কলকাতা, 6 সেপ্টেম্বর: কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে ‘মাল্টি ডিসিপ্লিনারি’ (Multi disciplinary education) বা বহুমুখী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করতে হবে । সম্প্রতি একটি নির্দেশিকা জারি করে এমনটাই জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বা ইউজিসি (UGC New Guidelines)। যদিও শিক্ষা মহলে ইতিমধ্যেই এই নির্দেশিকাকে ঘিরে বিতর্কের ঝড় উঠেছে । একাংশের মতে, জাতীয় শিক্ষা নীতির অন্তর্গত এই ধরনের পদক্ষেপ শিক্ষাকে বেসরকারিকরণের দিকে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা মাত্র ।
কী রয়েছে এই নির্দেশিকায় ?
এই নোটিফিকেশন অনুসারে পড়ুয়াদের ইচ্ছে মতো বিষয়গুলি নিয়ে পঠন পাঠনকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে । সে ক্ষেত্রে যদি নির্দিষ্ট কোনও উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পছন্দের বিষয়টি না থাকে, তবে যে প্রতিষ্ঠানে সেই বিষয়টি রয়েছে সেখানে তা পড়া যাবে । অর্থাৎ প্রতিটি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে যোগাযোগ তৈরি করে শিক্ষাদানের উপর জোর দেওয়া হয়েছে ।
এ ছাড়াও ক্লাস্টার তৈরি করার কথা বলা হয়েছে । অর্থাৎ একাধিক কলেজকে নিয়ে কলেজের ক্লাস্টার গঠন করতে হবে । ফলে এক কলেজের পড়ুয়া অন্য কলেজে গিয়ে তাঁর ইচ্ছে মতো বিষয়টি নিয়ে পড়াশোনা চালাতে পারবে । দেওয়া হবে দ্বৈত ডিগ্রি । ‘অ্যাকাডেমিক ব্যাংক অফ ক্রেডিট’ চালু করার পরিকল্পনা রয়েছে নির্দেশিকায় । অর্থাৎ একটি উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কিছু দিন পড়ার পরে সেই প্রতিষ্ঠান ছেড়ে অন্য প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পারবেন ছাত্রছাত্রীরা । পড়াশোনার ক্ষেত্রে অনলাইন ও ডিসট্যান্স লার্নিং বা দূরশিক্ষার উপরও জোর দেওয়া হয়েছে ।
কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে মোট তিনটি ভাগে ভাগ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে ৷ বহুমুখী গবেষণা ভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয়, বহুমুখী পঠনপাঠন নির্ভর বিশ্ববিদ্যালয় এবং স্বশাসিত বহুমুখী কলেজ - যাদের কোনও অ্যাফিলিয়েশন লাগবে না । সেই সব কলেজ নিজেরাই ডিগ্রি দিতে পারবে ।
এই নয়া নির্দেশিকা সামনে আসার পরেই শিক্ষা মহলে শুরু হয়েছে বিতর্কের ঝড়। রাজ্য কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির (ওয়েবকুটা) সাধারণ সম্পাদক কেশব ভট্টাচার্য জানিয়েছেন, ‘‘এই নীতির বাস্তবায়ন হলে পড়ুয়ারা কোনও বিষয়ই ভালো করে শিখে উঠতে পারবে না । পঠনপাঠন হবে খাপছাড়া ভাবে । পাশাপাশি সমস্ত কলেজকে স্বশাসিত করে দেওয়ার যুক্তিও ভিত্তিহীন । কারণ সমস্ত কলেজের মান একরকম নয় ।"
আরও পড়ুন: বিভিন্ন ক্ষেত্রের অভিজ্ঞ পেশাদারদের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ানোর সুযোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত ইউজিসির
এআইডিএসও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সম্পাদক মণিশংকর পট্টনায়ক বলেন, "ইউজিসি'র 2 সেপ্টেম্বর'22 নির্দেশিকা আবারও প্রমাণ করল জাতীয় শিক্ষানীতি 2020 প্রণয়নের সময় কেন্দ্রের বিজেপি সরকার এই শিক্ষানীতিকে যতই বিপ্লবাত্মক, ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত বা গণশিক্ষার সহায়ক আখ্যা দিক না কেন, আসলে তা পুঁজিবাদীদের ব্যবসা করার ছাড়পত্র । জাতীয় শিক্ষানীতি 2020 প্রণয়নের সময় থেকেই আমরা যে কারণে এর সার্বিক প্রতিবাদ করছি । এই শিক্ষানীতিতে 'মাল্টি' শব্দটি বহুল ব্যবহার যেমন মাল্টিপল এক্সিট, মাল্টি পয়েন্ট , মাল্টিপল এন্ট্রি, মাল্টি ডিসিপ্লিনারি ব্যাচেলর ডিগ্রি, মাল্টিডিসিপ্লিনারি কোর্স, মাল্টি ডিসিপ্লিনারি এডুকেশনাল ইনস্টিটিউশন প্রভৃতির মধ্যে দিয়ে জ্ঞান অর্জন করার শৃঙ্খলা ও বিজ্ঞানকেই অস্বীকার করা হয়েছে । এই শিক্ষানীতিতে তথাকথিত হলিস্টিক এডুকেশন, মাল্টিডিসিপ্লিনারি লার্নিং'এর মাধ্যমে একজন ছাত্র কিংবা ছাত্রী ইন্টার ডিসিপ্লিনারি কোর্সের নিয়মকে অস্বীকার করে নির্দিষ্ট একটি কোর্সে বহুবিধ বিষয় বেছে নিতে পারবে ৷ আবার ছয় মাস পরে পরবর্তী সেমেস্টারে গিয়ে তা ছেড়ে দিতেও পারবে । শুধু তাই নয়, এর ভিত্তিতেই বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে অ্যাকাডেমিক ক্রেডিট সংগ্রহ করতে পারবে । দ্বৈত ডিগ্রিরও সুযোগ থাকবে । এই ধরনের ব্যবস্থাপনায় স্বভাবতই পরিকাঠামোগত দুরবস্থা ঢাকা দিতে অনলাইন এডুকেশনে জোর দেওয়া হবে ।"
তিনি আরও বলেন, "আমরা মনে করি, এই পদ্ধতিতে শিক্ষাদান ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে যথার্থ জ্ঞান গড়ে তোলার উপযুক্ত পদ্ধতি নয় । মাল্টি ডিসিপ্লিনারি কোর্সের ক্ষেত্রে জাতীয় শিক্ষানীতি বলছে সায়ান্স, টেকনোলজি, ইঞ্জিনিয়ারিং, ম্যানেজমেন্টের প্রযুক্তিগত শিক্ষায় শিক্ষিত বাজারের প্রয়োজনের ভিত্তিতে উপযুক্ত একদল মানুষ চাই । অর্থাৎ স্পষ্টতই টেকনোক্র্যাট তৈরির জন্যই এই মাল্টিডিসিপ্লিনারি এডুকেশন । আসলে কর্পোরেট প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকার জন্য প্রযুক্তিগত দক্ষতার প্রয়োজন, জ্ঞানের গভীরতার কোনও প্রয়োজন নেই । স্বভাবতই এই শিক্ষা ব্যবস্থায় সংস্কৃতি, নৈতিকতা, বিজ্ঞান ভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি ও সমাজ ভাবনার সঙ্গে শিক্ষার্থীর কোনও সম্পর্ক থাকবে না । শিক্ষার যথার্থ উদ্দেশ্য ও প্রাণসত্ত্বা ধ্বংস হবে । আসলে এর মধ্য দিয়ে ইন্টার ডিসিপ্লিনারি হায়ার এডুকেশন ইনস্টিটিউটগুলি ধীরে ধীরে অবলুপ্ত হয়ে যাবে এবং তার জায়গায় তৈরি হবে মাল্টিডিসিপ্লিনারি হায়ার এডুকেশন ইনস্টিটিউট ক্লাস্টার । যা কার্যত স্পেশাল ইকনমিক জোনের মতোই অগণতান্ত্রিক । এই ক্লাস্টারগুলিতে ছাত্র-শিক্ষক অধিকার, শিক্ষার ব্যবস্থাপনা, সবটাই চলবে কর্পোরেটদের মর্জিমাফিক । অসংখ্য ছাত্রছাত্রী আগামী দিনে শিক্ষা থেকে দূরে চলে যাবে । জাতীয় শিক্ষানীতি-20 অনুযায়ী ইউজিসি'র এই মাল্টি ডিসিপ্লিনারি এডুকেশনের সার্কুলারের লক্ষ্য শিক্ষাকে চূড়ান্ত ভাবে বেসরকারীকরণ করা । আমরা এর তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি, শুধু তাই নয়, দেশজুড়ে ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবকদের প্রতিবাদী স্বাক্ষর সংগ্রহ করে এই শিক্ষানীতি বাতিলের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তুলছি । এই আন্দোলনে সবাইকে শামিল হওয়ার আহ্বান জানাই ।"
পাশাপাশি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক পার্থপ্রতিম রায় বলেন, "কিছু কিছু করে বিষয় নিয়ে এ ভাবে পড়াশোনা করার পঠন-পাঠনের নীতি যুক্তিযুক্ত নয় । কারণ গবেষণা করার সময় যেভাবে একটি বিষয়ের উপর পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান রাখতে হয়ে এই ক্ষেত্রে সেটা সম্ভব নয় । একটি বিষয় নিয়ে গভীরভাবে পড়াশোনা না করলে গবেষণার ক্ষেত্রে প্রতি পদে সমস্যা সৃষ্টি হবে ।"