কেটে গেল কুড়িটা বছর । IC 814-এর অপরহরণ এবং তার বিনিময়ে তিন কুখ্যাত জঙ্গি নেতার মুক্তি । সালটা 1999 । ছিনতাই করা হয়েছিল নেপাল থেকে ভারতে আসা এয়ার ইন্ডিয়ার বিমানটি । অপহৃত হয়েছিলেন 188 জন । তালিবানরা বিমানটিকে অপহরণ করে তাদের ঘাঁটি কান্দাহারে নিয়ে যায় ।
যে তিনজনকে সে দিন মুক্তি দেওয়া হয়েছিল তাদের মধ্যে দুই জন এখনও মুক্ত এবং পাকিস্তান থেকে তাদের কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছে । এরা হল, মুস্তাক জারগার ওরফে মুস্তাক লাতরাম, যে কাশ্মীরের জঙ্গি সংগঠন আল-উমর-মুজাহিদিনের নেতা । অপরজন মৌলানা মাসুদ আজ়হার, যে পরবর্তীতে জইশ-ই-মহম্মদের প্রতিষ্ঠা করে । তিন নম্বর জঙ্গির নাম শেখ ওমর । পরবর্তীতে পাকিস্তানে মার্কিন সাংবাদিক ড্যানিয়েল পেরলকে খুন করার দায়ে গ্রেপ্তার হয়, পাকিস্তানের আদালত তার মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিয়েছে ।
অপহরণ পরবর্তী সময় অন্যদের মতো সে'ভাবে সামনে আসতে দেখা যায়নি মুস্তাককে । অন্যদিকে, মাসুদ আজ়হার শুধু ভারতের বিরুদ্ধে অতি সক্রিয় তাই নয়, নিজেও একটি জঙ্গি সংগঠন খুলে ফেলেছে । কাশ্মীর এবং অন্যান্য জায়গায় জঙ্গি হামলা চালানোর অন্যতম মাথা এই মাসুদ । ভারতের সংসদ ভবন এবং জম্মু ও কাশ্মীরের বিধানসভা হামলার পিছনে এই মাসুদই । শ্রীনগরে প্রথম আত্মঘাতী জঙ্গি আফতাব আহমেদ শাহকে দিয়ে হামলা চালানোর পিছনে ছিল মাসুদের মাথা । শ্রীনগরে বাদামিবাগ সেনাঘাঁটিতে হামলার পিছনে এই মাসুদই, যদিও এই হামলা সফল হয়নি ।
বিমান ছিনতাইয়ের আগে জেল ভেঙে পালানোর চেষ্টা করেছিল মাসুদ । যদিও তা সফল হয়নি । আজহারের ভাই ইউসুফ জেল ভাঙা এবং বিমান ছিনতাই দু'টি ঘটনার সঙ্গেই যুক্ত । পুরো ছকটাই তৈরি করেছিল সে । প্রায় দেড় বছর ধরে বিমান ছিনতাইয়ের পরিকল্পনা করেছিল ইউসুফ । এ কাজে তাকে সাহায্য করেছিল এক ভারতীয় আবদুল লতিফ । অর্থ, পাসপোর্ট, অন্যান্য বিষয়ে ইউসুফকে সাহায্য করেছিল লতিফ । পুরো কাজটাই হয়েছিল মুম্বইয়ে বসে ।
কাঠমান্ডুতে ভারতীয় গোয়েন্দারা সঠিকভাবে কাজ করলে এই অপহরণ আটকানো যেত । প্রাথমিক সন্দেহ প্রকাশ করার পরই এই বিষয়ে পদক্ষেপ করলে ফল অন্যরকম হতে পারত । এমনকি, একজন RAW-এর কর্তা বিষয়টিকে তেমন গুরুত্ব দেননি । সেই গোয়েন্দা কর্তার স্ত্রী তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীর অফিসে এক শীর্ষকর্তাও ছিলেন ।
অপহরণকারীদের প্রথম পরিকল্পনা যেখান থেকে শুরু হয়েছিল, সেই অমৃতসর বিমানবন্দরে সেনাবাহিনী একটু সক্রিয় থাকলে পরিস্থিতি অন্যরকম হতে পারত । নেপাল থেকে ওড়ার পরে ছিনতাইকারীদের কবলে পড়ে IC-814 । কিন্তু, পরে অমৃতসরে জ্বালানি নিতে নেমেছিল বিমানটি । সেখানেই তাকে অচল করে দেওয়া যেত । পঞ্জাব পুলিশের কম্যান্ডোরা এই কাজ করতে পারতেন । কিন্তু নিজেদের সিদ্ধান্তহীনতার জন্য তাঁদের নির্দেশ দিতে পারেনি কেন্দ্রীয় ও পঞ্জাব সরকার । বিমানটি দুবাইয়ে নামার পর সেখানেও ভারত কম্যান্ডো অভিযান চালানোর কথা ভেবেছিল । ফের সিদ্ধান্তহীনতার জন্য পরিকল্পনা পিছিয়ে যায় ।
IC-814 ছিনতাইয়ের পর বেশ কয়েকটি তথ্য সামনে আসে । প্রথমত, পুরো কাজটার পিছনে আফগান তালিবান এবং ISI-র সমর্থন ছিল । কাশ্মীরে সক্রিয় তালিবানদের একটি শাখারও সমর্থন করে গেছে । দ্বিতীয়ত, আজ়হার মাসুদের প্রধান কাজ কাশ্মীরসহ বিশ্বের অন্যান্য জায়গায় জঙ্গি কার্যকলাপকে সক্রিয় করা । মাসুদের সঙ্গে যোগ রয়েছে বিশ্বের বেশ কিছু জঙ্গি সংগঠনের । ভারতে জঙ্গি কার্যকলাপকে আরও সক্রিয় করে তোলার জন্য 1999 সালে তৈরি হয় জইশ-ই-মহম্মদ ।
উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত এলাকা এবং বালাকোট হামলা চালানোর জন্য বেছে নেয় মাসুদ । কারণ পাকিস্তানের অধিকৃত এই সব জায়গায় ভারতীয় গোয়েন্দারা তেমন সুবিধা করতে পারবেন না, এটা বুঝেই এই সব জায়গাকে আসল ঘাঁটি বানিয়ে রেখেছে আজ়হার ।
হিজবুল মুজাহিদিন, আল উমর, জামাত-উল-মুজাহিদিনের মতো মাসুদ আজহারের জঙ্গি সংগঠনটিরও একটি নিজস্ব চিন্তাভাবনা-মতাদর্শ আছে । ভারতের বিরুদ্ধে যারা চরমপন্থী মতাদর্শ নিতে পারে, সেই সব মানুষজন অত্যন্ত গ্রহণীয় মাসুদের কাছে । যার প্রধান কাজই হল, ভারতের বিরুদ্ধে হামলার পরিকল্পনা করা । ওয়াহাবি স্কুল থেকেই প্রধানত মাসুদ তার লোকজন সংগ্রহ করে । মাসুদের দলবল নিজস্ব ইসলামিক চিন্তাধারায় বিশ্বাসী এবং মানুষজনকে ক্ষমা করা তাদের চিন্তাভাবনার বাইরে ।
আজ়হার এবং দলবল নিজস্ব ক্যাম্পে জইশ-ই-মহম্মদের ক্যাডারদের প্রশিক্ষণ দেয় । বিশেষ বিশেষ কর্মশালার মধ্যে দিয়ে তুলে আনা হয় সেরা ক্যাডারদের । যারা যে কোনওরকম ভয়ঙ্কর হামলা চালাতে সক্ষম । জিহাদের পরিকল্পনা করা এবং জঙ্গি হামলা সংগঠিত করার জন্যই বিশেষ দক্ষতা সম্পন্ন বাহিনীও তৈরি করা আছে ।
যাঁরা 24 ডিসেম্বর 1999 সালের ঘটনার সাক্ষী থেকেছেন, তাঁরা জানেন সেই অপহরণের ফলাফল কতটা সুদুরপ্রসারি । আজ়হারের শাস্তির ব্যবস্থা করা এখনও ভারতের কাছে অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ এবং ওই সাতদিন এখনও অত্যন্ত বড় ক্ষত হয়ে রয়েছে । মাসুদের চরম শাস্তিই একমাত্র মানসিক শান্তি হতে পারে । ভারতীয় গোয়েন্দারা মাসুদের খোঁজ চালিয়ে যাচ্ছেন এবং মাসুদকে খতম করার জন্য বেশ কয়েকবার অভিযান চালালেও সফল হতে পারেনি । 2018 সালে বালাকোট হামলার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল মাসুদকে খতম করা এবং তার ঘাঁটিগুলো ধ্বংস করা । জঙ্গিদের মদত দেওয়ার বিষয়ে পাকিস্তানের ভূমিকা নিয়ে বিশ্বের একাধিক দেশ সরব হলেও নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য চিন পাকিস্তানকে ভারতের স্বার্থের বিরুদ্ধে গিয়ে সাহায্য করে চলেছে । মাসুদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ করার জন্য একাধিক প্রচেষ্টা চলছে ।
জাতীয় নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে কোনও কিছুর সঙ্গেই আপস করা সম্ভব নয় এবং নিরাপত্তা ক্ষেত্রে আঘাত আসতে পারে এমন সম্ভাবনা তৈরি হলে বা এই সংক্রান্ত কোনও রিপোর্ট গোয়েন্দারা দিলে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে । কান্দাহার বিমান ছিনতাইয়ের ঘটনার পর বেশ কিছু দিকে নজর ঘুরে যায় । উঠে আসে একাধিক প্রশ্নও । যদি গোয়েন্দা রিপোর্টকে প্রথম থেকেই গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা হত, তাহলে পরিস্থিতি অন্যরকম হতে পারত । ভারতের সংসদ ভবনে হামলা বা বালকোটে হামলার প্রত্যুত্তর- এ সবের ফলই সম্ভাবত রাষ্ট্রসংঘ কর্তৃক আজ়হার মাসুদকে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ হিসেবে ঘোষণা করা । 1999 সালের 24 ডিসেম্বর বিমান ছিনতাই এবং মাসুদ আজ়হারের মুক্তির পর এতটাই এগনো সম্ভব হয়েছে । সামান্যতম গাফিলতি, তাৎক্ষণিক বুদ্ধিমত্তার অভাবে যাতে আর কোনওদিন কোনও আজ়হার তৈরি না হয়, সে দিকটায় নজর দিতে হবে ।
বিলাল ভাট