ETV Bharat / bharat

হেপাজতে মৃত্যুর এক কুৎসিত ছবি !

যেখানে দেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং চেয়েছেন, নতুন ধরনের পুলিশ বাহিনী গড়ে তোলা হোক, যারা আগের থেকে বেশি পেশাদার, একনিষ্ঠ, চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হওয়ার মতো শক্তিধর এবং প্রশিক্ষিত হবে, সেখানেই আবার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি জোর দিয়েছেন পুলিশের "স্মার্ট" হওয়ার উপর।

হায়দরাবাদ
হায়দরাবাদ
author img

By

Published : Jul 10, 2020, 10:38 AM IST

আমরা এমন এক দেশের অধিবাসী, যেখানে আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তারক্ষার দায়িত্বভার ন্যস্ত আছে 20 লাখ পুলিশবাহিনীর উপর । ব্রিটিশ শাসনে, এই বাহিনীর একমাত্র দায়িত্ব ছিল শাসকদের স্বার্থরক্ষা করা । কিন্তু স্বাধীনতার পর, তাদের প্রধান দায়িত্ব অবশ্যই জনগণের স্বার্থরক্ষা করা । একাধিক বার, জাতীয় পুলিশ কমিশন ঘোষণা করেছে এবং এই মর্মে বিধানও দিয়েছে যে পুলিশ বাহিনীকে জনগণের নিরাপত্তারক্ষায় অঙ্গীকারবদ্ধ হতেই হবে । পুলিশকে আইনি অধিকার মেনেই সমাজকে রক্ষা করতে হবে । কিন্তু তা সত্ত্বেও একাধিক বার সুপ্রিম কোর্ট পুলিশি সিস্টেম নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে । বলেছে, পুলিশি সিস্টেম বর্তমানে "অর্গানাইজড ক্রিমিনালস" তথা পরিকল্পনামাফিক অপরাধীতে পরিণত হয়েছে। আর পুলিশের ব্যবহার দিন দিন খারাপ থেকে আরও খারাপ হয়ে চলেছে । তাদের বিরুদ্ধে একের পর এক নৃশংস অত্যাচারের ঘটনা, হেপাজতে নিরীহর প্রাণ কেড়ে নেওয়ার ঘটনা সামনে আসাই তার

প্রমাণ। তামিলনাড়ুর থোতুকুড়ি জেলায় সাম্প্রতিক দুঃখজনক ঘটনাও সেই তালিকায় নতুন সংযোজন । নৃশংস অত্যাচারে মৃত দু’টি প্রাণ ৷ একাধিক রাজ্য সরকার এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে কোরোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে এবং সাধারণ মানুষের প্রাণরক্ষা করতে লকডাউন বহাল রাখা জরুরি । কোরোনা সংক্রমণে মহারাষ্ট্রকে জোর টক্কর দেওয়া রাজ্য তামিলনাড়ুও কঠোর লকডাউন বিধি জারি করেছে ।

60 বছর বয়সি জয়রাজের উপর গত 19 জুন এই লকডাউন বিধি অমান্য করা এবং রাত সাতটা তিরিশ মিনিটের পরও মোবাইল ফোনের দোকান খোলা রাখার "অপরাধে" পুলিশ হামলা চালায় । তাঁকে সাথানকুলাম থানায় নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানেই আটক করা হয় । বাবার মুক্তির জন্য অনুরোধ জানাতে যখন তাঁর ছেলে ফেনিক্স সেখানে যায়, দুই পক্ষের মধে্য তর্কাতর্কি বেধে যায় । যার জেরে ছেলেকেও আটক করা হয় । 22 জুন, জয়রাজ বুকের ব্যথা অনুভব করেন এবং তাঁকে কোভিলাপতি হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়। চিকিৎসকরা পরীক্ষা করে জানান, হাসপাতালে আসার আগেই মৃত্যু হয়েছে তাঁর। পরদিন একই হাসপাতালে ছেলেরও মৃত্যু হয় । হেপাজতে পুলিশি বর্বরতার জেরেই জয়রাজ এবং ফেনিক্সের মৃত্যু হয়েছে, এই অভিযোগে গর্জে ওঠে সাধারণ মানুষ । প্রতিবাদ-বিক্ষোভে কেঁপে ওঠে পৌর প্রশাসন এমনকি বিচারব্যবস্থাও । জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট পর্যায়ের তদন্তে পুলিশবাহিনীর অপরাধের কথা উঠে আসে । জানা যায়, অপরাধের বিচারের বদলে অব্যবস্থা ছড়াতেই বড় ভূমিকা রয়েছে পুলিশের। অত্যাচারের কাহিনি কোভিলাপট্টি জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এম.এস ভারতীদাসান ঘটনার যে রিপোর্ট জমা দিয়েছেন, তা অনুযায়ী-ওই থানায় CCTV ফুটেজ ডিলিট করে দেওয়া হয়েছিল। কারণ রোজ দিনের শেষে থানার CCTV ক্যামেরাগুলিকে "অটো-ডিলিট" মোডে রেখে দেওয়া হত । অর্থাৎ তাদের অত্যাচারের কোনও প্রমাণ যাতে পরে কারও হাতে না আসে, সে মর্মে আগাম সতর্কতা নিয়ে রেখেছিল পুলিশ। রিপোর্টে তদন্তকারী কমিটির তরফে এ-ও মন্তব্য করা হয়েছে যে, কনস্টেবল থেকে শুরু করে উচ্চপদস্থ পুলিশকর্তাও তদন্তকারী কমিটির সদস্যদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছিল। একজন কনস্টেবল তো চ্যালেঞ্জের সুরে এ কথাও বলেছিল যে , "আপনারা কিছুই করতে পারবেন না ।" এসব কিছুই পরিষ্কার করে বোঝায়, আইন-কানুনরক্ষার প্রতি পুলিশের দায় ঠিক কতটুকু!

থানার এক মহিলা কনস্টেবল বাবা-ছেলের উপর পুলিশি অত্যাচারের বিবরণ দিতে গিয়ে অত্যন্ত আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন। তবে তিনি তাঁর বয়ানে স্পষ্টভাবে জানিয়েছিলেন কীভাবে ওইদিন রাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে, পালা করে বাবা-ছেলেকে নির্মমভাবে প্রহার করেছিল পুলিশ। মারের চোটে রক্তাক্ত হয়ে গিয়েছিল দুই জনের দেহ। থানার ভিতরে আসবাবপত্র ও অন্যান্য জায়গায় রক্তের দাগ ছিল স্পষ্ট। অপরাধীদের হাত থেকে সাধারণ মানুষকে বাঁচাতে যে পুলিশের হাতে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, দুর্ভাগ্যজনকভাবে তারই সেই ক্ষমতার অপব্যবহার করে চলেছে অসহায় নাগরিকদের উপর । থানাগুলিতে আজকাল নাগরিকদের মৌলিক অধিকার রক্ষার কোনও বালাই নেই ।

এমনকী, স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক দেশ হিসাবে স্বীকৃত হওয়ার এত সময় পরে এসেও এই ধরনের অত্যাচারের ঘটনা আদপে, দেশের সম্মানের উপরে লেগে থাকা কলঙ্কের কালো দাগের মতো। অবিলম্বে সংস্কার প্রয়োজন ৷ সম্প্রতি অ্যামেরিকায় জর্জ ফ্লয়েড নামে এক কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তিকে ধরতে গয়ে ক্ষমতার চরমতম প্রদর্শন করে পুলিশ, যার ফলে দমবন্ধ হয়ে তাঁর মৃত্যু হয়। অ্যামেরিকা ছাডা়ও বিশ্বের বহু দেশে এই পুলিশি বর্বরতার বিরুদ্ধে গণপ্রতিবাদ হয়েছে ।এবার সেখানকার সরকার বাধ্য হয়ে পুলিশি ব্যবস্থায় সংস্কার আনার উদ্যোগ নিয়েছে । মিনিয়াপোলিসের গর্ভনিং বডি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেখানকার পুলিশ বিভাগ প্রত্যাহার করা হবে । ইউক্রেন এবং জর্জিয়ায়, বর্তমান সমাজের চাহিদার দিকে তাকিয়ে প্রাচীনপন্থী পুলিশ ব্যবস্থায় বদল আনা হয়েছে । অথচ ভারতে, দশকের পর দশক ধরে পুলিশি ব্যবস্থার সংস্কারের প্রস্তাব দেওয়া হলেও তা এখনও শুধুমাত্র কাগুজে দলিল হিসাবেই রয়ে গিয়েছে যা সভ্য সমাজের বাসিন্দাদের জীবনযাত্রার অধিকারকে প্রহসন বানিয়ে ছেড়েছে। আইনের অধিকার প্রযোজ্য, বিশ্বের 126টি এমন দেশের তালিকায় ভারতের স্থান 68। আইন-শৃঙ্খলারক্ষার আট-দফা নিয়ামকের নিরিখে ভারতের স্থান 111তম । সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রতিদিন আমাদের দেশে গড়ে 15টি করে হেপাজতে পুলিশি বর্বরতার ঘটনা ঘটে, আর এর মধ্যে নয়জনের মৃত্যু হয় । জাতীয় মানবাধিকার কমিশন জানিয়েছে, বেশিরভাগ হেপাজতে মৃত্যুর ঘটনাই প্রকাশে্য আসে না এবং নগণ্য সংখ্যায় হলেও যেগুলি আসে, তা আসতে প্রচুর সময় নেয় । তাদের রিপোর্টে বলা হয়েছে, সব কিছুই গা ছাড়া ভাবে হয় আর সাম্প্রতিক যে পুলিশি নৃশংসতার ছবি সামনে এসেছে, তার শিকড় সমাজের অনেক গভীরে প্রোত্থিত । যদিও হেপাজতে মৃত্যুর ঘটনায় কিছু আধিকারিকদের পরে দায়ী করা হয়েছে, কিন্তু এই সব ঘটনার প্রেক্ষিতে সাংগঠনিক স্তরে আমূল পরিবর্তন আনা কঠিন। নিয়মমাফিক এবং কড়া সংস্কার এখন অত্যন্ত দরকার ।

আইনের ঊর্ধ্বে কেউ নয় সুপ্রিম কোর্ট বার বার স্পষ্টভাবে জানিয়েছে যে সংবিধানের ঊর্ধ্বে কেউ নয় । গত 23 জুন গির্জায় যাওয়ার সময় মুখে মাস্ক না পরায় বুলগেরিয়ার প্রধানমন্ত্রীকে 300 লিউস (ভারতীয় মুদ্রায় 13 হাজার টাকা) জরিমানা করেছিল সে দেশেরই স্বাস্থ্য মন্ত্রক । এইভাবে আইনকানুনকে সম্মান জানাতে হয়! কিন্তু ভারতে 2005 থেকে 2015 সালের মধে্য অপরাধের হার 28 শতাংশ বেড়ে গিয়েছে । কিন্তু অপরাধীদের ধরা বা শাস্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনও অগ্রগতি হয়নি । উত্তরপ্রদেশের প্রাক্তন DGP প্রকাশ সিং বলেছেন, "এর অর্থ এই নয় যে, এদেশে কোনও আইনের শাসন নেই কিন্তু এখানে রাজনৈতিক শাসক এবং তাঁদের শাসনও সমানভাবে কার্যকর । এখানে যাঁরা ক্ষমতায় আছেন, তাঁদের তুষ্ট করতে পুলিশবাহিনী যা খুশি করতে পারে এবং নিজেদের অধিকারের গণ্ডিও পেরোতে পারে । তাহলে এখানে আমরা কীভাবে তাঁদের কাছ থেকে নৈতিক ঐক্য, জনগণকে রক্ষার দায়িত্ববোধ আশা করব? দশকের পর দশক ধরে সতর্ক করা হয়েছে যে, এই গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার ভিত কেঁপে উঠবে যদি আমরা পুলিশের উপর থাকা পাহাড়প্রমাণ চাপ উপেক্ষা করি । কিন্তু নেতা-মন্ত্রীরা তাতে আমল দেননি। যতক্ষণ পর্যন্ত অশিষ্ট, আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থার হাতে দেশের সাংবিধানিক মূল্যবোধ রক্ষার দায়িত্বের প্রহসনমূলক অপব্যবহার চলবে, আর পুলিশও হেপাজতে অপরাধের পর অপরাধ করে যাবে, ততদিন অন্ধকার কুঠুরিতে নিরীহের মরণকান্নার শব্দ শোনা যাবে।"

যেখানে দেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং চেয়েছেন, নতুন ধরনের পুলিশ বাহিনী গড়ে তোলা হোক, যারা আগের থেকে বেশি পেশাদার, একনিষ্ঠ, চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হওয়ার মতো শক্তিধর এবং প্রশিক্ষিত হবে, সেখানেই আবার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি জোর দিয়েছেন পুলিশের "স্মার্ট" হওয়ার উপর। প্রয়োজনীয় পেশাদারি স্বাধীনতা এবং দায়িত্ববোধ ছাড়া, লোক দেখানো ভাবে পুলিশবাহিনীর সংস্কার সাধন করে কীভাবে নাগরিক অধিকার সুরক্ষিত রাখা যাবে? সংবিধানকে সম্মান করার শৃঙ্খলা যখন পুলিশ বুঝবে, যখন তারা যথাযথভাবে আইন মেনে চলবে এবং স্বেচ্ছায় মানুষের নিরাপত্তার জন্য নিজেদের নিয়োজিত করাকে অগ্রাধিকার দেবে তখনই দেশ নিরাপদ এবং সুখী হতে পারবে ।

আমরা এমন এক দেশের অধিবাসী, যেখানে আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তারক্ষার দায়িত্বভার ন্যস্ত আছে 20 লাখ পুলিশবাহিনীর উপর । ব্রিটিশ শাসনে, এই বাহিনীর একমাত্র দায়িত্ব ছিল শাসকদের স্বার্থরক্ষা করা । কিন্তু স্বাধীনতার পর, তাদের প্রধান দায়িত্ব অবশ্যই জনগণের স্বার্থরক্ষা করা । একাধিক বার, জাতীয় পুলিশ কমিশন ঘোষণা করেছে এবং এই মর্মে বিধানও দিয়েছে যে পুলিশ বাহিনীকে জনগণের নিরাপত্তারক্ষায় অঙ্গীকারবদ্ধ হতেই হবে । পুলিশকে আইনি অধিকার মেনেই সমাজকে রক্ষা করতে হবে । কিন্তু তা সত্ত্বেও একাধিক বার সুপ্রিম কোর্ট পুলিশি সিস্টেম নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে । বলেছে, পুলিশি সিস্টেম বর্তমানে "অর্গানাইজড ক্রিমিনালস" তথা পরিকল্পনামাফিক অপরাধীতে পরিণত হয়েছে। আর পুলিশের ব্যবহার দিন দিন খারাপ থেকে আরও খারাপ হয়ে চলেছে । তাদের বিরুদ্ধে একের পর এক নৃশংস অত্যাচারের ঘটনা, হেপাজতে নিরীহর প্রাণ কেড়ে নেওয়ার ঘটনা সামনে আসাই তার

প্রমাণ। তামিলনাড়ুর থোতুকুড়ি জেলায় সাম্প্রতিক দুঃখজনক ঘটনাও সেই তালিকায় নতুন সংযোজন । নৃশংস অত্যাচারে মৃত দু’টি প্রাণ ৷ একাধিক রাজ্য সরকার এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে কোরোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে এবং সাধারণ মানুষের প্রাণরক্ষা করতে লকডাউন বহাল রাখা জরুরি । কোরোনা সংক্রমণে মহারাষ্ট্রকে জোর টক্কর দেওয়া রাজ্য তামিলনাড়ুও কঠোর লকডাউন বিধি জারি করেছে ।

60 বছর বয়সি জয়রাজের উপর গত 19 জুন এই লকডাউন বিধি অমান্য করা এবং রাত সাতটা তিরিশ মিনিটের পরও মোবাইল ফোনের দোকান খোলা রাখার "অপরাধে" পুলিশ হামলা চালায় । তাঁকে সাথানকুলাম থানায় নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানেই আটক করা হয় । বাবার মুক্তির জন্য অনুরোধ জানাতে যখন তাঁর ছেলে ফেনিক্স সেখানে যায়, দুই পক্ষের মধে্য তর্কাতর্কি বেধে যায় । যার জেরে ছেলেকেও আটক করা হয় । 22 জুন, জয়রাজ বুকের ব্যথা অনুভব করেন এবং তাঁকে কোভিলাপতি হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়। চিকিৎসকরা পরীক্ষা করে জানান, হাসপাতালে আসার আগেই মৃত্যু হয়েছে তাঁর। পরদিন একই হাসপাতালে ছেলেরও মৃত্যু হয় । হেপাজতে পুলিশি বর্বরতার জেরেই জয়রাজ এবং ফেনিক্সের মৃত্যু হয়েছে, এই অভিযোগে গর্জে ওঠে সাধারণ মানুষ । প্রতিবাদ-বিক্ষোভে কেঁপে ওঠে পৌর প্রশাসন এমনকি বিচারব্যবস্থাও । জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট পর্যায়ের তদন্তে পুলিশবাহিনীর অপরাধের কথা উঠে আসে । জানা যায়, অপরাধের বিচারের বদলে অব্যবস্থা ছড়াতেই বড় ভূমিকা রয়েছে পুলিশের। অত্যাচারের কাহিনি কোভিলাপট্টি জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এম.এস ভারতীদাসান ঘটনার যে রিপোর্ট জমা দিয়েছেন, তা অনুযায়ী-ওই থানায় CCTV ফুটেজ ডিলিট করে দেওয়া হয়েছিল। কারণ রোজ দিনের শেষে থানার CCTV ক্যামেরাগুলিকে "অটো-ডিলিট" মোডে রেখে দেওয়া হত । অর্থাৎ তাদের অত্যাচারের কোনও প্রমাণ যাতে পরে কারও হাতে না আসে, সে মর্মে আগাম সতর্কতা নিয়ে রেখেছিল পুলিশ। রিপোর্টে তদন্তকারী কমিটির তরফে এ-ও মন্তব্য করা হয়েছে যে, কনস্টেবল থেকে শুরু করে উচ্চপদস্থ পুলিশকর্তাও তদন্তকারী কমিটির সদস্যদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছিল। একজন কনস্টেবল তো চ্যালেঞ্জের সুরে এ কথাও বলেছিল যে , "আপনারা কিছুই করতে পারবেন না ।" এসব কিছুই পরিষ্কার করে বোঝায়, আইন-কানুনরক্ষার প্রতি পুলিশের দায় ঠিক কতটুকু!

থানার এক মহিলা কনস্টেবল বাবা-ছেলের উপর পুলিশি অত্যাচারের বিবরণ দিতে গিয়ে অত্যন্ত আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন। তবে তিনি তাঁর বয়ানে স্পষ্টভাবে জানিয়েছিলেন কীভাবে ওইদিন রাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে, পালা করে বাবা-ছেলেকে নির্মমভাবে প্রহার করেছিল পুলিশ। মারের চোটে রক্তাক্ত হয়ে গিয়েছিল দুই জনের দেহ। থানার ভিতরে আসবাবপত্র ও অন্যান্য জায়গায় রক্তের দাগ ছিল স্পষ্ট। অপরাধীদের হাত থেকে সাধারণ মানুষকে বাঁচাতে যে পুলিশের হাতে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, দুর্ভাগ্যজনকভাবে তারই সেই ক্ষমতার অপব্যবহার করে চলেছে অসহায় নাগরিকদের উপর । থানাগুলিতে আজকাল নাগরিকদের মৌলিক অধিকার রক্ষার কোনও বালাই নেই ।

এমনকী, স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক দেশ হিসাবে স্বীকৃত হওয়ার এত সময় পরে এসেও এই ধরনের অত্যাচারের ঘটনা আদপে, দেশের সম্মানের উপরে লেগে থাকা কলঙ্কের কালো দাগের মতো। অবিলম্বে সংস্কার প্রয়োজন ৷ সম্প্রতি অ্যামেরিকায় জর্জ ফ্লয়েড নামে এক কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তিকে ধরতে গয়ে ক্ষমতার চরমতম প্রদর্শন করে পুলিশ, যার ফলে দমবন্ধ হয়ে তাঁর মৃত্যু হয়। অ্যামেরিকা ছাডা়ও বিশ্বের বহু দেশে এই পুলিশি বর্বরতার বিরুদ্ধে গণপ্রতিবাদ হয়েছে ।এবার সেখানকার সরকার বাধ্য হয়ে পুলিশি ব্যবস্থায় সংস্কার আনার উদ্যোগ নিয়েছে । মিনিয়াপোলিসের গর্ভনিং বডি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেখানকার পুলিশ বিভাগ প্রত্যাহার করা হবে । ইউক্রেন এবং জর্জিয়ায়, বর্তমান সমাজের চাহিদার দিকে তাকিয়ে প্রাচীনপন্থী পুলিশ ব্যবস্থায় বদল আনা হয়েছে । অথচ ভারতে, দশকের পর দশক ধরে পুলিশি ব্যবস্থার সংস্কারের প্রস্তাব দেওয়া হলেও তা এখনও শুধুমাত্র কাগুজে দলিল হিসাবেই রয়ে গিয়েছে যা সভ্য সমাজের বাসিন্দাদের জীবনযাত্রার অধিকারকে প্রহসন বানিয়ে ছেড়েছে। আইনের অধিকার প্রযোজ্য, বিশ্বের 126টি এমন দেশের তালিকায় ভারতের স্থান 68। আইন-শৃঙ্খলারক্ষার আট-দফা নিয়ামকের নিরিখে ভারতের স্থান 111তম । সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রতিদিন আমাদের দেশে গড়ে 15টি করে হেপাজতে পুলিশি বর্বরতার ঘটনা ঘটে, আর এর মধ্যে নয়জনের মৃত্যু হয় । জাতীয় মানবাধিকার কমিশন জানিয়েছে, বেশিরভাগ হেপাজতে মৃত্যুর ঘটনাই প্রকাশে্য আসে না এবং নগণ্য সংখ্যায় হলেও যেগুলি আসে, তা আসতে প্রচুর সময় নেয় । তাদের রিপোর্টে বলা হয়েছে, সব কিছুই গা ছাড়া ভাবে হয় আর সাম্প্রতিক যে পুলিশি নৃশংসতার ছবি সামনে এসেছে, তার শিকড় সমাজের অনেক গভীরে প্রোত্থিত । যদিও হেপাজতে মৃত্যুর ঘটনায় কিছু আধিকারিকদের পরে দায়ী করা হয়েছে, কিন্তু এই সব ঘটনার প্রেক্ষিতে সাংগঠনিক স্তরে আমূল পরিবর্তন আনা কঠিন। নিয়মমাফিক এবং কড়া সংস্কার এখন অত্যন্ত দরকার ।

আইনের ঊর্ধ্বে কেউ নয় সুপ্রিম কোর্ট বার বার স্পষ্টভাবে জানিয়েছে যে সংবিধানের ঊর্ধ্বে কেউ নয় । গত 23 জুন গির্জায় যাওয়ার সময় মুখে মাস্ক না পরায় বুলগেরিয়ার প্রধানমন্ত্রীকে 300 লিউস (ভারতীয় মুদ্রায় 13 হাজার টাকা) জরিমানা করেছিল সে দেশেরই স্বাস্থ্য মন্ত্রক । এইভাবে আইনকানুনকে সম্মান জানাতে হয়! কিন্তু ভারতে 2005 থেকে 2015 সালের মধে্য অপরাধের হার 28 শতাংশ বেড়ে গিয়েছে । কিন্তু অপরাধীদের ধরা বা শাস্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনও অগ্রগতি হয়নি । উত্তরপ্রদেশের প্রাক্তন DGP প্রকাশ সিং বলেছেন, "এর অর্থ এই নয় যে, এদেশে কোনও আইনের শাসন নেই কিন্তু এখানে রাজনৈতিক শাসক এবং তাঁদের শাসনও সমানভাবে কার্যকর । এখানে যাঁরা ক্ষমতায় আছেন, তাঁদের তুষ্ট করতে পুলিশবাহিনী যা খুশি করতে পারে এবং নিজেদের অধিকারের গণ্ডিও পেরোতে পারে । তাহলে এখানে আমরা কীভাবে তাঁদের কাছ থেকে নৈতিক ঐক্য, জনগণকে রক্ষার দায়িত্ববোধ আশা করব? দশকের পর দশক ধরে সতর্ক করা হয়েছে যে, এই গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার ভিত কেঁপে উঠবে যদি আমরা পুলিশের উপর থাকা পাহাড়প্রমাণ চাপ উপেক্ষা করি । কিন্তু নেতা-মন্ত্রীরা তাতে আমল দেননি। যতক্ষণ পর্যন্ত অশিষ্ট, আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থার হাতে দেশের সাংবিধানিক মূল্যবোধ রক্ষার দায়িত্বের প্রহসনমূলক অপব্যবহার চলবে, আর পুলিশও হেপাজতে অপরাধের পর অপরাধ করে যাবে, ততদিন অন্ধকার কুঠুরিতে নিরীহের মরণকান্নার শব্দ শোনা যাবে।"

যেখানে দেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং চেয়েছেন, নতুন ধরনের পুলিশ বাহিনী গড়ে তোলা হোক, যারা আগের থেকে বেশি পেশাদার, একনিষ্ঠ, চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হওয়ার মতো শক্তিধর এবং প্রশিক্ষিত হবে, সেখানেই আবার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি জোর দিয়েছেন পুলিশের "স্মার্ট" হওয়ার উপর। প্রয়োজনীয় পেশাদারি স্বাধীনতা এবং দায়িত্ববোধ ছাড়া, লোক দেখানো ভাবে পুলিশবাহিনীর সংস্কার সাধন করে কীভাবে নাগরিক অধিকার সুরক্ষিত রাখা যাবে? সংবিধানকে সম্মান করার শৃঙ্খলা যখন পুলিশ বুঝবে, যখন তারা যথাযথভাবে আইন মেনে চলবে এবং স্বেচ্ছায় মানুষের নিরাপত্তার জন্য নিজেদের নিয়োজিত করাকে অগ্রাধিকার দেবে তখনই দেশ নিরাপদ এবং সুখী হতে পারবে ।

ETV Bharat Logo

Copyright © 2024 Ushodaya Enterprises Pvt. Ltd., All Rights Reserved.