45 বছর আগে 1975 সালে ভারত সবথেকে অন্ধকারময় সময়ে চলে গেছিল। জরুরি অবস্থার ঘোষণা করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি । তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ফখরুদ্দিন আলি আহমেদ সংবিধানের 352(1) ধারায় জরুরি অবস্থার নির্দেশ দেন । দীর্ঘ 21 মাস দেশে জরুরি অবস্থা জারি ছিল । 1975 সালের 25 জুন থেকে 1977 সালের 21 মার্চ পর্যন্ত চলেছিল জরুরি অবস্থা ।
জয়প্রকাশ নারায়ণ 1975 সালের 25 জুন সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির পদত্যাগের দাবিতে আইন অমান্য কর্মসূচির ডাক দেন । ওইদিন জরুরি অবস্থার ঘোষণা করে ইন্দিরা গান্ধি সরকার । পরের দিন অর্থাৎ 26 জুন অন্তর্বর্তী নিরাপত্তা আইনের অধীনে প্রধানমন্ত্রীর বিরোধীদের গ্রেপ্তার করা হয় । জয়প্রকাশ নারায়ণ, রাজ নরাইন, জ্যোতি বসু (কমিউনিস্ট পার্টি, মার্ক্সিস্ট), সমর গুহ (জনসংঘের সভাপতি) সহ 100-র বেশি মানুষকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ ।
জরুরি অবস্থা চলাকালীন উল্লেখযোগ্য ঘটনা
1975, 1 জুলাই : অসামরিক কার্যকলাপ বন্ধ করা হয় । জন্মনিয়ন্ত্রণের উপর বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজন বাধ্যতামূলক করা হয় । জরুরি অবস্থা চলাকালীন প্রধানমন্ত্রী ভূমিহীন শ্রমিক, ছোটো কৃষক এবং গ্রামীণ শিল্পীদের ঋণ পরিশোধ করার বিষয়ে 20টি উদ্যোগ নিয়েছিলেন । তাঁর পরিকল্পনা ছিল, এই সমস্ত শ্রমজীবী মানুষকে অন্য উপায়ে ঋণ দেওয়া । পাশাপাশি বিনা মজুরিতে শ্রম বন্ধ করা ও কৃষি জমি বিক্রি আইন প্রয়োগ করা । এই কর্মসূচির দ্বারা হস্তশিল্পকে বিশেষ সাহায্যের ঘোষণা করা হয় ।
দ্রব্যমূল্য কমানো থেকে কর ফাঁকি দেওয়া, চোরাচালান বন্ধ, জরুরি জিনিসের সরবরাহ জারি রাখা হয় । আয়কর ছাড় বেড়ে 8 হাজার টাকা হয় এবং বিনিয়োগের ক্ষেত্রে উদারনীতি গৃহীত হয় ।
1975, 4 জুলাই : দেশের চার জাতীয়তাবাদী দল ও তাদের 12 সহযোগী দল নিষিদ্ধ ঘোষিত করে কেন্দ্রীয় সরকার । এরমধ্যে আনন্দমার্গ রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক নকশাল এবং জামাত-এ-ইসলামি-এ-হিন্দ ছিল ।
1975, 3 অগাস্ট : এলাহাবাদ হাইকোর্টে ইন্দিরা গান্ধিকে ক্লিনচিট দিতে তৈরি হয় নতুন আইন ।
1975, অগাস্ট 4: কম করে 50 হাজার মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয় ।
1975, 15 অগাস্ট : বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মুজিবুর রহমানকে খুন করে বাংলাদেশি জঙ্গি নেতারা । এই ঘটনা ভারতের বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন সমস্যা তৈরি করে ।
1975, 15 সেপ্টেম্বর : দিল্লি হাইকোর্ট নির্দেশ দেয়, জরুরি অবস্থা চলাকালীন কেউ গ্রেপ্তার হলে তার বিরুদ্ধে অন্তর্বর্তী নিরাপত্তা আইনের অধীনে চার্জশিট গঠন করা হবে ।
1975, 26 সেপ্টেম্বর : প্রধানমন্ত্রী পদে নির্বাচনের জন্য নতুন সংশোধনী আইন গৃহীত হয় ।
1976, 9 জানুয়ারি : ভারতীয় সংবিধানের 19 নম্বর ধারায় যে সাতটি স্বাধীনতা দেওয়া হত তা রোধ করে ইন্দিরা গান্ধির সরকার ।
1976, 4 ফেব্রুয়ারি : লোকসভার সময়-সীমা বৃদ্ধি করা হয় ।
1976, 2 নভেম্বর : 42 তম সংবিধান সংশোধনী বিল লোকসভায় পাশ হয় । দেশকে সামাজিক, গণতান্ত্রিক এবং ধর্মনিরপেক্ষ করে গড়ে তুলতে এই বিল পাস করে ভারত সরকার ।
1977, 18 জানুয়ারি : লোকসভা ভেঙে দেন রাষ্ট্রপতি ।
1977, 21 মার্চ : জরুরি অবস্থা তুলে নেওয়া হয় ।
1977, 22 মার্চ : জনতা পার্টির পক্ষে বিপুল ভোট যায় ।
ভারতীয় সংবিধান তিন ধরনের জরুরি অবস্থা ঘোষণার অধিকার দেয় রাষ্ট্রপতিকে । তিন ধরনের জরুরি অবস্থা হল- জাতীয় জরুরি অবস্থা, রাজ্যের জরুরি অবস্থা এবং অর্থনৈতিক জরুরি অবস্থা । এই জরুরি অবস্থার চিন্তাভাবনা জার্মানির সংবিধান থেকে গৃহীত । 352 ধারায় জাতীয় জরুরি অবস্থা, 356 ধারায় রাজ্যে জরুরি অবস্থা (রাষ্ট্রপতি শাসন) ও 360 ধারায় অর্থনৈতিক জরুরি অবস্থা ।
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইন্দিরা গান্ধির অন্ধকারতম সময়
ইন্দিরা গান্ধির বিরুদ্ধে নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগে এলাহাবাদ হাইকোর্টে মামলা দায়ের করেন রাজ নারাইন । 1971 সালে সংসদীয় নির্বাচনে তিনি ইন্দিরা গান্ধির কাছে পরাজিত হন । এই প্রথম কোনও প্রধানমন্ত্রী আদালতের দ্বারা প্রশ্নের মুখে পড়েন । এলাহাবাদ হাইকোর্টে ইন্দিরা গান্ধি দোষী প্রমাণিত হন । 1971-এর নির্বাচন বাতিল করা হয় । এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হন ইন্দিরা গান্ধি । বিচারপতি ভি আর কৃষ্ণা আইয়ার 1975 সালে 24 জুন এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায়ে স্থগিতাদেশ দেন । এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় সরকার একটি সংশোধনী আইন পাশ করে । যেখানে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি এবং উপরাষ্ট্রপতির নির্বাচনকে আদালতে চ্যালেঞ্জ জানানো যাবে না । এর পাশাপাশি ইন্দিরা গান্ধির ছেলে সঞ্জয় গান্ধি যিনি সে সময় কোনও সরকারি পদে ছিলেন না, তিনি সরকারের সমস্ত নিয়ন্ত্রণ হাতে পান ।
21 মাস ধরে জরুরি অবস্থা চালানোর উদ্দেশ্য ছিল, ‘অন্তর্বতী উত্তেজনা’ নিয়ন্ত্রণ করা । ওই সময় সংবাদপত্রের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হয় । গোটা ঘটনাকে জাতীয় স্বার্থ বলে উল্লেখ করেন ইন্দিরা গান্ধি । এই বিষয়ে তিনটি কারণ উল্লেখ করেছেন তিনি । প্রথম, জয়প্রকাশ নারায়ণের ডাকে আইন অমান্যের ফলে দেশের নিরাপত্তা বিপদের মুখে পড়ে । দ্বিতীয়, তিনি মনে করেছিলেন অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ করা প্রয়োজন । তৃতীয়, তাঁঁকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য বিদেশি শক্তি সক্রিয় ছিল ।
জরুরী অবস্থার পরবর্তী সময়
1977 সালের জানুয়ারি মাসে কেন্দ্রীয় সরকার ঘোষণা করে, ওই বছরের মার্চ মাসে নির্বাচন হবে । বিরোধীরা জয়প্রকাশ নারায়ণের নেতৃত্বে নতুন দল গঠনের উদ্যোগ নেয় । স্বাধীনতার পর প্রথমবার কোনও অ-কংগ্রেসি দল কেন্দ্রে ক্ষমতা আসে । ওই বছর লোকসভা নির্বাচনে 330টি আসনের মধ্যে 154টি আসন পায় কংগ্রেস । অন্যদিকে 295 আসনে জয়ী হয় জনতা পার্টি । রায়বেরিলি থেকে হেরে যান ইন্দিরা গান্ধি । আমেঠি থেকে হেরে যান সঞ্জয় গান্ধি । এরপর ইন্দিরা গান্ধি এবং সঞ্জয় গান্ধিকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেন জনতা পার্টির সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চৌধুরি চরণ সিং । এর অর্থ সংসদ থেকে ইন্দিরা গান্ধিকে বিচ্যুত করা ।
কিন্তু জনতা পার্টির এই সিদ্ধান্ত তাদের বিরুদ্ধে যায় । সাধারণ মানুষের সহানুভূতি পান ইন্দিরা । তাঁঁর বিরুদ্ধে ওঠা নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগে ক্লিনচিট পান ইন্দিরা গান্ধি । এরপর জনসমক্ষে জরুরি অবস্থায় করা ভুল নিয়ে ক্ষমা চেয়ে নেন তিনি । 1980 সালের নির্বাচনে আরও একবার ক্ষমতায় আসেন গান্ধি । জরুরি অবস্থা থেকে যে শিক্ষা নেওয়া যায়- ইতিহাসবিদ জ্ঞান প্রকাশের এমারজেন্সি বই থেকে বলা যেতে পারে “ভারতীয় গণতন্ত্রের গর্বিত ইতিহাসে জরুরি অবস্থা একটি অন্ধকারময় অধ্যায় ।”