দুর্গাপুর, 27 ডিসেম্বর: অষ্টম নয়, একেবারে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ুয়ারা পায় মিড ডে মিল ৷ তাও আবার বাজার থেকে কেনা সবজি নয়, নিজেদের স্কুলে চাষ করা সবজি দিয়েই ৷ বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সবুজ বিপ্লব ঘটিয়ে রাজ্যকে দিশা দেখাচ্ছে দুর্গাপুরের এক প্রত্যন্ত অঞ্চলের সরকারি স্কুল ৷
রাজ্যের নামীদামি স্কুল যা করতে পারেনি তাই করে দেখাল দুর্গাপুরের নিউ টাউনশিপ থানা এলাকার জেমুয়া ভাদুবালা বিদ্যাপীঠ ৷ পড়ুয়াদের হাতে চাষ করা সবজি দিয়ে মিড ডে মিল হয় এই স্কুলে ৷ সেই পুষ্টিকর খাবার খায় গড়ে প্রত্যেকদিন প্রায় 600 জন ছাত্রছাত্রী ৷
রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে মিড ডে মিলে দুর্নীতির অভিযোগ সামনে আসছে । সেখানে একেবারে ব্যতিক্রমী চিত্র দুর্গাপুর- ফরিদপুর ব্লকের অখ্যাত এক পাড়াগাঁয়ের উচ্চ বিদ্যালয়ে । জেমুয়া ভাদুবালা বিদ্যাপীঠে প্রতিদিন সকাল দশটায় স্কুলে পৌঁছে যান শিক্ষক শিক্ষিকাদের সঙ্গে পড়ুয়ারা । স্কুলের প্রার্থনা শুরু হওয়ার আধ ঘণ্টা আগে তারা একসঙ্গে স্কুলের বাগানে সবজির পরিচর্যা করে । তারপর সেই সবজি তুলে নিয়ে যাওয়া হয় মিড- ডে মিলের রান্নার জন্য ।
শীতের মরশুমে আলু, পেঁয়াজ, টমেটো,ফুলকপি বাঁধাকপি, পালং শাক, পেঁয়াজ সহ কুড়ি রকমের সবজি চাষ করা হয়েছে । স্কুলে রয়েছে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত প্রায় 1200 পড়ুয়া । কিন্তু সরকারি নিয়মে রয়েছে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত মিড ডে মিলের খাবার খাওয়ানোর নিয়ম । এখানে একেবারে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ুয়াদের খাওয়ানো হয় প্রতিদিন পেট ভরে মিড ডে মিলের খাবার । সোমবার বিশেষভাবে পালন করা হয় দিনটি । এ দিন স্বাস্থ্য পরীক্ষা থেকে চক্ষু পরীক্ষা, সঙ্গে রক্তদান শিবির করা হয় । তারপর দুপুরে শুধু পড়ুয়াদেরই নয়, অভিভাবকদেরও পাত পেড়ে খাওয়ানো হয় । স্কুলের বাগানের সবজি হেঁসেলে যোগান দিয়েছে ।
অষ্টম শ্রেণির পড়ুয়া প্রীতি চক্রবর্তীর কথায়,"আমাদের স্কুলের শিক্ষক শিক্ষিকারা খুবই ভালো । পড়াশুনার সঙ্গে সবজি চাষ শেখায় ৷ এর থেকে আমরা নতুন কিছু শিখতে পারি । গোবর সার দিয়ে চাষ করা হয় । শরীর খারাপ যাতে না হয় সেজন্যই এভাবে চাষ করা হয় । আমরা খুব মজা পাই সবজির দেখাভাল করতে ৷ আমদের চারটি গ্রুপ রয়েছে ৷ সবাই একদিন করে আমরা সবজি গাছগুলির পরিচর্যা করি ৷"
তবে কেবল পড়ুয়া নয়, তাদের সবজি চাষে সবদিক থেকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন শিক্ষকেরাও ৷ এ বিষয়ে প্রধান শিক্ষক জয়নুল হক বলেন, "পড়ুয়ারা শিক্ষক-শিক্ষিকার সবাই মিলে একত্রিত হয়ে এই কাজ করি । আমাদের লক্ষ্য একটাই স্বাস্থ্য ঠিক রাখা । স্বাস্থ্য ঠিক রাখলেই পড়ুয়ারা সুরক্ষিত থাকবে । আমরা দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত মিড ডে মিলে খাবার দিই । কারণ একটায় প্রতিদিন যাতে পড়ুয়ারা স্কুলমুখী হয় ।"
তিনি আরও বলেন, "এবার চাষ করা হয়েছে দুই হাজার ফুলকপি, একহাজার বাঁধাকপি, নানা রকমের শাকসবজি । এছাড়াও সরষেও চাষ করেছি এবার ৷ কারণ স্কুলের বাগান থেকেই মিড ডে মিলের তেলের যোগানও দিতে চাইছি । সরকার তো সাহায্য করছেই । কিন্তু আমাদেরও কর্তব্য পড়ুয়াদের এগিয়ে নিয়ে যাওয়া । সেজন্যই আমাদের এই ভাবনা ।"
পড়াশোনার বাইরেও ছাত্রছাত্রীদের বিভিন্ন কাজে যুক্ত করার জন্য প্রধান শিক্ষকেই কৃতিত্ব দিচ্ছেন বাকি শিক্ষকরা ৷ তাঁদের কথায়, সরকারি বিদ্যালয়ে আশ্রমের পরিবেশ তৈরি করেছেন তিনি । স্কুলের এক শিক্ষিকা চৈতালি রায় বলেন, "প্রধান শিক্ষক হিসেবে জয়নুল হক এই স্কুলে যোগ দেওয়ার পর আমরা অন্যান্য শিক্ষক শিক্ষিকারা বুঝতে পারলাম বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে এতকিছু চাষ করা যায় । আজ ছাত্রছাত্রী থেকে শিক্ষক শিক্ষিকারা সবাই খুশি ।"
তাঁর কথায়, "স্কুলের মধ্যে এই যে সবজি চাষ, গরমের ছুটিতে ছাত্র-ছাত্রীদের রং তুলি নিয়ে বিদ্যালয়ের বিভিন্ন দেওয়ালে ছবি আঁকা, নাচ গান, এ সমস্ত কিছুই একটা আশ্রমের পরিবেশ এনে দিয়েছে স্কুলে । ছাত্র-ছাত্রীরা কৃষিকাজের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠছে পড়াশুনার পাশাপাশি । এখানকার উৎপাদিত শাকসবজির গুণগতমান দারুণ । স্বাভাবিকভাবে এই স্বাস্থ্যকর খাবার খেয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের স্বাস্থ্যের উন্নতিও ঘটছে । আজ আমাদের সবার ভালোলাগার জায়গা এই বিদ্যালয় ।"