কলকাতা, 24 মার্চ: কলকাতা সহ দেশের অন্যতম বিজ্ঞান-চর্চার কেন্দ্র যাদবপুরের ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অফ সায়েন্সে (আইএসিএস) বাধ্যতামূলক হিন্দি ভাষা ব্যবহারের নির্দেশিকা জারি করল কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক। কেন্দ্রের এই নির্দেশিকাকে ঘিরে এবার চরম বিতর্ক ৷ কতটা যুক্তিযুক্ত এই নির্দেশিকা? সেই নিয়ও প্রশ্ন উঠেছে।
গত 19 মার্চ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের তরফে হিন্দি ভাষা বেশি করে ব্যবহারের নির্দেশিকা দেওয়া হয় ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অফ সায়েন্সকে। প্রতিষ্ঠানের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার পূর্বাশা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বাক্ষরিত সেই নির্দেশিকা প্রতিষ্ঠানের সকল ডিন, প্রতিটি বিভাগ ও স্কুলের প্রধানদের কাছেও পাঠানো হয়েছে। যা প্রকাশ্যে আসতেই প্রতিষ্ঠানের অন্দরে ও বাইরে বিতর্ক দানা বেঁধেছে। আর সেই নির্দেশিকাকে ঘিরে শুরু হয়েছে প্রতিবাদ ৷
কী বলা হয়েছে বিতর্কিত সেই নির্দেশিকায় ? নির্দেশিকার প্রথমেই বলা হয়েছে, ‘‘ভারত সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের ভাষা বিভাগের দেওয়া সরকারি ভাষার লক্ষ্যমাত্রা পূরণে প্রতিষ্ঠান কাঙ্ক্ষিত ফলাফল করছে না । আমরা এর বিরুদ্ধে ডিপার্টমেন্ট অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি থেকে চিঠি পেয়েছি। এটা অত্যন্ত উদ্বেগজনক পরিস্থিতি। অফিশিয়াল ল্যাঙ্গুয়েজ কতটা প্রয়োগ করা হচ্ছে, তা খতিয়ে দেখতে খুব তাড়াতাড়ি ডিপার্টমেন্ট অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির আধিকারিকরা প্রতিষ্ঠানে আসবেন।’’ এই পরিস্থিতিকে সামনে রেখেই হিন্দি ভাষা ব্যবহার সংক্রান্ত আট দফা নির্দেশ দেওয়া হয়েছে ৷ আর সেগুলি যাতে লাগু করা হয় তা দেখতে বলা হয়েছে বিভাগীয় প্রধানদের। পাশাপাশি, প্রতিষ্ঠানে একজন হিন্দি অফিসার নিয়োগ করা হয়েছে বলেও জানানো হয়েছে কর্তৃপক্ষের তরফে। যিনি হিন্দিকে সরকারি ভাষা হিসেবে প্রয়োগের ক্ষেত্রে সাহায্য করবেন।
আট দফা নির্দেশের মধ্যে প্রথমেই রয়েছে, মোট চিঠিপত্রের 55 শতাংশ হিন্দিতে হতে হবে। হিন্দিতে পাওয়া চিঠির উত্তর হিন্দিতেই দিতে হবে। ফাইলে নোট করার ক্ষেত্রে 33 শতাংশ হিন্দিতে লিখতে হবে। ফাইলে দুটি ভাষাতে নাম লিখতে হবে। যেমন, হিন্দি এবং ইংরেজি। হিন্দিতে আগে লিখতে হবে এবং তারপরে ইংরেজিতে। সার্ভিস বুকে এন্ট্রি যতটা সম্ভব হিন্দিতে করতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিক কাজের ক্ষেত্রে যখন যেমন প্রয়োজন, তখন সেইভাবে ফাইলে হিন্দিতে সই করতে হবে। অফিশিয়াল ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যাক্টের সেকশন 3(3) 100 শতাংশ মেনে চলা নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়া, প্রতিটি বিভাগকে হিন্দি সেলে কোয়ার্টার্লি প্রোগ্রেস রিপোর্ট পাঠাতে বলা হয়েছে। এই আট দফা নির্দেশের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিতে বলা হয়েছে ওই চিঠিতে ।
এই নির্দেশিকা প্রকাশ্যে আসতেই বিতর্কের ঝড় বয়ে যায় সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞানী সহ বিভিন্ন মহলে। প্রতিবাদ হয় প্রতিষ্ঠানের অন্দরেও। সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘এটা অত্যন্ত অন্যায়। এটা ঠিক নয়। এটাকে একেবারেই সমর্থন করা যায় না। আমাদের তো হিন্দি চর্চা করতেই হবে এরকম কোনও ব্যাপার নয়। কারণ, হিন্দি আমাদের রাষ্ট্রীয় ভাষা নয়। এটা একটা অফিশিয়াল ভাষা। ইংরেজি ও হিন্দি দুটোই সমান গুরুত্বপূর্ণ ভাষা। যাঁরা হিন্দি জানেন না বা হিন্দি চর্চা করেন না, তাঁদের উপর হিন্দি জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে কেন? এটা তো গা-জোয়ারি হয়ে যাচ্ছে । এটা একদমই ঠিক নয়।’’
আরও পড়ুন : চাকরিপ্রার্থীদের বিক্ষোভ ঘিরে মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির কাছে উত্তেজনা
বিতর্ক দেখা দিতেই গতকাল, 23 মার্চ আইএসিএস-এর ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার আরও একটি নির্দেশিকা জারি করেন। জানানো হয়, 19 মার্চের নির্দেশিকাকে সরিয়ে এই নির্দেশিকাটি বহাল করা হয়েছে। নতুন নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, ডিপার্টমেন্ট অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি 26 ফেব্রুয়ারি চিঠি পাঠিয়ে আইএসিএস-তে অফিশিয়াল ল্যাঙ্গুয়েজ ইম্প্লিমেন্টেশনে অভাবের কথা জানিয়েছে। প্রত্যেককে বলা হচ্ছে এটি নোট করতে এবং কোনও সাহায্য লাগলে প্রতিষ্ঠানের আংশিক সময়ের হিন্দি অফিসারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে। নতুন নির্দেশিকায় কত শতাংশ হিন্দি ব্যবহার করতে হবে বা হিন্দিতে সই করতে হবে, এই ধরনের কোনও নির্দেশের কথা লেখা হয়নি।
যদিও, আগের সেই নির্দেশিকার বিরুদ্ধে এখনও প্রতিবাদ চলছে । আজ বিকেল সাড়ে চারটে নাগাদ যাদবপুরে আইএসিএসের সামনে বিক্ষোভ দেখানো হয় ‘বাংলা পক্ষে’র তরফে ৷ বাংলা পক্ষের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব গর্গ চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অফ সায়েন্স বাংলা ও বাঙালির মনীষী মহেন্দ্রলাল সরকারের তৈরি। আজকে সেখানে হিন্দি সাম্রাজ্যবাদী কেন্দ্রীয় সরকার নির্দেশিকা দিচ্ছে, ফাইল, নোট ইত্যাদি হিন্দিতে করতে হবে। দিল্লি একটা হিন্দি অফিসার রাখবে এগুলো হচ্ছে কি না দেখার জন্য। এটা কি ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অফ হিন্দিতে পরিণত হয়েছে সায়েন্সের জায়গায়? এটা করা হবে কেন? শুধু এখানে নয়, বাংলার বুকে প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এই নোংরামোটা চালানো হচ্ছে। অর্থাৎ, আজকে হিন্দি জানলে বিজ্ঞান গবেষণা করতে পারবেন। সত্যেন বোস হিন্দি জানতেন না, জগদীশচন্দ্র বসু হিন্দি জানতেন না। কিন্তু, তাঁরা বিজ্ঞানী। এটা অন্য কোথাও করতে পারবে? আমরা বাংলা পক্ষ বাংলায় হিন্দি সাম্রাজ্যবাদের প্রতিটি কোনা উপড়ে ফেলব।’’ এদিনের প্রতিবাদ কর্মসূচিতে বিক্ষোভকারীরা 19 মার্চের নির্দেশিকার প্রতিলিপি পোড়ায় ।