ্যাল-ইকোনমিক স্ট্যাটাস লো, একটু গ্রাম্য জায়গা যেখানে, সেখানে স্কুল বন্ধ থাকার কারণে মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেওয়া হচ্ছে, ছেলেরা নেশার মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে, নয়তো কাজের জায়গায় চলে যাচ্ছে। তাদের পড়াশোনা, কেরিয়ারের ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। কারণ, সব জায়গায় অনলাইনে পড়াশোনা করার মতো উপায় বা পরিকাঠামো নেই। স্কুল যদি খোলে তাহলে কোনও জায়গায় কোনও সমস্যার প্রশ্নই নেই। কারণ, যেটা স্বাভাবিক জীবন, সেটাকে রুদ্ধ করে রাখা হয়েছিল। এর জন্য যথেষ্ট কারণও ছিল। তবে, সেই রুদ্ধ জায়গাটাকে আবার খুলে দেওয়া হচ্ছে।’’
সঞ্চিতা পাকড়াশির মতে, ‘‘স্কুল খুললে বাচ্চারা আরও বেশি এনজয় করবে৷ আরও বেশি পজিটিভ হবে৷ বাড়িতে বসে থাকার জন্য তাদের মধ্যে যে হতাশা হচ্ছে, আচরণগত নানা পরিবর্তন দেখা দিচ্ছে, এগুলি সব চলে যাবে, এটা আমার বিশ্বাস। স্কুল খোলার অপেক্ষায় আমিও ছিলাম৷ কলেজ খোলার অপেক্ষায় আমিও আছি।’’
কিন্তু কেন? তিনি বলেন, ‘‘কারণ, এরা আমাদের দেশের, সারা পৃথিবীর ভবিষ্যৎ। এদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রার জায়গাটিকে যেই মুহূর্তে বন্ধ করে রেখে দেওয়া হয়েছে, সেই মুহূর্ত থেকে যা স্বাভাবিক, তা নষ্ট হয়ে গিয়েছে। এই সময় কত ধরনের যে কেস আসছে৷ এর কারণ তাদের ঘেরাটোপের মধ্যে বসিয়ে রাখা হয়েছে। সব সময় মা-বাবা, পরিবারের সকলের সঙ্গে রয়েছে তারা৷ এর বাইরে কোনও সোশাল লাইফ নেই।"
আরও পড়ুন: 12 ফেব্রুয়ারি থেকে চালু নবম-দ্বাদশ শ্রেণির পঠনপাঠন, জারি বিজ্ঞপ্তি
মহামারিতে অনলাইনে ক্লাস চালু হয়েছে। কিন্তু, এভাবে ক্লাস করানোই কি যথেষ্ট? সঞ্চিতা পাকড়াশি বলেন, ‘‘অনলাইনে তো বন্ধুর সঙ্গে হাসাহাসিও করা যায় না, খেলাও যায় না। স্কুল খুললে এই জায়গাগুলি থেকে সম্পূর্ণ মুক্তি ঘটবে, এটা সদর্থক।’’
শুক্রবার নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির পড়ুয়াদের জন্য স্কুল খুলছে। যারা নিচু ক্লাসগুলিতে রয়েছে, তাদের ক্ষেত্রেও কি একই কথা বলবেন? এই মনোবিদ বলেন, ‘‘তাদের ক্ষেত্রেও একই কথা বলব। কারণ আমাদের স্কুলের যে সিস্টেম, যে ডিসিপ্লিন, বাড়ি থেকে এতটা সময় বাচ্চারা স্কুলে গিয়ে থাকে, এর জন্য তাদের সারাদিনের ডিসিপ্লিন্ড একটা লাইফ আছে। এর জন্য তাদের কিছু প্রপার রুটিনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। সব কিছুই একটা শিডিউলের মধ্যে চলছিল এত বছর। এই শিডিউল মুহূর্তে নষ্ট হয়ে গেল। এটা অভূতপূর্ব ঘটনা। বাচ্চারাও জানে না, তাদের মা-বাবারাও জানেন না যে এই অবস্থায় কিভাবে, কী করতে হবে, বাচ্চাদের কিভাবে ভুলিয়ে রাখতে হবে।’’
এ কথার পাশাপাশি সঞ্চিতা পাকড়াশি বলেন, ‘‘বাচ্চার বয়স যত কম, তার ম্যাচুরিটি লেভেলও তত কম। স্কুলের অনলাইন ক্লাসে সে তো আর সবকিছু বুঝতে পারছে না। হঠাৎ আসা এই পরিবর্তনে বাচ্চাদের সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করেছে বলে আমার মনে হয়। সবই যখন খুলে যাচ্ছে, হাজার হাজার মানুষ পলিটিক্যাল কর্মসূচি করতে পারছেন, হাজার হাজার মানুষ বিভিন্ন জায়গায় দাঁড়িয়ে উৎসব করতে পারছেন, মেলা করতে পারছেন। তাহলে স্কুলের ব্যাপারে বাচ্চাদের কেন আটকে রাখা হচ্ছে? এর কোনও সদুত্তর আমার কাছে নেই। আমি সবসময় চাইব, বাচ্চাদেরকে তাদের জায়গাটা ফিরিয়ে দেওয়া হোক, তারা স্কুল-কলেজে যাওয়া আসা করতে শুরু করুক। তাদের সোশ্যাল লাইফ তো ওটাই, স্কুল বন্ধ তো সব বন্ধ।’’
কেপিসি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের ডিপার্টমেন্ট অফ ফিজিওলজির ফ্যাকাল্টি তীর্থঙ্কর গুহ ঠাকুরতা বলেন, ‘‘এখন হাসপাতালগুলিতে যে অবস্থা দেখা যাচ্ছে, তাতে কোরোনার সক্রিয় রোগীর সংখ্যা অনেক কমে গিয়েছে। পাশাপাশি, টিকাকরণ শুরু হয়েছে। যদি স্কুলেও টিকাকরণ শুরু করতে পারি, তাহলে স্কুল খোলা যেতে পারে। তবে কোরোনা প্রতিরোধের জন্য আমাদের ব্যবস্থা নিতে হবে।’’
প্রায় এক বছর ধরে স্কুলে যেতে পারেনি। এরপরে আবার স্কুলে যেতে পারবে। এর ফলে বিশেষ করে পড়ুয়াদের কি কোনও সুবিধা হল? তীর্থঙ্কর গুহ ঠাকুরতা বলেন, ‘‘এই বিষয়টি পড়ুয়াদের বয়সের উপর অনেকটা নির্ভর করবে। নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ুয়াদের ক্ষেত্রে আমার মনে হয় স্কুলে যাওয়া-না যাওয়ার মধ্যে বিশেষ কোনও পার্থক্য নেই। কারণ তাদের পড়াশোনা তারা নিজেরাই সামলাতে পারে। তবে যে বিষয়টির জন্য স্কুলে তাদের যাওয়ার দরকার, সেটা হল সামাজিক আদানপ্রদান। এই বয়সে বন্ধু পাওয়া খুব দরকার এবং এটা অনলাইনে কখনওই হয় না।’’