ক্ষমতায় যেই থাকুক, প্রধান সাংবিধানিক পদগুলিতে নিয়োগের প্রক্রিয়ায় পুনরাবৃত্তি হয় ৷ এটা সবসময়েই রাজনৈতিক সার্কাসের দম্ভকেই প্রকাশ করে ৷ CVC (কেন্দ্রীয় ভিজিল্যান্স কমিশন) এবং কেন্দ্রীয় তথ্য কমিশন (CIC)-এর প্রধান নিয়োগ ঘিরে একটি বিরক্তির বাতারবণ ছড়িয়ে পড়েছে ৷ আর দাবি করা হয়েছে, এই নিয়োগ অনিয়মে ভরা ৷ ২০১৯ সালের ৯ জুন মুখ্য ভিজিল্যান্স কমিশনার কে ভি চৌধুরির কার্যকালের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় ওই পদ শূন্যই পড়েছিল ৷ পদে বসানো হয়েছে সঞ্জয় কোঠারিকে, যিনি এতদিন পর্যন্ত ভারতের রাষ্ট্রপতির সচিব হিসেবে কাজ করছিলেন ৷ অন্যদিকে, সুধীর ভার্গবের কার্যকালের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় CIC হিসেবে নিয়োগ করা হয় বিমল জুলকাকে ৷ প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে তৈরি একটি কমিটি এই দু’জনকে বেছে নিয়েছে ৷ যদিও প্রধানমন্ত্রী পুরো তালিকাটিই বিরোধী দলনেতাকে দেখানোর নির্দেশ দিয়েছেন ৷ তবে তা এখনও হয়নি ৷ এটাই আপত্তির প্রথম কারণ ৷ দ্বিতীয়ত, যোগ্য প্রার্থী খোঁজার জন্য যে কমিটি গঠন করা হয়েছিল, প্রার্থীদের চূড়ান্ত তালিকায় কমিটির এক সদস্যের নাম পাওয়া গিয়েছে ৷ যা নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক তৈরি হয়েছে ৷ নিয়োগের সিদ্ধান্তে সংখ্যাগরিষ্ঠের মত থাকায় কংগ্রেস নেতা অধীররঞ্জন চৌধুরির আপত্তি গ্রাহ্য হয়নি ৷ সরকারের ‘নির্দেশ’ই যদি শেষ কথা হবে, তাহলে এই ধরনের বাছাই কমিটি গঠন করার উদ্দেশ্য নিয়েই সন্দেহ তৈরি হয়েছে ৷ গত বছর এই সময় CBI-এর ডিরেক্টর পদে ঋষি কুমারের নিয়োগ ঘিরেও বিতর্ক তৈরি হয়েছিল ৷ প্রশ্ন তোলা হয়েছিল যে দুর্নীতি সংক্রান্ত মামলায় তাঁর তদন্ত প্রক্রিয়া যথাযথ না হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে কী ভাবে ওই পদে বসানো হল ৷ এই ধরনের পদের সম্মান বাড়াতে সৎ এবং সাহসী আধিকারিকদের প্রয়োজন ৷ বেছে নেওয়ার সময় এর বদলে অন্যান্য আরও অনেক কারণ অনেক বেশি প্রভাব ফেলছে ৷ এই ধরনের অভিযোগের জন্য বাছাই প্রক্রিয়া নিয়ে উপহাসই বেশি হচ্ছে ৷ যদিও এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেছে সুপ্রিম কোর্ট এবং উৎসাহও দিয়েছে ৷ তার পরও রাজনৈতিক ব্যবস্থায় কোনও বদল আসেনি ৷ ফলে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলির কার্যকারিতা ক্রমশ কমছে ৷
যখন থেকে দুর্নীতি করাকে রাজনৈতিক অধিকার হিসেবে ধরা হচ্ছে, তখন থেকেই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মান নেমে যাওয়া ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে ৷ ২০১২ সালে BJP-র বর্ষীয়ান নেতা লালকৃষ্ণ আদবানি বলেছিলেন, শাসকদলের আশীর্বাদ যাঁর মাথায় রয়েছে, তিনি স্বজনপোষণ এবং রাজনৈতিক কৌশলের মাধ্যমে সাংবিধানিক পদগুলির দিকে ঝুঁকতে পারেন ৷ আমরা সকলেই জানি যে UPA-র শাসনকালে নির্বাচন কমিশনে নবীন চাওলার অন্তর্ভুক্তি ঘিরে কী ধরনের বিতর্ক তৈরি হয়েছিল ৷ তৎকালীন CEC গোপালস্বামী ভারতের রাষ্ট্রপতিকে চিঠি লিখে অভিযোগ করেছিলেন ৷ তাঁর অভিযোগ ছিল, নবীন চাওলার অন্তর্ভুক্তির স্বজনপোষণের মাধ্যমে হয়েছে ৷ তিনি নির্বাচন সদন থেকে গোপন তথ্য শাসকদলের কাছে পাচার করার দুষ্ট চক্রে জড়িত ৷ ওই বিষয়ের উপর ভিত্তি করে আদবানি পরামর্শ দিয়েছিলেন, মুখ্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের জন্য প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি কলেজিয়াম গড়ে উঠুক ৷ সেখানে প্রধান বিচারপতি, কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী, লোকসভা ও রাজ্যসভার বিরোধী দলনেতা থাকবেন ৷ তাহলে এই নিয়োগে বিরোধীদেরও ভূমিকা থাকবে ৷ তাছাড়া মুখ্য ভিজিল্যান্স কমিশনার হিসেবে পি জে থমাসের নিয়োগ এবং তা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে সওয়াল মহমোহন সরকারের মুখ পুড়িয়েছিল ৷ CVC নিয়েও সুপ্রিম কোর্টের রায়ের জেরে UPA সরকারকে পিছু হটতে হয়েছিল ৷ থমাসের বিরুদ্ধে পাম ওলিন মামলার নিষ্পত্তি না হলেও প্যানেলের দু’জনের মধ্যে একজনকে বেছে নেওয়ার পক্ষে রাজি ছিলেন বিরোধী দলনেত্রী সুষমা স্বরাজও ৷ যদিও সুপ্রিম কোর্ট স্পষ্টভাবে যোগ্যাতার মান এবং নৈতিক মূল্যবোধ নির্ধারণ করে দিয়েছে, তার পরও সরকারগুলি নিজেদের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রমাণ করতে পারেনি ৷
নির্বাচন কমিশন, কেন্দ্রীয় ভিজিল্যান্স কমিশন, CAG, কেন্দ্রীয় তথ্য কমিশন, CBI- এই গুলি হল সেই সমস্ত প্রধান প্রতিষ্ঠান, যেগুলি জনসাধারণের ভালো করার জন্য তৈরি করা হয়েছে ৷ নির্বাচন সদন ছাড়া বাকিগুলিকে তৈরি করা হয়েছে দুর্নীতি দূর করা এবং সাধারণ মানুষের স্বার্থ রক্ষার জন্য ৷ এই প্রতিষ্ঠানগুলি কি এমন কোনও সৎ মানুষের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে, যিনি কোনওরকম চাপের কাছে মাথা নোয়াবেন না, তাহলেই ভারত ‘দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ’-এর তালিকায় আর থাকবে না ৷ রঞ্জিত সিনহা CBI-র ডিরেক্টর পদে থাকার সময় সুপ্রিম কোর্টের বিচারাধীন মামলাগুলিতে নির্লজ্জভাবে প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করেছেন ৷ সম্প্রতি অলোক বর্মা এবং আস্থানার মধ্যে লড়াই প্রতিষ্ঠানের মর্যাদাকে আরও নিচে নামিয়েছে ৷ সুপ্রিম কোর্ট তিনমাসের মধ্যে কেন্দ্র এবং রাজ্যস্তরে তথ্য কমিশনের সব শূন্যপদ পূরণ করার নির্দেশ দিয়েছে ৷ এরই প্রেক্ষিতে ওই পদগুলি পছন্দের পাত্রদের পুনর্বাসনের জায়গা হয়ে দাঁড়িয়েছে ৷ ৬ বছর ধরে লোকপালের মতো প্রতিষ্ঠানকে অকেজো করে রাখা হয়েছে ৷ এই প্রতিষ্ঠানকে কোনও ক্ষমতাই দেওয়া হয়নি ৷ ফলে তা হতাশাজনক হয়ে উঠছে ৷ ২০১৮ সালে সুপ্রিম কোর্ট পরামর্শ দিয়েছিল যে নির্বাচন কমিশনার নিয়োগে একটি স্বাধীন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে ৷ এ নিয়ে আইন কমিশনের মন্তব্য, এই ধরনের নিয়োগে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হওয়া সম্ভব নয় ৷ তাই শূন্যপদ কখনওই পূরণ করা যাবে না ৷ এর থেকেই স্পষ্ট হয় যে এই বিষাক্ত অভ্যাস ধীরে ধীরে জাতীয় রীতিতে পরিণত হচ্ছে ৷ ভারতে এই ধরনের প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে শ্রদ্ধা তখনই বাড়বে, যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, জার্মানি, জাপানের থেকে আমরা নিরপেক্ষ তদন্তকারী প্রতিষ্ঠান চালানোর পদ্ধতি অনুসরণ করব ৷