দিল্লি : কয়েক সপ্তাহ ধরে মধ্যপ্রদেশের কমল নাথ নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস সরকারকে অভ্যন্তরীণ বিরোধিতার চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়েছে । কমল নাথ প্রথম ধাক্কা খান, যখন তাঁর 14 জন বিধায়ককে দিল্লির কাছে গুরুগ্রামে একটি হোটেলে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু সাম্প্রতিকতম ঘটনাটি, যদিও প্রত্যাশিত, কংগ্রেস সরকারের পতন ঘটাতে পারে যদি না কমল নাথ ভোপালের শরদ পওয়ার হয়ে উঠতে পারেন ।
যদি সংখ্যার কথা ধরা যায়, তাহলে কমল নাথের ভাগ্য নির্দিষ্ট হয়ে গেছে তখনই, যখন জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া, যিনি 2018 সালের ডিসেম্বরে মধ্যপ্রদেশ বিধানসভা ভোটে কংগ্রেস জেতার পর মুখ্যমন্ত্রী হতে চেয়েছিলেন, 22 জন বিধায়ককে সঙ্গে নিয়ে দলত্যাগ করেন । কংগ্রেসের হাতে রয়েছেন 99 জন বিধায়ক, প্রয়োজন 104 জনের । কমল নাথ তাঁর সরকার বাঁচাবার একটা সুযোগ দেখতে পেয়ে BJP-র মতো তাঁর বিধায়কদের একটা রিসর্টে লুকিয়ে রেখেছিলেন । এটা একটা প্রতিযোগিতা - যখন বিধানসভার ফ্লোরে এটা ঘটে - যেখানে কোটি কোটি টাকা আর প্রতিযোগী সরকারগুলোর দমনমূলক ক্ষমতাকে ব্যবহার করা হবে বিধায়কদের রাজনৈতিক আনুগত্য় বদলে দেওয়ার জন্য। রাজনৈতিক ব্যভিচারের আর একটা হতাশজনক নাটক অভিনীত হবে, যেখানে রাজনৈতিক দলগুলোর সরকার ভাঙা-গড়ার চেষ্টায় বেহিসেবি টাকা আর নোংরামির দাপট দেখা যাবে।
BJP, যারা আগে 'হস্তক্ষেপ নয়' নীতি অনুসরণ করছে বলে মনে হচ্ছিল, তারা যে শুধু সরকার ফেলে দেওয়ায় লক্ষ্যে গভীর মনোযোগী এমনটা নয়। পর পর কয়েকটি রাজ্যে হারের জেরে তারা রাজ্যসভায় যতগুলো আসন পেত, তার থেকেও বেশি পেতে তারা বিধায়কদের কাছে টেনে চলেছে । রাজ্যসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে BJP মরিয়া, আর তাদের বিপুল আর্থিক সম্পদ ও অন্যান্য যন্ত্র ব্যবহার করে তারা ঝাড়খণ্ড, রাজস্থান, এমনকী মহারাষ্ট্রেও বিরোধীদের সরকার ফেলার চেষ্টা করে চলেছে । এখন এটাই দেখার যে এই প্রচেষ্টায় তারা কতটা সফল হয়েছে।
সরকার ফেলার এই অপারেশনে টাকা যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, সেটা স্পষ্ট হয়ে যায়, যখন কংগ্রেসের কাছে ফিরে আসা মধ্যপ্রদেশের এক বিধায়ক বলেন, যে তাঁকে ২৫ কোটি টাকার অফার দেওয়া হয়েছিল । আর একজনের দাবি ১০০ কোটির । অর্থনীতি যখন তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে, তখন এইসব অঙ্কের কথা শুনে অদ্ভুত লাগে।
ভোটে জিততে বিপুল অর্থ খরচকারী বিধায়কদের কাছে টাকা একটা বড় আকর্ষণ । পাশাপাশি অনেকে এটা ভেবেও ক্ষুব্ধ যে দলের তরুণ নেতাদের যথেষ্ট জায়গা দেওয়া হচ্ছে না । জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া, যিনি রাহুল গান্ধির বন্ধু এবং সমর্থক, রাজ্য কংগ্রেসে একটা বৃহত্তর ভূমিকা খুঁজছিলেন। কিন্তু কমল নাথ এবং দিগ্বিজয় সিংয়ের যুগ্ম নেতৃত্ব তাঁকে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব থেকে দূরে ঠেলে রেখেছিল। তিনি কয়েক মাস আগেই তাঁর ট্যুইটার হ্যান্ডল থেকে কংগ্রেসের সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন করেন, যাতে অনেকে ভ্রু কুঁচকেছিলেন। যদিও, পরবর্তী পদক্ষেপের ব্যাপারে তিনি দোটানায় ছিলেন। একদিকে তিনি ৩৭০ ধারা প্রত্যাহার নিয়ে কংগ্রেসের ঘোষিত অবস্থানের সমালোচনা করেছেন, অন্যদিকে দিল্লি হিংসার সময় BJP-র বিরুদ্ধে সমাজে বিভেদ তৈরির অভিযোগ এনে সরব হয়েছেন।
যদিও তাঁর আদর্শগত অবস্থানকে বাস্তববাদী এবং সুযোগসন্ধানী বলেই মনে হয় । সিন্ধিয়ার ঠাকুমা ছিলেন BJP-র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ৷ এবং তাঁর দুই পিসি BJP-তে রয়েছেন। 2019 লোকসভা ভোটে হারের পর রাজ্যসভায় যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন জ্যোতিরাদিত্য। তিনি এক লখ ভোটে হেরেছিলেন BJP-র এমন এক প্রার্থীর কাছে, যাঁর প্রচারই ছিল গোয়ালিয়র প্রাসাদের বিরুদ্ধে । এই ফলের পর তিনি এটা বুঝতে পারেন, যে গুনা কেন্দ্র থেকে তিনি তিনবার ভোটে জিতেছেন, সেটা আর নিরাপদ নয়। তিনি চাইছিলেন 2019-এর পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে । তাঁর BJP-তে যোগদান হবে নিজের এলাকা বাঁচানোর জন্য প্রয়াস।
কমল নাথ, যিনি হার মানতে রাজি নন, কয়েকজন বিধায়ককে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছেন । তিনি সিন্ধিয়ার চাপের কাছে নতিস্বীকার করতে অস্বীকার করে দলের সভাপতিকে জানিয়ে দিয়েছেন, গোয়ালিয়র রাজবংশের উত্তরাধিকারীর বদলে তিনি প্রিয়াঙ্কা গান্ধিকে রাজ্যসভার আসন দেবেন । তাঁকে সমর্থন করেছেন দিগ্বিজয় সিং, যিনি কোনও দিন গোয়ালিয়র প্রাসাদ বা 'মহারাজা'-র প্রতি প্রীতিপ্রদর্শন করেননি।
দেখে যা মনে হচ্ছে, সিন্ধিয়ার বিদায়ে কংগ্রেসের উপর আঘাত আসবে। তেমনই ঘটবে, যেমন কর্নাটকে নিজের দল বেঁধে রাখতে ব্যর্থ হয়ে কংগ্রেস নিজের 17 বিধায়ককে আদর্শগতভাবে বিপরীত মেরুতে থাকা BJP-তে যেতে দিয়েছিল। যেভাবে BJP এতজন বিধায়ককে দলে টানছে, তাতে প্রার্থী বাছাইয়ে দলের দুর্বলতা এবং আদর্শ ধরে রাখতে নেতৃত্বের অক্ষমতাই প্রতিফলিত হচ্ছে। প্রার্থীদের জয়ের সম্ভাবনা খুঁজতে গিয়ে, কংগ্রেস বহুবার এমন ব্যক্তিদের টিকিট দিয়েছে, যাঁরা অতীতে BJP বা JDS-র সঙ্গে যুক্ত ছিলেন । এইসব বিধায়করা BJP-তে যাওয়ায় কোনও দোষ দেখছেন না । বাছাইয়ে এই খামতি হিন্দুত্ববাদকে আশকারা দিচ্ছে, যা যে কোনও জায়গা থেকে বিধায়ক টানতে পারে।
এখন কংগ্রেস কোথায় দাঁড়িয়ে? 2019 লোকসভা ভোটের পর, কংগ্রেস হল একটা ভাসমান জাহাজ। বিরাট পরাজয়ের দায় মাথায় নিয়ে কংগ্রেস সভাপতির পদে ইস্তফা দিয়েছেন রাহুল গান্ধি। নির্বাচনের মাধ্যমে সভাপতি বেছে নিতে তাঁর প্রস্তাব মেনে নেয়নি সোনিয়া গান্ধি ঘনিষ্ঠ গোষ্ঠী। নতুন সভাপতি নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত সোনিয়াকেই প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব সামলাতে বলা হয়েছে। সোনিয়া অসুস্থ। তিনি দিল্লি বিধানসভা ভোটের সময় দলের হয়ে প্রচারে নামেননি এবং BJP বিরোধী শক্তি হিসেবে নিজেদের ভোট আম আদমি পার্টিতে চলে যেতে দিয়েছেন। এই ভুল কৌশল কয়েকজন বিচ্ছিন্ন লিবারেলের সাময়িক প্রশংসা পেতে পারে, কিন্তু কংগ্রেসই এতে খাটো হয়েছে। BJP ধাক্কা খাওয়ায় যখন কিছু কংগ্রেস নেতা AAP-এর জয়ের প্রশংসা করেছেন, অনেকেই আবার অবাক হয়েছেন এটা ভেবে, যে এতে কংগ্রেসের কী লাভ হল! কংগ্রেসের ভোট শতাংশ নেমে গেছে ৪ শতাংশে।
কংগ্রেসের সামনে সমস্যা হল, কীভাবে BJP-বিরোধিতা গড়ে তোলা যায়। অনেকেই মনে করেন, CAA-বিরোধী আন্দোলন শাসকের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী বিরোধিতা তৈরি করেছে, এবং একটা রাজনৈতিক দলই এর ফায়দা তুলতে পারে। অন্যরা বিশ্বাস করেন, যে কংগ্রেস, যারা স্বাধীনতার পর থেকে কোনও বিক্ষোভে নেতৃত্ব দেয়নি, তাদের তৈরি হতে হবে চার বছর পর আবার লোকসভা নির্বাচনের জন্য।
এই যুক্তিতে সারবত্তা থাকতে পারে, কিন্তু কংগ্রেস নেতৃত্ব এবং আদর্শ নিয়ে ধন্দে ভুগছে। রাহুল গান্ধিকে তাঁর পরামর্শদাতারা বলেছিলেন, দলকে ভোটে জেতাতে চাইলে সংখ্যালঘুদের থেকে দূরে থাকতে হবে। রাহুল গুজরাত ভোটের সময় সেটাই করেছিলেন, সমস্তরকম ধর্মস্থানেও তাঁকে যেতে দেখা গিয়েছিল। তিনি নিশ্চিত করেছিলেন, যাতে ফেজ টুপি পরা কারও সঙ্গে তাঁর সেলফি না ওঠে। সংখ্যালঘুদের কীভাবে দেখা হবে, সেই নিয়ে ধন্দই এখন কংগ্রেসকে আকার দিচ্ছে। দেশের সংখ্যালঘুদের পাশে দল না দাঁড়াতে পারলে, তাদের কোনও তফাত থাকবে না BJP-র সঙ্গে, যারা মুসলিম ভোটের গুরুত্ব কমায় গর্ববোধ করে।
দেশজুড়ে যখন CAA এবং NRC-র বিরুদ্ধে ব্যাপক ক্ষোভ তৈরি হচ্ছে, কংগ্রেস সেখানে কথা বলা ছাড়া কিছুই করেনি। মহিলারা যেখানে CAA-র বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করছেন, শাহিনবাগের মতো দিল্লির সেইসব জায়গা এড়িয়ে গেছেন গান্ধিরা, যাতে মুসলিম তোষণের অভিযোগে তাঁরা BJP-র ট্রোলের শিকার না হন। যদি কংগ্রেসকে এই CAA-বিরোধী আন্দোলনের উপর ভিত্তি করে একটা যথাযথ বিরোধী শক্তি গড়ে তুলতে হয়, তাহলে তাদের BJP এবং RSS-র নিয়ন্ত্রণ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। ফের জোর দিতে হবে সেই অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতির উপর, যা ব্রিটিশদের থেকে দেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিয়েছিল।
যদিও সুযোগসন্ধানী কংগ্রেস নেতারা তাঁদের মতো চলতে থাকেন, তাহলে BJP-র বিরুদ্ধে এমন কঠিন লড়াই শুরু করার সাহস তাঁদের হবে না। এই কারণেই রাজস্থান, ছত্তিশগড়ের কংগ্রেস সরকারগুলো অত্যন্ত নড়বড়ে, এবং BJP-র চোরাগোপ্তা হানার মুখে অসহায় হয়ে থাকবে।