দেশে কর্মসংস্থানের দুর্দশার ছবি
লোকসভায় সরকারের সাম্প্রতিক ঘোষণা অনুযায়ী, দেশজুড়ে নানা মন্ত্রকে অন্তত 6.83 লাখ শূন্যপদ রয়েছে । কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে এতদিন কী হারে গাফিলতি হয়েছে, এই পরিসংখ্যান তারই নমুনা । যদিও কেন্দ্র এবং রাজ্যগুলিতে প্রচুর শূন্যপদ রয়েছে এবং সেই সব পদের জন্য প্রচুর যোগ্য অথচ কর্মহীন প্রার্থীও রয়েছেন, কিন্তু সমস্যা হল কর্মনিয়োগ প্রক্রিয়া কিন্তু মোটেও মসৃণভাবে চলছে না। আর তা হচ্ছে সরকারি কর্মসূচির ব্যর্থতার জন্য। সরকারি প্রশাসন, জন পরিষেবা এবং সুযোগসুবিধার নিরিখে তরুণ প্রজন্মের উপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। হিসাব করে দেখা গিয়েছে, প্রতি বছর দেশের জনসংখ্যায় অন্তত চার মিলিয়ন কর্মহীন মানুষ যুক্ত হচ্ছেন। দেশের 997টি সরকারি কর্মনিয়োগ অফিসে নথিবদ্ধ কর্মহীনের সংখ্যাটা 5.2 কোটি। আর যাঁদের নাম নথিবদ্ধ নেই, সেই সংখ্যা 7 কোটিরও বেশি। ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভে অর্গানাইজ়েশনের (NSSO) সাম্প্রতিকতম সমীক্ষা রিপোর্ট গোপন রাখা হয়েছে। সেই রিপোর্ট অনুসারে, দেশে বেকারত্ব ক্রমশ বাড়ছে এবং সরকারি ও বেসরকারি খাতে কাজের কোনও সুযোগ নেই। দেশে 2018 সালের মার্চ পর্যন্ত যেখানে কেন্দ্রীয় সরকারি দপ্তরে কর্মসংস্থানের সুযোগ ছিল 3802779 পদে, সেখানেই কর্মচারীর সংখ্যা ছিল 3118956 আর বাকি শূন্যপদ 683823 টি। অবসরগ্রহণ, মৃত্যু এবং পদোন্নতি প্রভৃতি কারণে গত দেড় বছরে দেড় লাখ পদ খালি হয়েছে।
এর মধ্যে শুধুমাত্র রেলেই খালি পড়ে রয়েছে 116391টি পদ । এত বিপুল শূন্যপদের জন্য দেশের প্রধান পরিবহন ব্যবস্থার পরিষেবার মানে প্রভাব পড়ছে । গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরক্ষা বিভাগেও নিয়োগের সংখ্যা নগণ্য । স্থলসেনায় 6867 জন অফিসার, নৌবাহিনীতে 1500 চাকরি এবং বায়ুসেনায় এখনও 425 জন অফিসারের পদে নিয়োগ বাকি। স্থলসেনায় 36517 জন জুনিয়র অফিসারের পদ খালি। নৌসেনায় নাবিকের শূন্যপদ 15590 এবং বায়ুসেনায় এই সংখ্যা 10425 । 48টি কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঁচ হাজারেরও বেশি শূন্যপদ রয়েছে। কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারের অধিগৃহীত প্রতিষ্ঠানে বছরে 22000 চাকরি আছে । অন্যদিকে, রাজ্য সরকার পরিচালিত প্রতিষ্ঠানগুলিতেও প্রচুর শূন্যপদ রয়েছে। 2019 সাল পর্যন্ত এই সংখ্যা অন্তত 16 লাখ । বড় এবং ছোটো রাজ্য মিলিয়ে, যেমন উত্তরপ্রদেশ এবং নাগাল্যান্ডে হাজার হাজার শূন্যপদ রয়েছে । জরুরি পরিষেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলিতেও পদ খালি রয়েছে । দেখা গিয়েছে, দিল্লির ক্যাবিনেট সেক্রেটারিয়েট এবং অন্যান্য কেন্দ্রীয় সরকারি দপ্তরে জনপরিষেবায় দেড়ির অন্যতম প্রধান কারণ যথেষ্ট কর্মীসংখ্যার অভাব । একই কারণে রাজ্যগুলিতে প্রশাসনিক নানা সমস্যাও দেখা দিয়েছে। ব্যাঙ্কগুলির সংযুক্তিকরণ কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে বড়সড় প্রশ্নচিহ্ন তুলে দিয়েছে।
অর্থনৈতিক অবস্থার সঙ্গে জড়িত
শূন্যপদ কেন পূরণ করা হয়নি, তার কারণ দর্শাতে গিয়ে কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারগুলি বর্তমান আর্থিক দুরবস্থাকেই তুলে ধরেছে । গুরুত্বপূর্ণভাবে, সুশাসনের জন্য কর্মীনিয়োগ জরুরি, একে কোনওভাবেই পিছিয়ে দেওয়া যায় না বা এড়ানো যায় না । দেশের অর্থনীতি কিংবা আর্থিক নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে এর কোনও প্রাসঙ্গিকতা নেই। কোনও দপ্তর যাতে ভালোভাবে কাজ করে, সেই কাজের পর্যালোচনা যেন করা যায়, প্রয়োজনে সংস্কার সাধনও করা যায়, তার জন্য কর্মী পরিষেবা অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারগুলি এ নিয়ে কোনও উদ্যোগই নিচ্ছে না। সরকারি কর্মচারীদের জন্য নানা রকম সুযোগ সুবিধার বন্দোবস্ত করতে এবং তাদের বেতন বৃদ্ধির বিষয়টি দেখতে কেন্দ্রের একটি বেতন কমিশন রয়েছে আর রাজ্যগুলির ক্ষেত্রে রয়েছে বেতন সংস্কার কমিশন। এই বেতন কমিশনগুলি কর্মসংস্থানের প্রয়োজন এবং অন্যান্য জরুরি বিষয়গুলির দিকে গুরুত্ব দিচ্ছে না, যার ফলে প্রত্যেকটি বিভাগেই কর্মীনিয়োগের প্রক্রিয়া ছ’থেকে আট বছর কিংবা তারও বেশি সময় পিছিয়ে যাচ্ছে। এখনও পর্যন্ত কেন্দ্র কিংবা রাজ্য সরকারের তরফে এই সব শূন্যপদ পূরণের ব্যাপারে কোনও নির্দিষ্ট কর্মসূচি গ্রহণ করতে দেখা যায়নি। কর্মীনিয়োগের প্রক্রিয়া কেন্দ্রীভূত নয়। কেন্দ্র এবং রাজ্যস্তরে বিভিন্ন সংগঠন কাজ করছে। বিভিন্ন দপ্তরে ঠিক কত শূন্যপদ রয়েছে, তা চিহ্নিত করা এবং কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে তা রিপোর্ট করার কাজও ঠিকমতো এগোচ্ছে না । যখন বাজেট পেশ করা হয়েছিল, তখন কেন্দ্র এবং রাজ্যের অর্থ দপ্তরগুলি, অন্যান্য দপ্তর থেকে এ নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করেছিল। কর্মসংস্থান উৎপাদক কার্যালয়গুলি রয়েছে শ্রম বিভাগের আওতায়। শুধুমাত্র কর্মহীন যাঁরা, তাঁদের নামই সেখানে নথিবদ্ধ রয়েছে। কিন্তু কার্যালয়গুলি কর্মী নিয়োগের দায়িত্ব পালন করছে না। আর সরকারি দপ্তরগুলিও এই সব কার্যালয়ের কাছে থাকা তথ্য ঠিকমতো সংগ্রহ করছে না।
বিদেশের অবস্থাটা ঠিক কেমন?
অ্যামেরিকা, ব্রিটেন এবং অস্ট্রেলিয়ায় বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে যে যে নতুন শূন্যপদ তৈরি হয়, আগেভাগেই প্রতি ছ’মাস অন্তর তা চিহ্নিত করা হয় এবং উদ্যোগ নেওয়া হয় তা পূরণের। সেখানে এই কাজের জন্য বিশেষ সংস্থা রয়েছে। প্রতি মাসে কাজের পর্যালোচনা হয় এবং সমস্ত বিভাগে সমান সুযোগসুবিধা দেওয়া হয়। সেখানে একটি নিয়ম বলবৎ রয়েছে যে ছ’মাসের মধ্যে শূন্যপদ পূরণ করতেই হবে। সমস্ত শূন্যপদ সংক্রান্ত খবরাখবর সোশাল মিডিয়া, ওয়েবসাইট, ইলেকট্রনিক মিডিয়া প্রভৃতির মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হয়। শর্তসাপেক্ষে নির্বাচন হয়। আমাদের দেশে এ রকম কোনও রীতি নেই। আমাদের দেশে বেশিরভাগ কর্মসংস্থানের ঘোষণা হয় ভোটের সময়। কেন্দ্রে UPSC নিয়োগের সংখ্যা সীমিত। স্টাফ সিলেকশন কমিশনের মাধ্যমে নির্বাচন প্রক্রিয়া অনাবশ্যক সময় নিচ্ছে। রেলওয়ে সার্ভিস কমিশনের নিয়োগ স্বচ্ছ নয় এবং সেখানে স্বজনপোষণের অভিযোগ প্রায়ই ওঠে। রাজ্যগুলিতে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের নিয়োগ হয় কখনও সখনও। UPSC, রাজ্যের PSC এবং সরকারি দপ্তরগুলির মধ্যে কোনও সমন্বয়সাধন চোখে পড়ে না। এমনকী, নিয়োগের ক্ষেত্রে যোগ্যতা কী কী হবে, তা নির্ধারণ করার প্রক্রিয়াতেও সমস্যা রয়েছে। আবেদনের পদ্ধতিতেও গলদ আছে। আবেদন যাচাইয়ের কাজ চলে মাসের পর মাস ধরে। লিখিত পরীক্ষার সময় প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে যাওয়ার ঘটনা বিপজ্জনক পরিস্থতি সৃষ্টি করে। আবার নির্বাচিত প্রার্থীদের তালিকা চূড়ান্ত করতে গিয়েও সমস্যা দেখা দেয়। নির্বাচন প্রক্রিয়ায় সংরক্ষণের বিষয়টি নিয়ে সুবিধামতো ব্যাখ্যা দেওয়া হয়। দায়িত্ব বণ্টনের রোস্টারও সঠিকভাবে পালন করা হয় না।
চূড়ান্ত নির্বাচনের পর প্রার্থীদের বাধ্য করা হয় নিয়োগ সংক্রান্ত নির্দেশ পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে আর এই অপেক্ষা বড়ই দীর্ঘ। কর্মীনিয়োগ প্রক্রিয়ায় গলদ, তুচ্ছ কারণে আদালতে হলফনামা দেওয়া প্রভৃতির জেরে নিয়োগ প্রক্রিয়াতেও সীমাহীন দেরি হয়। সরকার এই সব সমস্যার দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য কোনও উদ্যোগ নিচ্ছে না। বরং নির্বাচন প্রক্রিয়ার যে যে ফাঁকফোকর রয়েছে, তা চিহ্নিত করে, সারিয়ে তোলার বদলে নিয়োগের ক্ষেত্রে সরকার কোনও উপদেষ্টা সংস্থা বা প্রতিনিধি সংগঠনের সুপারিশ অবলম্বন করছে। এইভাবেই দেশজুড়ে কাজ পেয়েছেন অন্তত 9 মিলিয়ন মানুষ। এঁদের অনেকেই আজ উচ্চপদে রয়েছেন, এবং আর পাঁচ জন সাধারণ কর্মচারী যে সব সুযোগসুবিধা পান, তা এঁরাও ভোগ করছেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সাধারণ শূন্য পদে নিয়োগ হচ্ছে ঠিকই কিন্তু নিয়োগকে নিয়মিত করা হচ্ছে না। উল্টে কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারের চিহ্নিত এই সব উপদেষ্টা সংস্থাগুলি এই সুযোগে প্রচুর লাভ করে নিচ্ছে। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগকারী হিসাবে এরা নিজেদের কর্মীদের স্বল্প বেতন দিচ্ছে, আবার নিজেদের সব দায়িত্বও পূরণ করছে না। সরকারও এই সব সংস্থায় কর্মরত চুক্তিভিত্তিক কর্মচারীদের সমস্যার ব্যাপারে উদাসীন।
পৃথক একটি মন্ত্রক প্রয়োজন
সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে দেশে সরকারি চাকরি পাওয়ার প্রক্রিয়ায় বড়সড় বদল আনা দরকার। নিয়োগের ক্ষেত্রে বিশেষ নীতির রূপায়ণ প্রয়োজন। একটি পৃথক মন্ত্রক গড়ে তোলা উচিত এবং সমস্ত নিয়োগকারী সংস্থাগুলিকে এর আওতায় নিয়ে আসা উচিত। শূন্যপদগুলিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে একটি অ্যাকশন প্ল্যান প্রস্তুত করা প্রয়োজন। আর তা কার্যকর করার জন্যও মজবুত পরিকাঠামো প্রয়োজন। নিয়োগ প্রক্রিয়া ছ’মাসের মধ্যে শেষ করতে হবে। দ্রুত সমস্ত শূন্যপদ চিহ্নিত করা উচিত এবং যুদ্ধকালীন তৎপরতায় সেই সব পদে নিয়োগের কাজ শুরু করে দেওয়া উচিত। নন-গেজেটেড পদে নিয়োগের জন্য ন্যাশনাল রিক্রুটমেন্ট এজেন্সি গঠন করার যে সাম্প্রতিক ঘোষণা কেন্দ্র সরকার করেছে, তা এই নিরিখে সাধু পদক্ষেপ। অনলাইনে পরীক্ষা দেওয়ার জন্য প্রতিটি জেলায় সেন্টার খোলার সিদ্ধান্তও প্রার্থীদের জন্য লাভদায়ক হবে। বর্তমানে বিভিন্ন সরকারি চাকরির জন্য লিখিত পরীক্ষা দিতে দিয়ে যুবক যুবতীরা সমস্যার মুখে পড়েন। তার জন্য কর্মসংস্থানের প্রক্রিয়া সরলীকৃত করা প্রয়োজন। যদি প্রয়োজন পড়ে, সরকারের উচিত কর্মসংস্থানের নিয়মনীতিতে বদল আনা। দায়িত্ব বণ্টনের রোস্টার এবং আসন সংরক্ষণ যথাযথ হওয়া উচিত। পিছিয়ে পড়া শ্রেণি যেমন তপশিলি জাতি, উপজাতি ছাড়াও মহিলা এবং শারীরিক প্রতিবন্ধী বিভাগে নিয়োগ দ্রুত হওয়া উচিত। পরীক্ষা প্রক্রিয়া সম্পাদনেও যত্ন নেওয়া উচিত। কোথাও কোনও গরমিল হওয়ার সুযোগই যেন না থাকে। প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা যেন না ঘটে। ইন্টারভিউ যেন স্বচ্ছ এবং নিরপেক্ষভাবে হয়। নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ যেন কোনওভাবেই রাজনৈতিক কিংবা প্রশাসনিক চাপের কাছে নতিস্বীকার না করেন। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় যেন মধ্যবর্তী কারও অযাচিত হস্তক্ষেপ না থাকে। গ্রাম এবং মফঃস্বলের শহর থেকে আসা প্রার্থীদের জন্য যেন সরকার কোচিং ক্লাসের ব্যবস্থা করে, যাতে তাঁরা শহরের প্রার্থীদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সক্ষম হন। যদি সম্ভব হয়, অসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলির অংশগ্রহণও তালিকাভুক্ত করা উচিত। এই সুবিধা বর্তমানে সেনা এবং পুলিশে নিয়োগের জন্য কিছু কিছু জেলায় মেলে। যদিও রেল এবং অন্যান্য সংস্থা ও দপ্তরে চাকরির জন্য এই ধরনের কোনও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই। কিছু কিছু রাজ্যে কয়েকটি স্টাডি সেন্টার রয়েছে ঠিকই কিন্তু তার সংখ্যা সীমিত। দেশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা সমস্ত কর্মসংস্থান উৎপাদক সেন্টারগুলিকে তাই সক্রিয় হতে হবে যাতে নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রার্থীদের আরও বেশি সুযোগ সুবিধা প্রদান করা যায়।
তেলুগু অধ্যুষিত রাজ্যগুলির ছবি-
তেলাঙ্গানা এবং অন্ধ্রপ্রদেশে সরকারি দপ্তরগুলিতে প্রচুর শূন্যপদ রয়েছে। তেলাঙ্গানা সরকার এক লাখ চাকরি দেওয়ার চেষ্টা করছে কিন্তু সেই প্রক্রিয়া চলছে তো চলছেই। ফলে শূন্যপদও দিনে দিনে আরও বেড়ে যাচ্ছে। অন্ধ্রপ্রদেশেও সরকারি দপ্তরগুলিতে নিয়োগের প্রক্রিয়া এখনও সম্পূর্ণ হয়নি। পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের প্রক্রিয়ার গতি আরও বাড়ানো উচিত।