আলিপুরদুয়ার, 29 জুলাই: পিছিয়ে পড়া গ্রাম আলিপুরদুয়ারের পানিঝোড়া ৷ বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্পের অধীনে এই গ্রামই এখন শিক্ষার আলোর অপেক্ষায় ৷ দিনকয়েকের মধ্যে এর নাম হবে বইগ্রাম ৷ যে গ্রামে ঢুকলেই বাড়ি বাড়ি পেয়ে যাবেন গ্রন্থাগার । রাজ্যে এমন উদ্যোগ সম্ভবত প্রথম ৷ ফলে আদিবাসী অধ্যুষিত পিছিয়ে পড়া এই গ্রাম আগামী দিনে ডুয়ার্সে বেড়াতে যাওয়া পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠতে চলেছে ৷
পানিঝোড়ায় তৈরি হচ্ছে বইগ্রাম (ইটিভি ভারত) আলিপুরদুয়ার শহর থেকে রাজাভাতখাওয়া যেতে 12 কিলোমিটার দূরে রয়েছে পানিঝোড়া গ্রামটি । আপনকথা নামে একটি সংগঠন এবং আলিপুরদুয়ার জেলা প্রশাসন এই গ্রামটিকেই বেছে নিয়েছে বইগ্রাম হিসেবে গড়ে তোলার জন্য । এর আগে মহারাষ্ট্রের ভিলার ও কেরলের পেরুকালেম ছাড়া এমন উদ্যোগ বিশেষ দেখা যায়নি ৷ কেমন হবে এই বই গ্রাম ? কী কী থাকবে এই বই গ্রামে ? স্বাভাবিক ভাবে এই প্রশ্নটা ঘুরপাক খাচ্ছে ।
গ্রামে ঢোকার মুখেই চোখে পড়বে একটি তোরণ । বইকে থিম হিসেবে কাঠের তৈরি গাছের আদলে হবে সেই তোরণ । সেখানে থাকবে বইয়ের রেপ্লিকা ও ছোট লাইব্রেরির রেপ্লিকা । কাঠের তৈরি তোরণ পেরিয়ে গ্রামে প্রবেশ করেই চোখে পড়বে বইগ্রামের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে বানানো একটা ফলক । ইতিমধ্যে কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে ।
গ্রামের ভেতরে 10টি বাড়ির সামনে বানানো হবে ‘আলোকবর্তিকা’। এটি হল কাঠের তৈরি ছোট গ্রন্থাগার । সেগুলির প্রত্যেকটিতে গল্পের বই, বিজ্ঞানের বই, সামাজিক সচেতনতামূলক বই-সহ নানা স্বাদের বই থাকবে । ওই গ্রামের 10 জন স্বেচ্ছাসেবক ছোট লাইব্রেরিগুলির দেখভাল করবেন । আগ্রহী পাঠকরা বই নিয়ে, পড়ে আবার ফেরত দিয়ে যাবেন ।
এছাড়া গ্রামে থাকবে একটি বড় আকারের গ্রন্থাগার । আপাতত তা বানানো হবে ওই গ্রামেরই প্রাথমিক স্কুলের একটি ঘরে । যেখানে দুটি আলমারিতে 500-রও বেশি বই থাকবে । পাঠ্যবইয়ের সঙ্গে থাকবে চাকরিপ্রার্থীদের জন্য প্রয়োজনীয় বইও । যার দেখভাল করবেন ওই গ্রামের 2 জন স্বেচ্ছাসেবক । পরবর্তীতে জমি পেলে ওই গ্রামেই পাকাপাকিভাবে বড় গ্রন্থাগার তৈরি হবে । সেখানে মাসে একদিন কম্পিউটার শেখানোর সঙ্গে সঙ্গে সংস্কৃতিচর্চাও করানো হবে । পাশাপাশি গ্রামের 50টি বাড়ির দেওয়াল শিক্ষামূলক বার্তা, মনীষীদের বাণী দিয়ে সাজানোর চিন্তাভাবনা রয়েছে । বক্সা ব্যাঘ্র-প্রকল্পের অধীন এই গ্রামে সাতটি আদিবাসী জনগোষ্ঠী-সহ তপশিলি-অনগ্রসর শ্রেণির বাসিন্দাদের বসতি ।
উদ্যোক্তা আপনকথা সংস্থার সম্পাদক পার্থ সাহা বলেন, "পিছিয়ে পড়া এলাকায় বই নিয়ে আমরা কাজ করি । শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়াই আমাদের মূল লক্ষ্য । সামাজিক বঞ্চনা থেকে উত্তরণের অস্ত্র হতে পারে বই । কীভাবে এটা করা সম্ভব তা নিয়ে আমরা পড়াশোনা শুরু করার পর দেখলাম, দেশে দুটো রাজ্যের রাজ্য সরকার বইগ্রামকে স্বীকৃতি দিয়েছে । এরপর আমরা আলিপুরদুয়ারের জেলাপ্রশাসনকে বিষয়টি জানাই । তারাও আমাদের স্বীকৃতি দেয় । যৌথভাবেই আমরা কাজ করছি । আদিবাসী অধ্যুষিত গ্রামকে বেছে নিয়েছি । গ্রামে ঢোকার মুখে গাছের আদলে তোরণ হবে । বই গাছ । একডালে বইয়ের রেপ্লিকা থাকবে । লাইব্রেরির রেপ্লিকা থাকবে । বই যে ফল দিচ্ছে, সেটাই সমাজের কাছে বার্তা থাকবে । এই প্রকল্পটি নাম দেওয়া হয়েছে আলোকবর্তিকা । বই আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে ।"
তিনি বলেন, এই গ্রামের জনসংখ্যা 320 জন ৷ 73টি বাড়ি রয়েছে ৷ ছাত্রছাত্রী রয়েছে 70-80 জন । এই এলাকার ছাত্রছাত্রীরা বই কিনতে পারে না । বইগ্রাম হয়ে গেলে সেন্ট্রাল লাইব্রেরিতে চাকরিপ্রার্থীদের বইও থাকবে ৷ গ্রামের 10 থেকে 12 জন স্বেচ্ছাসেবক গ্রন্থাগার পরিচালনা করবেন । 100টি উত্তরবঙ্গ কেন্দ্রীক বই থাকবে, যা থেকে তারা বক্সা, জয়ন্তী, আলিপুরদুয়ারের ইতিহাস জানতে পারবে । গ্রামের মানুষই শুধু নয়, পর্যটকরাও ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারবেন । ডুয়ার্সে ঘুরতে আসা পর্যটকদের কাছেও বিশেষ আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হবে এই গ্রাম ।
পানিঝোড়া গ্রামের বাসিন্দা পারুল মীঞ্জ বলেন, "আমাদের গ্রামে বইগ্রাম হবে শুনে খুব ভালো লাগছে । এতে গ্রামের উন্নতি হবে । খুবই আনন্দ লাগছে । দেশ-বিদেশের মানুষ আসবে । বাইরে থেকে আসা পর্যটকরা এখানে এলে পেয়ে যাবেন উত্তরবঙ্গ, ডুয়ার্স, আদিবাসী, বক্সা বিষয়ক বই । দশটি লাইব্রেরি হবে এখানে।"
পানিঝোড়া প্রাথমিক স্কুলের ভারপ্রাপ্ত শিক্ষক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং রণজিৎ বর্মন বলেন, এই গ্রাম এমন ভাবে সেজে উঠবে যে, রাজাভাতখাওয়া, জয়ন্তীতে আসা পর্যটকরাও এই গ্রামে আসবেন । এভাবে গ্রামেরও পর্যটন বিকাশ ঘটবে । এই বইগ্রামের ফলে পিছিয়ে পড়া গ্রামটি শিক্ষিত হবে । যাঁরা নিরক্ষর আছেন তাঁরা সাক্ষর হবেন । এখানকার ছেলেমেয়েরাই সেই উদ্যোগ নেবেন । এতে গ্রামের পড়াশোনার পরিবেশ যেমন আরও প্রসারিত হবে, আর্থসামাজিক ব্যবস্থারও উন্নতি হবে ।