অন্ধ্রপ্রদেশে স্থানীয় নির্বাচন করা নিয়ে বছরভর চলা টানাপোড়েনকে একটা যুক্তিসঙ্গত সমাধানে পৌঁছে দিয়েছে সর্বোচ্চ আদালত । রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে ব্যালট-যুদ্ধের বদলে, এই ইশু ঘিরে সাংবিধানিক ব্যবস্থার মধ্যেই একটা সংঘাত দেখা দিয়েছে, যা অন্ধ্রপ্রদেশের শাসকদলের বৈশিষ্ট্যের দিকেই ইঙ্গিত করছে । সুপ্রিম কোর্ট এর আগে বহুবার বলেছে যে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন ভোট করানোর ক্ষেত্রে একই ক্ষমতার অধিকারী । যদিও, রাজ্য নির্বাচন কমিশনকেই বুড়ো আঙুল দেখিয়ে স্থানীয় নির্বাচন স্থগিত করা নিয়ে একটা অনৈতিক বিতর্ক দানা বাঁধে, যা সুপ্রিম কোর্টে জোরালো ধাক্কা খেয়েছে । এইসব অনভিপ্রেত ঘটনার জন্য তারা নিজেরাই দায়ী । চারদিন আগে, অন্ধ্রপ্রদেশ হাইকোর্টের একটি ডিভিশন বেঞ্চ বলে, যে ভোট কখন হবে, তা নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার চূড়ান্ত অধিকার রয়েছে রাজ্য নির্বাচন কমিশনের। টিকাকরণ ও নির্বাচন, দুটোই জনগণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, একথা বলে আদালত নির্দেশ দেয়, যে এই বিতর্কের অংশীদারদের দুটো কাজই সমানভাবে করতে হবে। এরপর অন্ধ্রপ্রদেশ সরকার সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয় । তাদের বক্তব্য ছিল, টিকাকরণ প্রক্রিয়া চলার জন্য এখনই নির্বাচন করা সম্ভব নয় । সেখানেও ধাক্কা খায় সরকার।
প্রশ্ন করে, সাংবিধানিক পদে বসা ব্যক্তিদের কর্তব্য কি আদালতকে স্মরণ করিয়ে দিতে হবে? পাশাপাশি আদালত এও বলে যে কোরোনা পরিস্থিতি যখন সর্বোচ্চ জায়গায় ছিল, তখন সরকার ভোট করার জন্য জেদাজেদি করছিল, আর যখন কমছে, তখন তারা ভোট করতে অনীহা দেখাচ্ছে । আদালতের পর্যবেক্ষণ সরাসরি অন্ধ্রপ্রদেশ সরকারকে নিশানা করে। অন্ধ্রপ্রদেশ হাইকোর্টের রায় বহাল রেখে সর্বোচ্চ আদালত জানতে চায়, যে কীভাবে রাজ্য নির্বাচন কমিশন বেঠিক কাজ করেছে আর আমলাতন্ত্র কমিশনের বিরোধিতাই বা করছে কেন? বিচারবিভাগ বলে যে সরকারের যুক্তি শুনে মনে হচ্ছে যে এর আড়ালে অন্য কোনও কারণ আছে । সংবিধানের মূল ভাবনা তুলে ধরে আদালত বলে যে ভোট নিয়ে রাজ্য নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত । ভারতীয় সংবিধানে স্পষ্টভাবে বলে দেওয়া হয়েছে যে বিধানসভা, সাংবিধানিক পদ ও বিচারবিভাগের ক্ষমতা কী কী । এখানে ভোটের ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনকে বিশেষ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে । সংবিধানের 243-কে ধারায় সংবিধানের আওতায় থেকে পঞ্চায়েত ভোট করাতে রাজ্য সরকারের ভূমিকার কথা বলা হলেও, সমস্ত ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে রাজ্য নির্বাচন কমিশনকেই । অন্ধ্রপ্রদেশ বিধানসভা সম্প্রতি তিন সপ্তাহের পঞ্চায়েত নির্বাচনকে দু’সপ্তাহে করার নিয়ম তৈরি করেছে । সংবিধানের স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, যে রাজ্য নির্বাচন কমিশনার পঞ্চায়েত ভোট নিয়ে রাজ্যের সঙ্গে আলোচনা করলেই যথেষ্ট, তাঁর রাজ্যের ছাড়পত্র নেওয়ার দরকার নেই । কিন্তু সম্প্রতি একটি প্রস্তাবের মাধ্যমে অন্ধ্রপ্রদেশ বিধানসভা এই ছাড়পত্র নেওয়া বাধ্যতামূলক করেছে । সংবিধানের ভাবনাকে সম্পূর্ণ নস্যাৎ করে আমলা ও কর্মচারীরা পঞ্চায়েত ভোটের ক্ষেত্রে কমিশনকে সহযোগিতা না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ।
আরও পড়ুন : ছাড়া পেলেন শশীকলা, এবার কী হবে তামিলনাড়ুতে?
এভাবে রাজ্য নির্বাচন কমিশনকে কোণঠাসা করাটা অভাবনীয় বিষয়। ক্ষমতাসীনদের মধ্যে সাংবিধানিক সংস্থাকে নিজেদের ইচ্ছেমতো চালিত করার যে মানসিকতা দেখা যায়, তা গণতন্ত্রের ওপর জোরালো আঘাত । যদি ক্ষমতায় থাকা মানুষদের ইচ্ছেমতো ভোট করাতে হয়, তাহলে নির্দিষ্ট সময় অন্তর ভোট করানোর গণতান্ত্রিক রীতিটাই ধ্বংস হয়ে যাবে । সুপ্রিম কোর্টের কথায়, রাজ্য নির্বাচন কমিশন যে যুক্তিপূর্ণভাবে তাদের ক্ষমতার প্রয়োগ করবে, সেব্যাপারে ভরসা রাখা উচিত । আদালত আগেও স্পষ্ট করেছে, যে এই ক্ষমতার থেকে বিন্দুমাত্র চ্যুতি হলে তা সঙ্গে সঙ্গে খারিজ করে দেওয়া হবে । প্রতিটা সাংবিধানিক ব্যবস্থাকে কাজ করতে হবে সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে থেকেই । নিজেদের মধ্যে লড়াই করলে ক্ষতি হবে পুরো ব্যবস্থারই । আর এধরণের লড়াইতে শেষপর্যন্ত হার হবে মানুষের কল্যাণের।