ভারতীয় সেনাবাহিনীতে তৈরি হয়েছে চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ (CDS) নামে নতুন একটি পদ । গত ২৪ ডিসেম্বর এই পদটির আনুষ্ঠানিক ঘোষণা করেছে কেন্দ্রীয় সরকার ।
CDS তৈরির সময় ভাবনায় ছিল মূলত কয়েকটি বিষয়। প্রথমত প্রয়োজন ছিল তিন বাহিনীর সমন্বয় এবং একটা একমাত্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থার। দ্বিতীয়ত, দেশের অসামরিক শীর্ষপদগুলিতে কখনও বাহিনীর পরামর্শের প্রয়োজন হলে তা দেওয়া। CDS-কে প্রথম থেকে ভাবা হয়েছিল এক জন সুপার চিফ হিসাবে, যিনি বর্তমান তিন বাহিনীর সব পদের শীর্ষে থাকবেন। অনেকে আবার এই পদের জন্য ফাইভ
স্টার স্টেটাসের দাবিও করেছিলেন। অন্য গণতন্ত্রে এই পদের চরিত্র বিচার করে দেখা হয়েছিল এবং ভারতে এর প্রয়োজন ও উপযোগিতা নিয়েও আলোচনা হয়েছিল ।
CDS-এর প্রধান কাজ হিসাবে যেগুলির কথা বলা হয়েছে, সেগুলি হল, অভিযান, পরিবহণ, প্রশিক্ষণ, সহায়ক পরিষেবা, যোগাযোগ, মেরামতির বিষয়ে বাহিনীর মধ্যে সমন্বয় বাড়ানো, বাহিনীর যে কোনও প্রয়োজনের বিষয় জানা ও পদক্ষেপ গ্রহণ, তিন বাহিনীর সমন্বয় সাধন করে দেশীয় সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার করা, দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি জিনিসপত্রের ব্যবহার বাড়ানো ইত্যাদি ।
CDS-এর বেতন এবং অন্যান্য সুবিধা একেবারেই তিন বাহিনীর প্রধানের মতো হবে। তবে, প্রোটোকল অনুযায়ী তিনি তিন বাহিনীর থেকে উচ্চ পদে অবস্থান করবেন। 2001 সালে কারগিল যুদ্ধের পর একটি মন্ত্রীগোষ্ঠী তৈরি হয়েছিল । সেই গোষ্ঠী বিভিন্ন বিষয় পর্যবেক্ষণ করে সেনাবাহিনীর তিনটি বিভাগের মধ্যে সমন্বয়ের বিষয়ে একটি স্থির সিদ্ধান্তে এসেছিল । সেই সময় দেশের নিরাপত্তার ফাঁকফোঁকড় খুঁজতে গঠিত সেই উচ্চপর্যায়ের কমিটি জানায়, একজন ‘সিঙ্গল পয়েন্ট’ অফিসার প্রয়োজন, যিনি প্রতিটি সামরিক বিভাগ পরিচলনারই ভার নেবেন । 2012 সালে নরেশ চন্দ্র টাস্ক ফোর্স থেকে দাবি জানানো হয়, চিফ অব স্টাফ কমিটির একজন চেয়ারম্যান চাই। চিফ অব স্টাফ কমিটি সামরিক বাহিনীর তিনটি বিভাগের শীর্ষকর্তাদের নিয়ে তৈরি ।
আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রেও জরুরি পদক্ষেপের ক্ষেত্রে CDS একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে । বাজেটে অর্থ বরাদ্দ এবং প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে সঠিক চিত্রটা তুলে ধরতে পারবে । স্থল-বায়ু-জল তিন বাহিনীর ক্ষেত্রেই অনেক কিছু প্রয়োজনীয় বিষয় খামতি থেকে গিয়েছে, এক্ষেত্রে CDS-এর ভূমিকা উল্লেখযোগ্য । প্রয়োজন অনুসারে সমস্যা সমাধানের বিষয়টি এবার থেকে গুরুত্ব পাবে বলে মনে করা হচ্ছে ।
আগামী দিনে তথ্যপ্রযুক্তি, সাইবার হামলা, মহাকাশে নজরদারি-র মতো অত্যাধুনিক ক্ষেত্রে হামলার পরিমাণ বাড়তে চলেছে বলে আশঙ্কা স্বাভাবিকভাবেই এই ক্ষেত্রগুলির দিকে আগামী দিনে নজরদারি বাড়াতে হবে । CDS-এর অন্যতম দায়িত্ব হচ্ছে বিষয়টির দিকে নজর দেওয়া, এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করা । দেশের প্রথম ‘চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ’ (সিডিএস) হয়েছেন প্রাক্তন সেনাপ্রধান বিপিন রাওয়াত। এত দিন তিন বাহিনীর উপরে ছিলেন শুধুই রাষ্ট্রপতি। এবার তিন প্রধানের উপরে ‘চিফ অফ ডিফেন্স স্টাফ’ হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন বিপিন রাওয়াত ।
প্রাক্তন সেনাপ্রধান এখন সরকারের সঙ্গে সেনাবাহিনীর সংযোগ রক্ষাকারী ‘সিঙ্গল পয়েন্ট অ্যাডভাইজর’। সরকারকে প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত বিষয়ে সমস্ত পরামর্শ দেবেন তিনি। দেশের প্রতিরক্ষাকে আরও মজবুত করতে তিন বাহিনীর মধ্যে সমন্বয় বাড়ানো তো বটেই, তিন বাহিনীর পরামর্শদাতা হিসাবেও কাজ করবেন বিপিন রাওয়াত। তিন বাহিনীর মূল পরামর্শদাতার পোশাকেও দেখা যাবে তার ছাপ। চিফ অব ডিফেন্স স্টাফের পিক ক্যাপ, কাঁধের ব্যাজ, বেল্ট বাকল, ইউনিফর্মের বোতাম কেমন হবে তার প্রতীকী ছবি নিজেদের টুইটারে পোস্ট করেছে ভারতীয় সেনা ।
স্থলসেনা বাহিনী, নৌসেনা বা বায়ুসেনা প্রধানের পিক ক্যাপ যেমন হয়, CDS-এর পিক ক্যাপ হবে তার থেকে কিছুটা আলাদা। তিন বাহিনীর প্রতিনিধি সূচক ব্যাজ লাগানো থাকবে ক্যাপে। পিক ক্যাপে যে ব্যাজ লাগানো হবে, সেই ব্যাজই থাকবে বেল্ট বাকলেও । ইউনিফর্মের বোতামেও থাকবে তেমনই ব্যাজের আদল । জলপাইরঙা পোশাকের কাঁধের কাছে মেরুন প্যাচের উপর সোনালি রঙের
অশোকস্তম্ভ এবং ব্যাজ লাগানো থাকবে। র্যাঙ্ক বোঝানোর জন্য কাঁধে আলাদা করে কোনও তরোয়াল, লাঠি বা তারার চিহ্ন থাকবে না। CDS-এর কাজের নিরপেক্ষতা বোঝাতে তিন বাহিনীর কোনও রেজিমেন্টের প্রতীক বা চিহ্ন থাকবে না ইউনিফর্মে । তিন বাহিনীর প্রধান দফতরে সেই বাহিনীর নির্দিষ্ট পতাকা লাগানো থাকে। তবে চিফ অব ডিফেন্স স্টাফের অফিসে তিন বাহিনীর পতাকাই উড়তে দেখা যাবে কি না সেটা এখনও স্পষ্ট নয়। CDS-এর গাড়িতে যে পতাকা লাগানো হবে তার ছবি সামনে এনেছে প্রতিরক্ষা মন্ত্রক। তেরঙা এবং CDS-এর ব্যাজ দু’টোই থাকবে সেই বিশেষভাবে তৈরি পতাকায় ।
প্রধান তিনটি কর্তব্য পালন করাটা CDS-এর পক্ষে বেশ কঠিন। স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিটি কর্তব্যের ব্যাপ্তিই বিশাল এবং যদি সঠিক ভাবে দেখা যায়, এগুলি সেনাবাহিনীর পরিলেখ ও কার্যকারিতায় বদল আনতে পারে। সবার আগে মোদি সরকার যে বিষয়টিতে গুরুত্ব দিয়েছে, তা হল তিন বাহিনীর সমন্বয় সাধন । 1999 সালের কার্গিল যুদ্ধের পর এই বিষয়টি নিয়ে বহু বার আলোচনা হয়েছিল। এই বিষয়টি সফল
করতে হলে প্রয়োজন বেশ কয়েক বছরের অধ্যাবসায় এবং উচ্চ পেশাদারিত্ব।
দ্বিতীয় যে বিষয়টি CDS-এর কার্যকারিতাকে কড়া চ্যালেঞ্জের সামনে ফেলবে, তা হল অর্থ ও মানব সম্পদ, দুই ক্ষেত্রেই সম্পদের সঠিক বরাদ্দ। এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হবে DMA-তে সামরিক ও বেসামরিক কর্মীদের সঠিক মিশ্রণ এবং বাজেটে সশস্ত্র বাহিনীর জন্য যথেষ্ট অর্থের সংস্থান রাখা ।
CDS-এর ভূমিকা নিয়েও এ দিন ফের ব্যাখ্যা দিয়েছে প্রতিরক্ষা মন্ত্রক। তিন বাহিনীর প্রধানকে নিয়ে তৈরি চিফ অব স্টাফ কমিটির CDS-ই হবেন স্থায়ী প্রধান। তিন বাহিনীর যৌথ বিষয়ে প্রতিরক্ষামন্ত্রীর মূল সামরিক উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করবেন তিনি।
- প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের দেওয়া ব্যাখ্যা অনুযায়ী, তিন বাহিনীর যৌথ বিষয়ে প্রতিরক্ষামন্ত্রীর মূল পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করবেন CDS।
- তিন বাহিনীর যৌথ মঞ্চের (ট্রাই-সার্ভিস অর্গানাইজেশন) প্রশাসনিক দায়ভার থাকবে CDS-এর হাতে।
- ওই মঞ্চগুলির সামরিক কমান্ড অবশ্য নির্দিষ্ট বাহিনীর প্রধানের হাতেই থাকবে।
- সাইবার ও মহাকাশ কমান্ডের দায়িত্ব অবশ্য পুরোপুরি থাকবে CDS-এর হাতে ।
- প্রতিরক্ষা উপকরণ ক্রয় পরিষদ ও প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা কমিটির সদস্য হিসেবে কাজ করবেন সিডিএস ।
- তিন বাহিনীর যৌথ বক্তব্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানাবেন ।
- অভিযান, পরিবহণ, প্রশিক্ষণ, সহায়ক পরিষেবা, যোগাযোগ, মেরামতির বিষয়ে বাহিনীর মধ্যে সমন্বয় বাড়াবেন ।
- পরিকাঠামোর পূর্ণ ব্যবহার নিশ্চিত করবেন ।
- দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি উপকরণের ব্যবহার বাড়াবেন ।
- জরুরি অবস্থার জন্য তৈরি পরিকল্পনার মূল্যায়ন করবেন ।
- প্রতিরক্ষা উপকরণ ক্রয় পরিকল্পনা কার্যকর করবেন ।
- আন্তর্জাতিক সহযোগিতার পরিকল্পনা মূল্যায়ন করবেন ।
- সামরিক বিষয়ে কৌশল তৈরি করে সরকারের কাছে পেশ করবেন ।
- বাহিনীর লড়াইয়ের ক্ষমতা বাড়াতে সংস্কার কর্মসূচি তৈরি করবেন।
- তিন বাহিনীর যৌথ কার্যকলাপের উপরে বাৎসরিক রিপোর্ট দেবেন ।
- বাহিনীর মধ্যে বিশ্বাস বাড়াবেন ।
- সেনার তিন বাহিনীর শীর্ষ পদাধিকারীদের অবসরের বয়স 62 বছর । সে ক্ষেত্রে নতুন এই পদে অবসরের বয়স বাড়িয়ে করা হয়েছে 65 বছর। অর্থাৎ সেনাবাহিনী থেকে অবসরের পর এই পদে দায়িত্ব নিলে আরও তিন বছর চাকরির মেয়াদ বেড়ে যাবে। তবে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছিল, এই পদে সর্বোচ্চ তিন বছর চাকরি করতে পারবেন কোনও সেনা কর্তা । অর্থাৎ তিন বছর কাজ করা বা 65 বছর বয়স, যেটা আগে হবে, সেটাই হবে এই পদে চাকরি থেকে অবসরের সময় ।