একনজরে জগন্নাথ সরকারের রিপোর্ট কার্ড রানাঘাট, 31 মার্চ: জগন্নাথ সরকার, গত পাঁচ বছরে রানাঘাট লোকসভা কেন্দ্রের সাংসদ । এ বারও দল তাঁকেই প্রার্থী করেছে । গত পাঁচ বছর সাধারণ মানুষের জন্য কতটা কাজ করতে পেরেছেন তিনি ? মানুষ কি তাঁর কাছ থেকে কোনও উন্নয়ন পেয়েছে ? নাকি শুধুমাত্র সাংগঠনিক কাজেই ব্যস্ত ছিলেন জগন্নাথ সরকার ? কী বলছেন সাধারণ মানুষ । খোঁজ নিল ইটিভি ভারত ।
রানাঘাট লোকসভা একদা লালদুর্গ হিসেবে পরিচিত ছিল । 2009 সালে রানাঘাট কেন্দ্র হাতছাড়া হয় বামেদের । তৃণমূলের তরফে প্রথম রানাঘাট কেন্দ্রের সাংসদ হয়েছিলেন আনন্দভবন বিশ্বাস । 2014 সালের নির্বাচনে সাংসদ হন তৃণমূলের তাপস মণ্ডল । এরপর 2019 সালের লোকসভা নির্বাচনের কিছুদিন আগে কৃষ্ণগঞ্জের তৃণমূল বিধায়ক সত্যজিৎ বিশ্বাসকে গুলি করে খুন করে দুষ্কৃতীরা । তার কিছুদিন পর লোকসভা নির্বাচন ঘোষণা হওয়ায় তৃণমূল তাপস মণ্ডলকে পুনরায় আর প্রার্থী করেনি । তাঁর পরিবর্তে প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করা হয় নিহত তৃণমূল বিধায়ক সত্যজিৎ বিশ্বাসের স্ত্রী রূপালি বিশ্বাসের নাম । তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বিজেপি সেই লোকসভা নির্বাচনে প্রথমে ড. মুকুটমণি অধিকারীর নাম ঘোষণা করলেও তা আইনি জটিলতায় বাতিল হয়ে যায় । পরবর্তীকালে বিজেপি জগন্নাথ সরকারকে 2019 সালে লোকসভা নির্বাচনের প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করে ।
জগন্নাথ সরকার দীর্ঘদিন ধরেই শিক্ষকতার পাশাপাশি আরএসএস-এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন । পাশাপাশি তিনি বিজেপিও করতেন । সেই লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলে দেখা যায় তৃণমূল প্রার্থী রূপালি বিশ্বাসের থেকে প্রায় 2 লক্ষ 33 হাজার ভোটেরও বেশি ব্যবধানে জয়লাভ করেন বিজেপির জগন্নাথ সরকার । 2019 সালের নির্বাচনে সমতলে সবথেকে এই কেন্দ্রটির ব্যবধান বেশি ছিল ।
ইতিমধ্যেই 2024 সালের লোকসভা নির্বাচনের দিন ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন । রানাঘাট কেন্দ্রে পুনরায় বিজেপি প্রার্থী করেছে জগন্নাথ সরকারকে ৷ অন্যদিকে, সদ্য বিজেপি থেকে জোড়াফুলে যোগ দেওয়া মুকুটমণি অধিকারীকে ওই কেন্দ্রেই তৃণমূল প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে । তৃণমূল মুকুটমণি অধিকারীকে প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করার পর, এই কেন্দ্রের লড়াই আরও কঠিন হল বলেই মত রাজনৈতিক মহলে । গত পাঁচ বছর সাংসদ হিসেবে কতটা কাজ করতে পেরেছেন জগন্নাথ সরকার, তারই সুলুকসন্ধান করেছে ইটিভি ভারত ।
উন্নয়নের বিষয়ে সাংসদ জগন্নাথ সরকার বলেন, নিয়ম অনুযায়ী সাংসদ তহবিলের যে 17 কোটি টাকা পাওয়ার কথা, তা সম্পূর্ণই তিনি বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে খরচ করেছেন । তাঁর কথায়, "প্রথমদিকে আমার কাজ করতে একটু অসুবিধা হচ্ছিল । তার কারণ আমার সংসদ এলাকার একাধিক পঞ্চায়েত সমিতি এবং গ্রাম পঞ্চায়েতগুলি তৃণমূলের দখলে । পাশাপাশি এখানকার জেলা পরিষদও তৃণমূলের দখলে । সেই কারণে সঠিকভাবে আমি কাজ করতে পারিনি । তা সত্ত্বেও বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে উন্নয়ন করেছি । বিশেষ করে রেল প্রকল্পে আমার অবদান এই পাঁচ বছরে অনেকটাই ছিল ।"
এক নজরে দেখে নেওয়া যাক সাংসদ জগন্নাথ সরকার এলাকায় কী কী উন্নয়ন করেছেন ?
* প্রতিবন্ধীদের হুইল চেয়ার দিয়েছেন
* ছোট-বড় পিচের রাস্তা তৈরি করেছেন
* একাধিক ঢালাই রাস্তা করেছেন
* প্রতিবন্ধীদের অত্যাধুনিক গাড়ির ব্যবস্থা করেছেন
* বিভিন্ন রাস্তায় লাইটের ব্যবস্থা করেছেন
* রাস্তার মোড়ে মোড়ে অত্যাধুনিক ইলেকট্রিক হাইমাস লাইট দিয়েছেন
*পানীয় জল প্রকল্পে টাকা বরাদ্দ করেছেন
*একাধিক রেল স্টেশনে পানীয় জল এবং বিশ্রামাগারের উদ্বোধন করেছেন
*কৃষ্ণনগর থেকে নবদ্বীপ ধাম ট্রেন চলাচলের ব্যবস্থা করেছেন, তার কাজ ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে
এর পাশাপাশি সাংসদ জগন্নাথ সরকার বলেন, "আমি দীর্ঘদিন ধরেই লোকসভা এবং রেল দফতরের আধিকারিকদের কাছে কৃষ্ণনগর থেকে করিমপুর নতুন রেললাইন তৈরির প্রস্তাব দিয়েছি । ইতিমধ্যেই তা গ্রহণ করা হয়েছে ।" জমির সমস্যা মিটে গেলেই দ্রুত কাজ শুরু হবে বলে আশাবাদী তিনি ।
তবে অন্যদিকে, সাংসদের উন্নয়ন এবং উন্নয়নের কাজে বাধার দাবি মানতে নারাজ তাঁর কেন্দ্রেরই তৃণমূল বিধায়ক ব্রজকিশোর গোস্বামী । শান্তিপুর বিধানসভার বিধায়ক বলেন, "সাংসদ কী উন্নয়ন করেছেন সাধারণ মানুষ সেটা জানে । তিনি বলছেন, পঞ্চায়েত সমিতি এবং জেলা পরিষদ তৃণমূল হওয়ার কারণে তিনি কাজ করতে পারেননি ? এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা । তিনি যদি কাজ না করতে পারতেন তাহলে ছোটখাটো পিচের রাস্তা বা হাইবাস লাইট বসানোর কাজ কীভাবে করলেন ? আসলে তিনি সাধারণ মানুষের জন্য কোনও উন্নয়ন করেননি । গত পাঁচ বছরে যে উন্নয়ন করার কথা, সেই উন্নয়ন সাধারণ মানুষ পায়নি ।"
তবে তাঁর গত পাঁচ বছরের কাজ এবং উন্নয়ন নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া পাওয়া গিয়েছে সাধারণ মানুষের কাছে । এ বিষয়ে রানাঘাট লোকসভার স্থানীয় বাসিন্দা রুপম পাল বলেন, গত পাঁচ বছরে আমরা কোনও উন্নয়ন সাংসদ জগন্নাথ সরকারের কাছ থেকে পাইনি । তিনি ভোটে লড়াই করার আগে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তা সম্পূর্ণ মিথ্যা ছিল । তিনি মানুষকে বোকা বানিয়েছেন এবং উন্নয়নের কথা বলে ভোট নিয়েছেন । কিন্তু বাস্তবিক কোনও উন্নয়ন হয়নি ।
রানাঘাট লোকসভা কেন্দ্রের আরেক বাসিন্দা সমীরণ সাহা বলেন, গত পাঁচ বছরে সাংগঠনিক কাজ ছাড়া সাংসদ জগন্নাথ সরকারকে সেভাবে দেখা যায়নি । তিনি গত পাঁচ বছরে ছোটখাটো কাজ করেছেন বটে, কিন্তু একজন সাংসদ হিসেবে যেভাবে উন্নয়ন করার কথা তা তিনি করেননি । কিছু কিছু রাস্তায় সোলার লাইট লাগিয়েছেন, কিন্তু তাও খুব নিম্নমানের । অন্যদিকে তিনি শান্তিপুর স্টেশনকে ধাম হিসেবে ঘোষণা করার উদ্যোগ নিতে পারতেন। পাশাপাশি গঙ্গার ভাঙনের যে সমস্যা তা পাকাপোক্তভাবে মেটাতে পারতেন । তাও তিনি করেননি ।
তবে উন্নয়নের বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করেছেন রানাঘাট কেন্দ্রের আরেক স্থানীয় বাসিন্দা সঞ্জিত মাহাত । তিনি বলেন, একজন সাংসদ হিসেবে যেটুকু উন্নয়ন করার প্রয়োজন, তিনি সেটা করেছেন । বিভিন্ন জায়গায় বড় বড় কাজ করেছেন বলেই দাবি করেন তিনি । জয়ের ব্যবধান কমলেও উন্নয়নের নিরিখে বিজেপির জগন্নাথ সরকার আবার জিতবেন বলে আশাবাদী তিনি ।
সাধারণ মানুষের কী কী প্রত্যাশা ছিল, যে কাজ করতে পারেননি জগন্নাথ সরকার, এক নজরে তা দেখে নেব,
* শান্তিপুর স্টেশনকে শান্তিপুর ধাম হিসেবে রূপান্তরিত করা
* দীর্ঘদিনের সমস্যা নদী ভাঙন, স্থায়ীভাবে সেই কাজ করা
* তাঁর দত্তক নেওয়া গ্রামের সঠিক উন্নয়ন না হওয়া
* কেন্দ্রীয় প্রকল্পের মাধ্যমে শান্তিপুরের তাঁত শিল্পের উন্নয়ন করতে না পারা
* ছোটখাটো পানীয় জল প্রকল্পে টাকা বরাদ্দ করলেও বড় বড় পানীয় জল প্রকল্প তৈরি না-করা
* করোনা চলাকালীন সাধারণ মানুষের পাশে না-থাকার অভিযোগ রয়েছে
তবে প্রধান দুই প্রতিপক্ষ ইতিমধ্যেই প্রচার কর্মসূচিতে নেমে পড়েছে রানাঘাট লোকসভা কেন্দ্রে । এই কেন্দ্রে মতুয়া ভোট বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ । একদিকে সাংসদ জগন্নাথ সরকার নিজেই যেমন মতুয়া সম্প্রদায়ভুক্ত, অন্যদিকে তৃণমূল প্রার্থী মুকুটমণি অধিকারী বিজেপিতে থাকাকালীন মতুয়া সংগঠনের নেতা ছিলেন । সেই কারণে মুকুটমণি অধিকারী তৃণমূলের প্রার্থী হওয়ার কারণে লড়াই আরও কঠিন হল বলেই মত রাজনৈতিক মহলে । রাজনৈতিক তরজা, উন্নয়নের চর্চা সবকিছু পেরিয়ে এ বারের লোকসভা নির্বাচনে মুখে কার হাসি ফোটে, নীল সাদা নাকি গেরুয়া ? তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে ভোট গণনার দিন পর্যন্ত ।
আরও পড়ুন:
- অনুব্রতহীন বীরভূমে ভোটে জিততে রিপোর্ট কার্ডই ভরসা শতাব্দীর
- ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান থেকে উন্নয়ন, আসতকাচের তলায় সাংসদ দেব
- রাস্তা-জল-আলো সবই আছে বারাসতে! কী বলছে কাকলি ঘোষ দস্তিদারের রিপোর্ট ?