পুষ্টি এবং শরীরচর্চা ওতপ্রোতভাবে জড়িত । আর এই বছর কোভিড-19-এর বিধিনিষেধের কারণে যেখানে মানুষ নিজেদের সঙ্গেই অনেকটা সময় কাটাতে পেরেছেন, সেখানেই তাঁদের অনেকে নিজেদের স্বাস্থ্য তথা ফিটনেস নিয়ে চর্চা করেছেন । কয়েকজন তো তাঁদের শরীরচর্চাকে দৈনিক রুটিনেরই অংশ করে তুলেছেন । আর বাকিরা স্বাস্থ্যকর ও পুষ্টিকর ডায়েট তথা পথ্য অনুসরণ করেছেন । স্বাস্থ্যসচেতন হতে গিয়ে কেউ কেউ কিটো ডায়েট, প্যালিও ডায়েট, মিলিটারি ডায়েট প্রভৃতিও অনুসরণ করেছেন । আর যাঁরা কোনও নির্দিষ্ট একটি ডায়েটে বেশিদিন আটকে থাকতে পারেননি, তাঁরা জাঙ্ক ফুড-এর জায়গায় স্বাস্থ্যকর বিকল্প বেছে নিয়েছেন । যা তাঁদের কিছু কিছু স্বাস্থ্যসমস্যার নিরসনেও সাহায্য করেছে । এবার দেখে নেওয়া যাক 2020 সালের সেরা কিছু ডায়েট এবং স্বাস্থ্যকর খাবারের ট্রেন্ড।
ডায়েট
বর্তমান পরিস্থিতিতে ‘পারফেক্ট ফিগার’ তথা নিখুঁত দেহাবয়ব পাওয়ার জন্য ডায়েট মেনে চলা ট্রেন্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে । আর তার জন্য বেশ কিছু জরুরি, পুষ্টিকর উপাদান থেকে বঞ্চিত থাকতে মানুষ কসুর করছেন না । এখানে এই বছরের তেমনই কিছু জনপ্রিয় ডায়েটের তালিকা দেওয়া হল ।
কিটো ডায়েট
কিটো ডায়েটকে সাধারণত সেলিব্রিটিদের প্রথম পছন্দ হিসাবে ধরা হয় । কিন্তু এই স্বল্প ফ্যাট ও স্বল্প কার্বোহাইড্রেটযুক্ত ডায়েট, যা মেনে চললে খুব তাড়াতাড়ি ওজন কমে যায় । এই বছর সাধারণ মানুষের মধ্যে তা খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল । এই ডায়েটে দানাশস্য জাতীয় খাবার, চিনি, পাঁউরুটি, দুগ্ধজাত দ্রব্য এবং প্রক্রিয়াজাত খাবারকে পুরোপুরি এড়িয়ে চলা হয় । তবে এই বছর খবরের শিরোনামে এই ডায়েট থাকার আরও একটি কারণ হল, এই ডায়েট অনুসরণ করতে গিয়ে একজন আঞ্চলিক স্তরের অভিনেত্রীর মৃত্যু হয়েছে এই বছরই । আর তার ফলেই শরীরের উপর এই ডায়েটের নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে বহু প্রশ্ন উঠেছে এবং বোঝা গিয়েছে যে কেবলমাত্র চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানেই এই ডায়েট অনুসরণ করা যেতে পারে । এই ডায়েটের যদিও কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও রয়েছে, যেমন পেটের দীর্ঘায়িত সমস্যা, বডি ক্র্যাম্প, বমিভাব, বুক ধড়ফড় করা , আলস্য এবং কাজে অনীহা।
ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং
ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং নানাভাবে করা যায় । তবে যে করছেন, তার সুবিধা-অসুবিধা বুঝে করতে হয় । সবচেয়ে প্রচলিত দু’টি উপায়ের মধ্যে রয়েছে প্রথমত, যেখানে কেউ সকালে হালকা খাবার খায়, বিকেলে আরও হালকা কিছু খায় আর রাতে কিছু খায়ই না । দ্বিতীয়টি হল, সপ্তাহে এক বা দু’দিন কেউ কঠিন খাবার একেবারেই খায় না । অনেকেই লকডাউনের সময় এই ডায়েট অনুসরণ করেছে কারণ এতে ওজন কমে, শরীর থেকে টক্সিক তথা বিষাক্ত পদার্থ দূরীভূত হয়, স্মৃতিশক্তি বাড়ে এবং মানুষের আয়ু বাড়ে বলেই জানা যায় । কিন্তু মানুষকে এটাও মনে রাখতে হবে যে অপ্রয়োজনীয়ভাবে উপোস করার মেয়াদ বাড়াতে থাকলে কিডনি এবং অগ্ন্যাশয়ের কার্যকারিতার উপর তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে এবং শরীরের ফ্যাটজাতীয় পদার্থ কমে যায়, যা শরীরের যথাযথভাবে কাজ করার জন্য অত্যন্ত দরকারি । অন্যথায় এর জেরে বড় প্রভাব পড়ে ত্বক এবং মস্তিষ্কে ।
মিলিটারি ডায়েট
স্বল্প ক্যালোরিযুক্ত মিলিটারি ডায়েটও এই বছর খুব জনপ্রিয় হয়েছিল । কারণ একে সপ্তাহে মাত্র তিনদিন অনুসরণ করতে হয় । আর বাকি চারদিন স্বাভাবিক আহার করা যেতে পারে । প্রথম তিনদিন কোনও ব্যক্তিকে দিনে মোট 1 হাজার 100 থেকে 1 হাজার 200 ক্যালোরির কম খাবার খেতে হয় । আর বাকি চারদিন 1 হাজার 800 ক্যালোরির খাবার খেতে হয় । এই ডায়েট অনুসরণ করলে তিনদিনে অন্তত দুই কেজি ওজন কমে ।
সার্টফুড ডায়েট
কোভিড-19 প্যানডেমিকের জেরে বর্তমান পরিস্থিতি বিচার করলে এই ডায়েটকে বাকি সমস্ত ডায়েটের মধ্যে সেরা বলা যায় কারণ এই ডায়েটে এমন কিছু খাবার রয়েছে, যাতে প্রচুর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে । এই ডায়েট গ্রহণে দেহের ফ্যাট দূর হয় আর তার ফলেই ওজন কমে । সার্টফুট ডায়েটে গ্রিন টি, হলুদ, আপেল, পার্সলে পাতা, লেবুজাতীয় ফল, ব্লুবেরি, সোয়া, ডার্ক চকোলেট, কলা এবং অলিভ অয়েল গ্রহণ করতে হয়, যা শরীরে সারটুইন প্রোটিনের কার্যকারিতা বজায় রাখতে কাজে লাগে । সারটুইন প্রোটিন আমাদের শরীরকে সেই সব কোষের থেকে দূরে রাখে, যা হজমে সাহায্য করে, প্রদাহ সৃষ্টি করে এবং ত্বককে বুড়িয়ে দেয় ।
এছাড়াও আরও অন্যান্য কিছু ডায়েট রয়েছে যেমন প্যালেও ডায়েট, অ্যাটকনস ডায়েট, ড্যাশ ডায়েট প্রভৃতি, যা ওজন কমানোর উদ্দেশে অনেকেই অনুসরণ করেছে ।
আরও পড়ুন, 2020 : গুগল ক্লাউডের ফিচার্স
পুষ্টি
যেহেতু কোভিড-19 আমাদের ইমিউন সিস্টেমের উপর আক্রমণ করে, এই বছর মোটামুটি প্রত্যেকেই তারা কী খাচ্ছে এবং পান করছে, তার দিকে কড়া নজর রেখেছে । ডায়েটে বেশি করে স্থান দেওয়া হয়েছে ইমিউনিটি বর্ধনকারী খাদ্যকেই । চিকিৎসকরাও ভিটামিন সি, ভিটামিন ডি এবং অন্যান্য মাল্টিভিটামিন সাপলমেন্টের কোর্স নিতে সুপারিশ করছেন । ওজন হ্রাসের সঙ্গে সঙ্গে স্বাস্থ্যের দিকটি বজায় রাখাই যার মূল উদ্দেশ্য । তাই এখানে এমন কিছু সমস্যার উল্লেখ করা হল, 2020 সালে যার সম্মুখীন মানুষকে হতে হয়েছে । পাশাপাশি তার নিরসনে সহায়ক খাবারের তালিকাও দেওয়া হল ।
ইমিউনিটি বাড়ানোর জন্য
যেহেতু এই বছর ইমিউনিটি বৃদ্ধি করাই ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, তাই মানুষ প্রচুর পরিমাণে লেবুজাতীয় ফল তথা এমন খাবার খেয়েছে, যাতে বেশি পরিমাণে ভিটামিন সি রয়েছে। ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার যেমন লেবু, কমলালেবু, আমলকি, কিউয়ি, বেদানা, মুসাম্বি, আপেল প্রভৃতি ডায়েটে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে । অ্যান্টি-অক্সিডেটিভ খাবার যেমন তুলসি, রসুন, ফ্ল্যাক্স সিডস তথা তিসি, বেরিজাতীয় ফল, বিনস প্রভৃতিও গুরুত্ব পেয়েছে । এছাড়াও মানুষ তাদের দৈনন্দিন ডায়েটে ভিটামিন ডি, জ়িঙ্ক , প্রোটিনজাতীয় পুষ্টি উপাদানও যুক্ত করেছে ।
অনিদ্রা দূর করতে
লকডাউনে গৃহবন্দি থাকা এবং ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তার সঙ্গে লড়াই করার চিন্তার কারণে অনেকেরই মানসিক চাপ, অবসাদ, উদ্বেগ প্রভৃতির মুখে পড়তে হয়েছে, যার ফলে তাদের অনিদ্রা বা ভালো ঘুম না হওয়ার সমস্যায় আক্রান্ত হতে হয়েছে । উষ্ণ দুধ, বাদাম, ক্যামোমাইল টি, কিউয়ি, ফ্যাটের পরিমাণ বেশি এমন মাছ খাওয়া এক্ষেত্রে উপকারী সাব্যস্ত হয়েছে ।
মুড ঠিক করতে
আমরা যা খাই, তা কেবল আমাদের শারীরিক স্বাস্থ্য নয়, মানসিক স্বাস্থ্যকেও প্রভাবিত করে । যেমনটা আমরা জানি মানসিক চাপ, অবসাদ এবং উদ্বেগ এই বছর মানসিক স্বাস্থ্যজনিত সমস্যার তালিকায় শীর্ষে ছিল । ডিম, ডার্ক চকোলেট, ইয়োগার্ট, গ্রিন টি, বাদাম, কফি, কেসর, বিনস এবং মুসুর ডাল মন ভালো রাখতে সাহায্য করে ।
শক্তি বাড়াতে
সারাদিন বাড়িতে থাকার ফলে মানুষের আলস্য দেখা দিয়েছে এবং তাদের বেশিরভাগ দিনই কেটেছে বিশেষ কোনও কাজ না করে । যদিও এনার্জি বাড়াতে সাহায্য করেছে কলা, আপেল, কফি, স্ট্রবেরি, ডার্ক চকোলেট, বাদাম, সবুজ শাকসবজি প্রভৃতি ।
যথাযথভাবেই বলা হয়েছে যে, ‘আমরা যা, আমরা তাই খাই’, আমাদের স্বাস্থ্যের উপর আমাদের ডায়েটের প্রভাবের প্রতিফলন ঘটে । যথাযথ এবং স্বাস্থ্যকর ডায়েট কারও মন ভালো করতে এবং সারাদিন এনার্জি তুঙ্গে রাখতে সাহায্য করে । সেখানেই অন্যদিকে অস্বাস্থ্যকর স্ন্যাকসজাতীয় খাওয়াদাওয়া এবং হঠাৎ করে খুব বেশি খেয়ে ফেলার প্রভাব মুডের উপর দেখা যায় । এতে আলস্য বাড়ে এবং ওজনও বৃদ্ধি পায় । তাই প্রোবায়োটিক, জটিল কার্বোহাইড্রেট, ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড, অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, ফোলেট, ভিটামিন এ, সি এবং ডি, প্রোটিন, জ়িঙ্ক, ম্যাগনেসিয়াম ও অন্যান্য জরুরি পুষ্টিকর উপাদান সমৃদ্ধ ডায়েটই হল স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের চাবিকাঠি।