কলকাতা, ১৪ মার্চ : তলপেট ফুলে গিয়ে ঢোল হয়ে গেছিল। সঙ্গে যৌনাঙ্গে হচ্ছিল রক্তপাত। মলত্যাগও নিয়মিত হচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত জটিল অস্ত্রোপচারে প্রাণ ফিরে পেলেন বছর বত্রিশের এক যুবতি। নাম উমা কুইল্যা। রঘুনাথপুরের বাসিন্দা। ঘটনাটি NRS মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের। মঙ্গলবার গভীর রাতে তিন ঘণ্টার এই অস্ত্রোপচার সফল হয়েছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
NRS মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের চিকিৎসক অনির্বাণ দাসের অধীনে মঙ্গলবার রাত দুটো নাগাদ শুরু হয় এই অস্ত্রোপচার। পাঁশকুড়ার রঘুনাথবাড়ির বাসিন্দা বছর বত্রিশের এই রোগী সম্পর্কে NRS-এর এক চিকিৎসক জানিয়েছেন, রোগী প্রথমে ভরতি ছিলেন গাইনি ওয়ার্ডে। তাঁর অনেকগুলি সমস্যা ছিল। তিনি বলেন, "এর মধ্যে একটি ছিল পেটের ডান দিকে, তলপেটের নিচে অ্যাপেনডিক্সের জন্য আগে অস্ত্রোপচার হয়েছিল, সেই জায়গায় হার্নিয়া হয়েছিল। পেটে একটি বড় টিউমারও ছিল। টিউমারটি তলপেট থেকে পেটের উপরের অংশ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। টিউমারটি খাদ্যনালির উপরে চাপ দেওয়ার জন্য রোগীর মলত্যাগ অনিয়মিত হচ্ছিল। এই সমস্যার জন্য সার্জারির বহির্বিভাগে রোগীকে গতকাল পাঠানো হয়।"
রোগী তিন চারদিন ধরে মলত্যাগ করতে পারছিলেন না। রোগীকে দেখে এই বিভাগের চিকিৎসকদের মনে হয়, হার্নিয়া থেকে খাদ্যনালি আটকে যাওয়ার সমস্যা রয়েছে। এর সঙ্গে একটি টিউমার ছিল। CT স্ক্যান রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০x২০ সেন্টিমিটারের টিউমারটি ডান দিকের ডিম্বাশয় থেকে তৈরি হয়েছে। এই টিউমারটি জরায়ুর সঙ্গেও জড়িয়ে ছিল। এই ধরনের পরিস্থিতিতে ইমারজেন্সি ভিত্তিতে অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত নেন চিকিৎসকরা। এই অস্ত্রোপচার কেন জটিল? চিকিৎসক অনির্বাণ দাস বলেন, "২ বছর আগে সিজ়ারিয়ান সেকশন হয়েছিল। দুঃখের বিষয়, এই রোগীর সন্তানের মৃত্যু হয়েছিল। খাদ্যনালিতে ইনজুরি হয়েছিল। যে কারণে বড় অস্ত্রোপচার হয়েছিল। পেটে এক বার অস্ত্রোপচার হওয়া মানে খাদ্যনালি জড়িয়ে থাকে। পরবর্তীকালে যে কোনও অস্ত্রোপচার করতে গেলে, সেটা জটিল হয়ে যায়। এরপর এই টিউমারটি হয়েছে।"
অস্ত্রোপচার শেষ করতে তিন ঘণ্টা সময় লেগে যায়। এ কথা জানিয়ে ওই চিকিৎসক বলেন, "আমরা দেখি এটা সিস্টিক টিউমার। কারণ, এর ভিতরে সিস্টিক ফ্লুইড থাকে। টিউমারটি খাদ্যনালির সঙ্গে জটিলভাবে জড়িয়ে ছিল। এর সঙ্গে সব থেকে বড় বিষয়, তলপেটের সমস্ত অংশ যেমন জরায়ু, বাঁ দিকের সিগময়েড কোলনের একটি অংশকে চেপে ধরেছিল। অস্ত্রোপচারের সময় সিগময়েড কোলনের ওই অংশটিকে বাদ দিতে হয়েছে। কারণ টিউমারটি এমন ভাবে পেঁচিয়ে ছিল যে, এই সিগময়েড কোলনের এই অংশটিকে আলাদা করা যায়নি।" তিনি আরও বলেন, "খাদ্যনালির যে অংশটি বাদ দিতে হয়েছে, তার আগের অংশটি পেট থেকে বার করে দিয়েছি। এই প্রক্রিয়াকে বলে কোলোস্টমি। অন্য অংশটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এর পরে হার্নিয়ার অস্ত্রোপচারও করা হয়েছে।"
রোগী কেমন আছেন? চিকিৎসক অনির্বাণ দাস বলেন, "রোগী এখনও বিপদ থেকে মুক্ত হননি। দুই-তিনদিন না গেলে বোঝা যাবে না কতটা উন্নতি হচ্ছে। আশা করছি, যেভাবে অস্ত্রোপচার সফলভাবে হয়েছে, তাতে রোগী ভালো হয়ে যাবেন।" একই সঙ্গে তিনি যোগ করেন, "পরিকল্পনা অনুযায়ী, তিন-চার মাস পরে আরও একটি অস্ত্রোপচার করা হবে। খাদ্যনালির অংশ আলাদা করা আছে, এই অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে তা জুড়ে দেওয়া হবে।" ওই চিকিৎসক জানিয়েছেন, আগের অস্ত্রোপচারের জন্য হার্নিয়া হয়েছিল। টিউমারটি খাদ্যনালিতে চাপ দেওয়ার জন্য অনিয়মিত মলত্যাগ হচ্ছিল। এই দুটি বড় সমস্যার সঙ্গে ছিল জরায়ুর গঠনগত ডিফেক্ট এবং ডিম্বাশয়ে টিউমারের কারণে রক্তপাত। এই রক্তপাত বন্ধ করা যাচ্ছিল না। রক্তপাত মাঝেমধ্যে হচ্ছিল। রক্তপাতের বেশিরভাগ অংশ জরায়ুর ভিতর জমছিল। তাঁর কথায়, "অস্ত্রোপচারের সময় পুরোনো জমা রক্ত জরায়ু থেকে বের করা হয়। কারণ, বহুদিন ধরে রক্তপাত হচ্ছিল এবং জরায়ুর মধ্যে জমা হচ্ছিল।"
অস্ত্রোপচারে কী কী বাদ দিতে হল? চিকিৎসক অনির্বাণ দাস বলেন, "ডান দিকের ডিম্বাশয়ের বড় টিউমার, এর সঙ্গে জরায়ু। জরায়ুর সঙ্গে লেগে থাকা সিগময়েড কোলনের অংশটি বাদ দেওয়া হয়েছে। সিগময়েড কোলনের উপরের অংশটির শেষ অংশটি কোলোস্টমির মাধ্যমে পেট থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে।" অস্ত্রোপচারের জন্য চিকিৎসকদের এই টিমে অনির্বাণ দাস ছাড়াও ছিলেন PGT ডাক্তার মিজানুর রহমান, প্রতীপ ভট্টার, রবি শি এবং একজন ইন্টার্ন ডাক্তার।
চিকিৎসক অনির্বাণ দাস বলেন, "যতগুলি সমস্যা ছিল সফলভাবে দূর করতে সক্ষম হয়েছি। হার্নিয়া ঠিক করা সম্ভব হয়েছে। রক্তপাতের সমস্যা ছিল, বড় একটি টিউমার ছিল যে কারণে তলপেট ফুলে ছিল, ভারী হয়েছিল, এগুলো থেকে মুক্তি দেওয়া গিয়েছে। তিন মাস বাদে খাদ্যনালি জুড়ে দেওয়ার অস্ত্রোপচারের পর স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবেন। তখন বলতে পারব অস্ত্রোপচার সম্পূর্ণ সফল হয়েছে।" টিউমারের ভিতরে বেশিরভাগই ফ্লুইড ছিল। এই জন্য জরায়ু এবং টিউমার মিলিয়ে টিউমারের ওজন সাড়ে চার কেজির মতো হবে বলেও জানিয়েছেন তিনি।