ETV Bharat / bharat

ক্রমক্ষয়িষ্ণু অন্ধ্রপ্রদেশ বিধান পরিষদ - n.t rama rao

বিধান পরিষদের ইতিহাস কী ? কী প্রয়োজনীয়তা রয়েছে এই কক্ষের । অন্য রাজ্যগুলিতে কী অবস্থায় বিধান পরিষদ ? অন্ধ্রপ্রদেশের ক্ষয়িষ্ণু বিধান পরিষদ নিরিখে দেশের সমস্ত বিধান পরিষদের পর্যালোচনা করলেন রাজ্যসভার প্রাক্তন সেক্রেটারি জেনেরাল বিবেক কে অগ্নিহোত্রি ।

ছবি
ছবি
author img

By

Published : Feb 17, 2020, 10:50 AM IST

প্রস্তাব

চলতি বছরের 27 জানুয়ারি অন্ধ্রপ্রদেশ বিধানসভার তরফে সংসদে বিধান পরিষদ (APLC) বাতিল ঘোষণা করার প্রস্তাব করা হয় । সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়টি হল, রাজ্য বিধানসভার উচ্চকক্ষ বাতিলের প্রস্তাব প্রথম দিয়েছিলেন বর্তমান প্রধান বিরোধী দল তেলুগু দেশম পার্টির প্রতিষ্ঠাতা এন টি রামা রাও । তিনি 1985 সালে এই বিধান পরিষদ বাতিল করতে সমর্থও হয়েছিলেন । পরে 2007 সালে বিধান পরিষদ ফিরিয়ে এনেছিলেন ওয়াই এস রাজশেখর রেড্ডি অর্থাৎ রাজ্যের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী জগন মোহন রেড্ডির বাবা ।

এই প্রস্তাবের উপর এক আলোচনাসভায় জগন মোহন রেড্ডি বলেন, বিধান পরিষদ আর সাধারণ মানুষের কোনও কাজে লাগে না । এটি একটি সাদা হাতিতে পরিণত হয়েছে । প্রস্তাবের সমর্থনে তিনি দাবি করেন, বিধান পরিষদ রাজ্যের উন্নয়নে বাধার সৃষ্টি করছে । এটি রাজ্যের উন্নতি অর্থাৎ অন্ধ্রপ্রদেশ ডিসেন্ট্রালাইজেশন অ্যান্ড ইনক্লুসিভ ডেভেলপমেন্ট অব অল রিজিয়নস (APDIDAR) বিল এবং অন্ধ্রপ্রদেশ ক্যাপিটাল রিজিয়ন ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (APCRDA) প্রত্যাহার সংক্রান্ত বিলের মাঝখানে এসে দাঁড়াচ্ছে । দ্বিতীয় এই বিলটি রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী এন চন্দ্রবাবু নাইড়ু এনেছিলেন অন্ধ্রপ্রদেশের নতুন রাজধানী অমরাবতীকে সাজিয়ে তোলার জন্য । প্রথম বিলের উদ্দেশ্য উন্নয়নের বিকেন্দ্রীকরণের মতো এক অভিনব পরিকল্পনার রূপায়ণ । একটি নয়, রাজ্যে তিনটি রাজধানী চান জগন মোহন রেড্ডি । প্রশাসনিক রাজধানী বিশাখাটনম, বিচারবিভাগীয় রাজধানী কুর্নুল ও আইনবিষয়ক রাজধানী অমরাবতী । এই বিল দু’টি বিধান সভায় পাশ হওয়ার পর তা সিলেক্ট কমিটির কাছে পাঠিয়েছিল বিধান পরিষদ ।

বিভিন্ন রাজ্যে বিধান পরিষদ

সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে অন্ধ্রপ্রদেশ-সহ দেশের বাকি রাজ্যগুলির বিধান পরিষদের একটা বর্ণময় ইতিহাস আছে । 1956 সালে অন্ধ্রপ্রদেশ বিধানসভাতে পাশ হওয়া প্রস্তাবের ভিত্তিতে 1958 সালে তৈরি হয় বিধান পরিষদ । 1985 সালে এন টি রামা রাও এই পরিষদ বাতিল করেন । তাঁর যুক্তি ছিল, এই পরিষদ একটি অনির্বাচিত সংস্থা, যার নাক গলানোর ফলে গুরুত্বপূর্ণ এবং রাজ্যের উন্নতির স্বার্থে করা পদক্ষেপ থমকে যাচ্ছে । তিনি আইন পরিষদ নিয়ে সেদিন যা বলেছিলেন, সাড়ে তিন দশক পর প্রায় সেই একই যুক্তি দেন জগন মোহন রেড্ডি । একবার ব্যর্থ হলেও এই পরিষদ 2007 সালে ফিরিয়ে এনেছিলেন ওয়াই এস আর রেড্ডি ।

2019 সালে সালে জম্মু ও কাশ্মীরের পুনর্গঠনের পর দেশের মাত্র ছ’টি রাজ্যে আইন পরিষদ রয়েছে । সেগুলি হল অন্ধ্রপ্রদেশ, বিহার, কর্নাটক, মহারাষ্ট্র, তেলঙ্গানা এবং উত্তরপ্রদেশ । আইন পরিষদ গঠনের জন্য 1956 সালে মধ্যপ্রদেশ বিধানসভায় আইন পাশ হয় । কিন্তু সেই আইন কার্যকর করার জন্য নোটিশ আজ পর্যন্ত দেওয়া হয়নি । রাজস্থান ও অসমে আইন পরিষদ তৈরির প্রস্তাব এখনও সংসদের বিবেচনাধীন ।

প্রাথমিকভাবে চালু হলেও স্বাধীনতার পর 1970 সালে পঞ্জাব, 1986 সালে তামিলনাড়ু ও 1969 সালে পশ্চিমবঙ্গ থেকে বিধান পরিষদের বিলোপ ঘটে । 2010 সালে বিধান পরিষদের পুনর্গঠনের উদ্দেশ্যে প্রস্তাব পাশ হয় তামিলনাড়ু বিধানসভায় । এই বিষয়ে সংসদে আইন পাশ হয় । কিন্তু তা কার্যকর করার জন্য নোটিশ জারি হওয়ার আগেই রাজ্যে ক্ষমতা বদল হয় এবং নতুন সরকার বিধান পরিষদের বিলুপ্তি চেয়ে আবেদন করে । 2012 সালে এই প্রস্তাব রাজ্যসভায় পেশ হয় । সেই কারণে তামিলনাড়ুর এই মুহূর্তে কোনও আইন পরিষদ নেই ।

সাংবিধানিক বিধান

বিভিন্ন রাজ্যে বিধান পরিষদের এই ক্ষয়িষ্ণু অবস্থার অন্যতম কারণ, সংবিধানে এই প্রতিষ্ঠানের দুর্বল অবস্থান । সংসদের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভার মতো রাজ্যস্তরে বিধান পরিষদ থাকা আবশ্যক নয় । সংবিধানের 169 নম্বর ধারার প্রথম উপধারা অনুযায়ী, কেন্দ্র চাইলে কোনও রাজ্যে বিধান পরিষদের গঠন বা বিলোপ ঘটাতে পারে । তবে সেক্ষেত্রে সেই রাজ্যের বিধানসভায় বিল পাশ হতে হবে । এই বিল পাশ করাতে হবে বহুমতের ভিত্তিতে । ভোটদানের সময় বিধানসভার অন্তত দুই তৃতীয়াংশ সদস্যকে উপস্থিত থাকতেই হবে । তবে, কেন্দ্র ইচ্ছা করলে রাজ্যের প্রস্তাব মানতেও পারে, আবার না মানতেও পারে । যেহেতু 168 নম্বর ধারায় সেই সব রাজ্যের নাম নথিভুক্ত রয়েছে, যাদের বিধান পরিষদ রয়েছে, প্রতিবার কোনও রাজ্যে আইন পরিষদ তৈরি হলে বা বিলুপ্ত হলে এই ধারায় বদল আনতে হয় ।

আইন প্রণয়ন বা বিল পেশের পরিপ্রেক্ষিতে বিধান পরিষদ আর রাজ্যসভা প্রায় সমার্থক । দুই ক্ষেত্রেই একমাত্র অর্থবিল বাদে কোনও বিলের জন্যই দুই কক্ষের অনুমতির প্রয়োজন হয় না । কিন্তু আইন সংশোধন বা বাতিলের বিষয় মাথায় রাখলে বলা যায়, দুই কক্ষের ক্ষমতায় তফাৎ বিপুল । বিধানসভায় পাশ হওয়াৱ পর যদি কোনও বিল বিধান পরিষদ খারিজ করে, বা বিলে সংশোধনী খারিজ করে বা বিল পেশ হওয়ার তিন মাস পর্যন্ত কোনও পদক্ষেপ না করে, তা হলে ফের সেই বিল বিধানসভায় পাশ করিয়ে তা বিধান পরিষদে পাঠাতে পারে সরকার । যদি ফের তা পরিষদ খারিজ করে বা সংশোধনী এনে বিধানসভায় ফেরত পাঠায় বা পরবর্তী এক মাস কোনও পদক্ষেপ না করে, তা হলে দ্বিতীয় বার বিধানসভায় পাশ হওয়া বিলটি দুই কক্ষেই পাশ হওয়া বিল হিসাবে গণ্য হবে । অর্থাৎ, কোনও বিল নিয়ে আপত্তি থাকলে তা মেটাতে দুই কক্ষের মিলিত সভার কোনও বিকল্প আইনে নেই ।

সংসদ চাইলে বিধান পরিষদের ক্ষমতা বাড়াতে বা কমাতে পারে । রাজ্যসভার ক্ষেত্রে সেই বিকল্প ক্ষমতা সংবিধানেই দেওয়া আছে। রাজ্যসভার সদস্যদের মতো বিধান পরিষদের সদস্যরা রাষ্ট্রপতি বা উপ রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ভোট দিয়ে অংশ নিতে পারেন না ।

সংবিধানের এই ব্যবস্থা থেকেই স্পষ্ট যে, বিধানসভার দ্বিতীয় মত হিসেবে আইন পরিষদকে স্বীকৃতি দেওয়া নিয়ে দ্বিমত রয়েছে । বিষয়টির সমালোচনা করে বিধান পরিষদ বিলোপ করার কথা বলার সময় এনটি রামা রাও ও জগন মোহন রেড্ডিও এই একই যুক্তি দেখিয়েছিলেন । এই পরিষদ সাধারণ মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে না এবং এর ফলে কোনও বিল পাশ করতে অহেতুক দেরি হয়, এই যুক্তিতে বিধায়কদেরও একটা বড় অংশ পরিষদের বিপক্ষে ।

অন্ধ্রপ্রদেশের বর্তমান পরিস্থিতি

এই অবস্থায় অন্ধ্রপ্রদেশের পরিস্থিতিটা ঠিক কী? বিধান পরিষদ বিলোপের প্রস্তাব যেহেতু অন্ধ্রপ্রদেশ বিধানসভায় পাশ হয়ে গেছে, এই অবস্থায় কী করণীয় তা পুরোপুরি নির্ভর করছে সংসদের উপর । কিন্তু, আগেই যেমন বলা হয়েছে, সংসদ এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতেও পারে, আবার না নিতেও পারে । যদি এই বিষয়টি সংসদের আলোচনার তালিকায় থাকেও, তা হলেও তা নিয়ে আলোচনা হওয়া কঠিন । কারণ 12 ফেব্রুয়ারি থেকে 1 মার্চ পর্যন্ত সংসদে ছুটি থাকবে । তাই অগ্রাধিকারের তালিকা । না থাকলে পূর্বনির্ধারিত বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনার পর এই বিষয়ে আলোচনার সম্ভাবনা বেশ কম ।

অন্যদিকে, বিধান পরিষদ যদি নির্ধারিত তিন মাস সময়সীমার মধ্যে দু’টি বিল (APDIDAR ও APCRDA) সংশোধন-সহ ফিরিয়ে দেয়, তাহলে বিধানসভাকে এই বিল দু’টি নিয়ে ফের সিদ্ধান্ত নিতে হবে । বিধান পরিষদের প্রস্তাব না মেনে যদি বিধানসভাতে ফের বিল দু’টি পাশ হয়, তাহলে তা অন্ধ্রপ্রদেশের রাজ্যপালের টেবিলে যাবে । এই অবস্থায় প্রযোজ্য হবে 200 ও 201 নম্বর ধারা । 200 নম্বর ধারা অনুযায়ী, এই অবস্থায় রাজ্যপাল ঘোষণা করতে পারেন যে, তিনি রাষ্ট্রপতির বিবেচনার জন্য বিলগুলি সংরক্ষণ করেছেন । ছ'মাসের মধ্যে রাষ্ট্রপতি বিল নিয়ে তাঁর মত জানাতে পারেন, বা মত না জানাতে পারেন, বা পুনর্বিবেচনার জন্য বিল দু’টি বিধানসভায় ফেরত পাঠাতে পারেন । যদি বিল ফেরত পাঠানো হয়, তাহলে তা ফের দুই কক্ষে সেই বিল পাশ করিয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাতে হবে । রাষ্ট্রপতি এই বিল নিয়ে তাঁর মত জানাতে বাধ্য কি না, সে বিষয়ে সংবিধানে কিছুই বলা নেই ।

উচ্চ কক্ষের প্রয়োজনীয়তা

উচ্চ কক্ষের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে বিতর্কের বয়স এই কক্ষের বয়সের প্রায় সমান । এই বিতর্কের গোড়ায় পৌঁছাতে গেলে যেতে হবে অষ্টাদশ শতকে । তখন আমেরিকার সংবিধান রচিত হচ্ছিল । জর্জ ওয়াশিংটনকে একদিন ব্রেকফাস্টের টেবিলে টমাস জেফারসন দুই কক্ষের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন করেন । ওয়াশিংটন এর উত্তরে জেফারসনকে প্রশ্ন করেন, "আমরা ডিশে কফি ঢালি কেন?" উত্তরে জেফারসন বলেন, "ঠান্ডা করার জন্য।" তখন ওয়াশিংটন বলেন, "একইরকম ভাবে, আইনকে সেনেটের ডিশে ঢালা হয় তা ঠান্ডা করার জন্য।"

ভারতীয় সংবিধানের প্রণেতাদেরও উচ্চ কক্ষের কার্যকারিতা ও প্রয়োজনীয়তা নিয়ে বহু প্রশ্ন ছিল । কিন্তু তাঁদের বেশির ভাগের মত ছিল উচ্চ কক্ষের দিকেই যেহেতু এই কক্ষ পুরোপুরি রাজনীতিকদের দ্বারা প্রভাবিত নয় । তাঁদের ধারণা ছিল, এই কক্ষের সদস্যরা আইনকে অন্য চোখে দেখবেন । এই কক্ষের সবচেয়ে বড় সমর্থক ছিলেন এন গোপালস্বামী আয়েঙ্গার যিনি এই মর্মে প্রস্তাব দেন । তাঁর যুক্তি ছিল যে, এই কক্ষে অনেকটাই ‘মর্যাদাপূর্ণ বিতর্ক’ হবে এবং এই কক্ষ আইনের প্রয়োগকে ততটাই দীর্ঘায়িত করবে যতক্ষণ এই সংক্রান্ত আবেগ হ্রাস পাবে । তাঁর মতে, এই কক্ষ হল "দেরি করিয়ে দেওয়ার অস্ত্র" যেখানে সমাজের বিভিন্ন অংশের মর্যাদাপূর্ণ ব্যক্তিরা নিজেদের জ্ঞানের প্রকাশ করতে পারেন । লোকনাথ মিশ্রের মতে, এটি একটি নিখুঁত কক্ষ, যেখানে উচ্চ পর্যায়ে সব বিষয়ের পর্যালোচনা করা হয় । এই কক্ষে বিশেষ সমস্যা নিয়ে অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা আলোচনা করেন বলেও তিনি জানিয়েছিলেন । এম অনন্তসায়ানম আয়েঙ্গারের মত ছিল, এখানে সেই সব অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করবেন, যাঁরা ভোটে হয়তো জিততে পারবেন না ।

অন্যদিকে মহম্মদ তাহিরের বক্তব্য ছিল, এই কক্ষ গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত কক্ষের কাজকে বাধা দেওয়ার জন্য ব্রিটিশদের তৈরি সাম্রাজ্যবাদী হাতিয়ার । অধ্যাপক শিব্বন লাল সাক্সেনা বলেছিলেন, কোনও দেশ এই ধরনের উচ্চ কক্ষের ফলে উপকৃত হয়নি ।

ভবিষ্যৎ: বিধান পরিষদের পুনর্গঠন

রাজ্যের উচ্চ কক্ষ, অর্থাৎ বিধান পরিষদগুলি কাঠামো এই যুগের পরিপ্রেক্ষিতে কিছুটা সেকেলে এবং কিছুটা ভ্রান্ত । স্নাতক ও শিক্ষকদের প্রতিনিধির তেমন কোনও প্রয়োজন আজকের দিনে নেই । সংবিধানের 73 ও 74 নম্বর সংশোধনীর মাধ্যমে পঞ্চায়েত ও পৌর সংস্থাগুলি তৈরির পর সংসদের উচিত এদের সঙ্গে বিধানসভার যোগসূত্র তৈরির । বাকি প্রয়োজনীয় বিষয়গুলি রাজ্যপালের কোটায় থাকা মনোনয়নের মাধ্যমে পূর্ণ করা সম্ভব ।

এই ধরনের পুনর্গঠন বিধান পরিষদের ক্ষমতা বাড়াবে । কিন্তু এর সঠিক প্রয়োগ তখনই হবে যখন আরও একাধিক রাজ্য আইন পরিষদের প্রণয়নে এগিয়ে আসবে । এর ফলে ভবিষ্যতে লাভ হবে ভারতীয় গণতন্ত্রেরই ।

প্রস্তাব

চলতি বছরের 27 জানুয়ারি অন্ধ্রপ্রদেশ বিধানসভার তরফে সংসদে বিধান পরিষদ (APLC) বাতিল ঘোষণা করার প্রস্তাব করা হয় । সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়টি হল, রাজ্য বিধানসভার উচ্চকক্ষ বাতিলের প্রস্তাব প্রথম দিয়েছিলেন বর্তমান প্রধান বিরোধী দল তেলুগু দেশম পার্টির প্রতিষ্ঠাতা এন টি রামা রাও । তিনি 1985 সালে এই বিধান পরিষদ বাতিল করতে সমর্থও হয়েছিলেন । পরে 2007 সালে বিধান পরিষদ ফিরিয়ে এনেছিলেন ওয়াই এস রাজশেখর রেড্ডি অর্থাৎ রাজ্যের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী জগন মোহন রেড্ডির বাবা ।

এই প্রস্তাবের উপর এক আলোচনাসভায় জগন মোহন রেড্ডি বলেন, বিধান পরিষদ আর সাধারণ মানুষের কোনও কাজে লাগে না । এটি একটি সাদা হাতিতে পরিণত হয়েছে । প্রস্তাবের সমর্থনে তিনি দাবি করেন, বিধান পরিষদ রাজ্যের উন্নয়নে বাধার সৃষ্টি করছে । এটি রাজ্যের উন্নতি অর্থাৎ অন্ধ্রপ্রদেশ ডিসেন্ট্রালাইজেশন অ্যান্ড ইনক্লুসিভ ডেভেলপমেন্ট অব অল রিজিয়নস (APDIDAR) বিল এবং অন্ধ্রপ্রদেশ ক্যাপিটাল রিজিয়ন ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (APCRDA) প্রত্যাহার সংক্রান্ত বিলের মাঝখানে এসে দাঁড়াচ্ছে । দ্বিতীয় এই বিলটি রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী এন চন্দ্রবাবু নাইড়ু এনেছিলেন অন্ধ্রপ্রদেশের নতুন রাজধানী অমরাবতীকে সাজিয়ে তোলার জন্য । প্রথম বিলের উদ্দেশ্য উন্নয়নের বিকেন্দ্রীকরণের মতো এক অভিনব পরিকল্পনার রূপায়ণ । একটি নয়, রাজ্যে তিনটি রাজধানী চান জগন মোহন রেড্ডি । প্রশাসনিক রাজধানী বিশাখাটনম, বিচারবিভাগীয় রাজধানী কুর্নুল ও আইনবিষয়ক রাজধানী অমরাবতী । এই বিল দু’টি বিধান সভায় পাশ হওয়ার পর তা সিলেক্ট কমিটির কাছে পাঠিয়েছিল বিধান পরিষদ ।

বিভিন্ন রাজ্যে বিধান পরিষদ

সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে অন্ধ্রপ্রদেশ-সহ দেশের বাকি রাজ্যগুলির বিধান পরিষদের একটা বর্ণময় ইতিহাস আছে । 1956 সালে অন্ধ্রপ্রদেশ বিধানসভাতে পাশ হওয়া প্রস্তাবের ভিত্তিতে 1958 সালে তৈরি হয় বিধান পরিষদ । 1985 সালে এন টি রামা রাও এই পরিষদ বাতিল করেন । তাঁর যুক্তি ছিল, এই পরিষদ একটি অনির্বাচিত সংস্থা, যার নাক গলানোর ফলে গুরুত্বপূর্ণ এবং রাজ্যের উন্নতির স্বার্থে করা পদক্ষেপ থমকে যাচ্ছে । তিনি আইন পরিষদ নিয়ে সেদিন যা বলেছিলেন, সাড়ে তিন দশক পর প্রায় সেই একই যুক্তি দেন জগন মোহন রেড্ডি । একবার ব্যর্থ হলেও এই পরিষদ 2007 সালে ফিরিয়ে এনেছিলেন ওয়াই এস আর রেড্ডি ।

2019 সালে সালে জম্মু ও কাশ্মীরের পুনর্গঠনের পর দেশের মাত্র ছ’টি রাজ্যে আইন পরিষদ রয়েছে । সেগুলি হল অন্ধ্রপ্রদেশ, বিহার, কর্নাটক, মহারাষ্ট্র, তেলঙ্গানা এবং উত্তরপ্রদেশ । আইন পরিষদ গঠনের জন্য 1956 সালে মধ্যপ্রদেশ বিধানসভায় আইন পাশ হয় । কিন্তু সেই আইন কার্যকর করার জন্য নোটিশ আজ পর্যন্ত দেওয়া হয়নি । রাজস্থান ও অসমে আইন পরিষদ তৈরির প্রস্তাব এখনও সংসদের বিবেচনাধীন ।

প্রাথমিকভাবে চালু হলেও স্বাধীনতার পর 1970 সালে পঞ্জাব, 1986 সালে তামিলনাড়ু ও 1969 সালে পশ্চিমবঙ্গ থেকে বিধান পরিষদের বিলোপ ঘটে । 2010 সালে বিধান পরিষদের পুনর্গঠনের উদ্দেশ্যে প্রস্তাব পাশ হয় তামিলনাড়ু বিধানসভায় । এই বিষয়ে সংসদে আইন পাশ হয় । কিন্তু তা কার্যকর করার জন্য নোটিশ জারি হওয়ার আগেই রাজ্যে ক্ষমতা বদল হয় এবং নতুন সরকার বিধান পরিষদের বিলুপ্তি চেয়ে আবেদন করে । 2012 সালে এই প্রস্তাব রাজ্যসভায় পেশ হয় । সেই কারণে তামিলনাড়ুর এই মুহূর্তে কোনও আইন পরিষদ নেই ।

সাংবিধানিক বিধান

বিভিন্ন রাজ্যে বিধান পরিষদের এই ক্ষয়িষ্ণু অবস্থার অন্যতম কারণ, সংবিধানে এই প্রতিষ্ঠানের দুর্বল অবস্থান । সংসদের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভার মতো রাজ্যস্তরে বিধান পরিষদ থাকা আবশ্যক নয় । সংবিধানের 169 নম্বর ধারার প্রথম উপধারা অনুযায়ী, কেন্দ্র চাইলে কোনও রাজ্যে বিধান পরিষদের গঠন বা বিলোপ ঘটাতে পারে । তবে সেক্ষেত্রে সেই রাজ্যের বিধানসভায় বিল পাশ হতে হবে । এই বিল পাশ করাতে হবে বহুমতের ভিত্তিতে । ভোটদানের সময় বিধানসভার অন্তত দুই তৃতীয়াংশ সদস্যকে উপস্থিত থাকতেই হবে । তবে, কেন্দ্র ইচ্ছা করলে রাজ্যের প্রস্তাব মানতেও পারে, আবার না মানতেও পারে । যেহেতু 168 নম্বর ধারায় সেই সব রাজ্যের নাম নথিভুক্ত রয়েছে, যাদের বিধান পরিষদ রয়েছে, প্রতিবার কোনও রাজ্যে আইন পরিষদ তৈরি হলে বা বিলুপ্ত হলে এই ধারায় বদল আনতে হয় ।

আইন প্রণয়ন বা বিল পেশের পরিপ্রেক্ষিতে বিধান পরিষদ আর রাজ্যসভা প্রায় সমার্থক । দুই ক্ষেত্রেই একমাত্র অর্থবিল বাদে কোনও বিলের জন্যই দুই কক্ষের অনুমতির প্রয়োজন হয় না । কিন্তু আইন সংশোধন বা বাতিলের বিষয় মাথায় রাখলে বলা যায়, দুই কক্ষের ক্ষমতায় তফাৎ বিপুল । বিধানসভায় পাশ হওয়াৱ পর যদি কোনও বিল বিধান পরিষদ খারিজ করে, বা বিলে সংশোধনী খারিজ করে বা বিল পেশ হওয়ার তিন মাস পর্যন্ত কোনও পদক্ষেপ না করে, তা হলে ফের সেই বিল বিধানসভায় পাশ করিয়ে তা বিধান পরিষদে পাঠাতে পারে সরকার । যদি ফের তা পরিষদ খারিজ করে বা সংশোধনী এনে বিধানসভায় ফেরত পাঠায় বা পরবর্তী এক মাস কোনও পদক্ষেপ না করে, তা হলে দ্বিতীয় বার বিধানসভায় পাশ হওয়া বিলটি দুই কক্ষেই পাশ হওয়া বিল হিসাবে গণ্য হবে । অর্থাৎ, কোনও বিল নিয়ে আপত্তি থাকলে তা মেটাতে দুই কক্ষের মিলিত সভার কোনও বিকল্প আইনে নেই ।

সংসদ চাইলে বিধান পরিষদের ক্ষমতা বাড়াতে বা কমাতে পারে । রাজ্যসভার ক্ষেত্রে সেই বিকল্প ক্ষমতা সংবিধানেই দেওয়া আছে। রাজ্যসভার সদস্যদের মতো বিধান পরিষদের সদস্যরা রাষ্ট্রপতি বা উপ রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ভোট দিয়ে অংশ নিতে পারেন না ।

সংবিধানের এই ব্যবস্থা থেকেই স্পষ্ট যে, বিধানসভার দ্বিতীয় মত হিসেবে আইন পরিষদকে স্বীকৃতি দেওয়া নিয়ে দ্বিমত রয়েছে । বিষয়টির সমালোচনা করে বিধান পরিষদ বিলোপ করার কথা বলার সময় এনটি রামা রাও ও জগন মোহন রেড্ডিও এই একই যুক্তি দেখিয়েছিলেন । এই পরিষদ সাধারণ মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে না এবং এর ফলে কোনও বিল পাশ করতে অহেতুক দেরি হয়, এই যুক্তিতে বিধায়কদেরও একটা বড় অংশ পরিষদের বিপক্ষে ।

অন্ধ্রপ্রদেশের বর্তমান পরিস্থিতি

এই অবস্থায় অন্ধ্রপ্রদেশের পরিস্থিতিটা ঠিক কী? বিধান পরিষদ বিলোপের প্রস্তাব যেহেতু অন্ধ্রপ্রদেশ বিধানসভায় পাশ হয়ে গেছে, এই অবস্থায় কী করণীয় তা পুরোপুরি নির্ভর করছে সংসদের উপর । কিন্তু, আগেই যেমন বলা হয়েছে, সংসদ এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতেও পারে, আবার না নিতেও পারে । যদি এই বিষয়টি সংসদের আলোচনার তালিকায় থাকেও, তা হলেও তা নিয়ে আলোচনা হওয়া কঠিন । কারণ 12 ফেব্রুয়ারি থেকে 1 মার্চ পর্যন্ত সংসদে ছুটি থাকবে । তাই অগ্রাধিকারের তালিকা । না থাকলে পূর্বনির্ধারিত বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনার পর এই বিষয়ে আলোচনার সম্ভাবনা বেশ কম ।

অন্যদিকে, বিধান পরিষদ যদি নির্ধারিত তিন মাস সময়সীমার মধ্যে দু’টি বিল (APDIDAR ও APCRDA) সংশোধন-সহ ফিরিয়ে দেয়, তাহলে বিধানসভাকে এই বিল দু’টি নিয়ে ফের সিদ্ধান্ত নিতে হবে । বিধান পরিষদের প্রস্তাব না মেনে যদি বিধানসভাতে ফের বিল দু’টি পাশ হয়, তাহলে তা অন্ধ্রপ্রদেশের রাজ্যপালের টেবিলে যাবে । এই অবস্থায় প্রযোজ্য হবে 200 ও 201 নম্বর ধারা । 200 নম্বর ধারা অনুযায়ী, এই অবস্থায় রাজ্যপাল ঘোষণা করতে পারেন যে, তিনি রাষ্ট্রপতির বিবেচনার জন্য বিলগুলি সংরক্ষণ করেছেন । ছ'মাসের মধ্যে রাষ্ট্রপতি বিল নিয়ে তাঁর মত জানাতে পারেন, বা মত না জানাতে পারেন, বা পুনর্বিবেচনার জন্য বিল দু’টি বিধানসভায় ফেরত পাঠাতে পারেন । যদি বিল ফেরত পাঠানো হয়, তাহলে তা ফের দুই কক্ষে সেই বিল পাশ করিয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাতে হবে । রাষ্ট্রপতি এই বিল নিয়ে তাঁর মত জানাতে বাধ্য কি না, সে বিষয়ে সংবিধানে কিছুই বলা নেই ।

উচ্চ কক্ষের প্রয়োজনীয়তা

উচ্চ কক্ষের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে বিতর্কের বয়স এই কক্ষের বয়সের প্রায় সমান । এই বিতর্কের গোড়ায় পৌঁছাতে গেলে যেতে হবে অষ্টাদশ শতকে । তখন আমেরিকার সংবিধান রচিত হচ্ছিল । জর্জ ওয়াশিংটনকে একদিন ব্রেকফাস্টের টেবিলে টমাস জেফারসন দুই কক্ষের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন করেন । ওয়াশিংটন এর উত্তরে জেফারসনকে প্রশ্ন করেন, "আমরা ডিশে কফি ঢালি কেন?" উত্তরে জেফারসন বলেন, "ঠান্ডা করার জন্য।" তখন ওয়াশিংটন বলেন, "একইরকম ভাবে, আইনকে সেনেটের ডিশে ঢালা হয় তা ঠান্ডা করার জন্য।"

ভারতীয় সংবিধানের প্রণেতাদেরও উচ্চ কক্ষের কার্যকারিতা ও প্রয়োজনীয়তা নিয়ে বহু প্রশ্ন ছিল । কিন্তু তাঁদের বেশির ভাগের মত ছিল উচ্চ কক্ষের দিকেই যেহেতু এই কক্ষ পুরোপুরি রাজনীতিকদের দ্বারা প্রভাবিত নয় । তাঁদের ধারণা ছিল, এই কক্ষের সদস্যরা আইনকে অন্য চোখে দেখবেন । এই কক্ষের সবচেয়ে বড় সমর্থক ছিলেন এন গোপালস্বামী আয়েঙ্গার যিনি এই মর্মে প্রস্তাব দেন । তাঁর যুক্তি ছিল যে, এই কক্ষে অনেকটাই ‘মর্যাদাপূর্ণ বিতর্ক’ হবে এবং এই কক্ষ আইনের প্রয়োগকে ততটাই দীর্ঘায়িত করবে যতক্ষণ এই সংক্রান্ত আবেগ হ্রাস পাবে । তাঁর মতে, এই কক্ষ হল "দেরি করিয়ে দেওয়ার অস্ত্র" যেখানে সমাজের বিভিন্ন অংশের মর্যাদাপূর্ণ ব্যক্তিরা নিজেদের জ্ঞানের প্রকাশ করতে পারেন । লোকনাথ মিশ্রের মতে, এটি একটি নিখুঁত কক্ষ, যেখানে উচ্চ পর্যায়ে সব বিষয়ের পর্যালোচনা করা হয় । এই কক্ষে বিশেষ সমস্যা নিয়ে অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা আলোচনা করেন বলেও তিনি জানিয়েছিলেন । এম অনন্তসায়ানম আয়েঙ্গারের মত ছিল, এখানে সেই সব অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করবেন, যাঁরা ভোটে হয়তো জিততে পারবেন না ।

অন্যদিকে মহম্মদ তাহিরের বক্তব্য ছিল, এই কক্ষ গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত কক্ষের কাজকে বাধা দেওয়ার জন্য ব্রিটিশদের তৈরি সাম্রাজ্যবাদী হাতিয়ার । অধ্যাপক শিব্বন লাল সাক্সেনা বলেছিলেন, কোনও দেশ এই ধরনের উচ্চ কক্ষের ফলে উপকৃত হয়নি ।

ভবিষ্যৎ: বিধান পরিষদের পুনর্গঠন

রাজ্যের উচ্চ কক্ষ, অর্থাৎ বিধান পরিষদগুলি কাঠামো এই যুগের পরিপ্রেক্ষিতে কিছুটা সেকেলে এবং কিছুটা ভ্রান্ত । স্নাতক ও শিক্ষকদের প্রতিনিধির তেমন কোনও প্রয়োজন আজকের দিনে নেই । সংবিধানের 73 ও 74 নম্বর সংশোধনীর মাধ্যমে পঞ্চায়েত ও পৌর সংস্থাগুলি তৈরির পর সংসদের উচিত এদের সঙ্গে বিধানসভার যোগসূত্র তৈরির । বাকি প্রয়োজনীয় বিষয়গুলি রাজ্যপালের কোটায় থাকা মনোনয়নের মাধ্যমে পূর্ণ করা সম্ভব ।

এই ধরনের পুনর্গঠন বিধান পরিষদের ক্ষমতা বাড়াবে । কিন্তু এর সঠিক প্রয়োগ তখনই হবে যখন আরও একাধিক রাজ্য আইন পরিষদের প্রণয়নে এগিয়ে আসবে । এর ফলে ভবিষ্যতে লাভ হবে ভারতীয় গণতন্ত্রেরই ।

ETV Bharat Logo

Copyright © 2025 Ushodaya Enterprises Pvt. Ltd., All Rights Reserved.