মালদা, 21 ডিসেম্বর: ঠিক যেন এক ক্রাইম থ্রিলার ৷ সকালে সবার চোখের সামনে থেকে সাত বছরের শিশুকন্যাকে বাইকে চাপিয়ে পালিয়েছিল দুই দুষ্কৃতী ৷ এনিয়ে সারাদিন সাসপেন্সে সময় কাটিয়েছেন গ্রামের সবাই ৷ নিজেদের কাজ চালিয়ে গিয়েছে পুলিশ ৷ অবশেষে বিকেলে মিলেছে সাফল্য ৷
উত্তর দিনাজপুরের টুঙ্গিদিঘি থেকে অপহৃতা নাবালিকাকে উদ্ধার করা গিয়েছে ৷ পুলিশের জালে ধরা পড়েছে দুই দুষ্কৃতীও ৷ সন্ধে নাগাদ নাবালিকাকে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছে পুলিশ ৷ মালদার পুলিশ সুপার প্রদীপকুমার যাদব জানিয়েছেন, পুলিশের সর্বস্তরের কর্মীদের পরিশ্রম, সহযোগিতায় দ্রুত ওই নাবালিকাকে উদ্ধার করা গিয়েছে ৷
কাকে অপহরণ করা হয় ?
ওই বালিকা মালদার হরিশ্চন্দ্রপুরের সালালপুর এলাকারই একটি বেসরকারি স্কুলে আপার কেজির ছাত্রী ৷ বাবা বড় ব্যবসায়ী ৷ মূলত চুলের ব্যবসা করেন তিনি ৷ তবে অন্যান্য সামগ্রীরও ব্যবসা রয়েছে তাঁর ৷ রাজস্থানের জয়পুরে তাঁর ব্যবসা চলে ৷ বছরের কয়েক মাস সেখানেই থাকেন ৷ কিছুদিন আগে বাড়ি ফিরে এসেছেন ৷ তাঁর স্ত্রী ঘরের কাজ সামলান ৷ তাঁদের দুই মেয়ে ৷ ওই নাবালিকা বড় মেয়ে ৷
কীভাবে অপহরণ ?
শনিবার সকালে দাদুকে নিয়ে চিকিৎসকের কাছে গিয়েছিলেন 7 বছরের শিশুর বাবা ৷ বাড়ির বাইরে পুকুরপাড়ে খেলছিল বালিকা ৷ অভিযোগ, সেই সময় দুই দুষ্কৃতী গায়ে চাদর ঢেকে, মাথায় হেলমেট পরে সেখান থেকেই শিশুটিকে নম্বর প্লেটহীন বাইকে তুলে নিয়ে চম্পট দেয় ৷ গ্রামবাসীরা কেউ প্রথমে বিষয়টি বুঝতে পারেননি ৷ সম্বিৎ ফিরতেই সবাই চিৎকার শুরু করেন ৷ অবশ্য ততক্ষণে চোখের আড়ালে চলে যায় দুষ্কৃতীরা ৷ গোটা ঘটনাটি ধরা পড়ে সিসি ক্যামেরায় ৷ সিসিটিভির সেই ফুটেজ খতিয়ে দেখছে পুলিশ ৷
শিশুর মায়ের কী বক্তব্য?
শিশুটির মা বলেন, "মেয়ে বাড়ির বাইরেই পুকুরপাড়ে খেলছিল ৷ দুষ্কৃতীরা সেখান থেকেই ওকে তুলে নিয়ে গিয়েছে ওরা দু'জন ছিল ৷ মোটর বাইক নিয়ে এসেছিল ৷ চাদর আর হেলমেট পরে ছিল ৷ লম্বা আর মোটা একজন মেয়েকে বাইকে তুলেছে ৷ ওরা আগে থেকেই এখানে ঘোরাফেরা করছিল ৷ এর আগে আমাদের কাছে কেউ কোনও টাকা দাবি করেনি বা হুমকি দেয়নি ৷ হঠাৎ করে কেন আমার মেয়েকে অপহরণ করা হল, বুঝতেই পারছি না ৷"
প্রত্যক্ষদর্শী কী বলছিলেন?
ঘটনার এক প্রত্যক্ষদর্শীর কথায়, "তখন আমি পুকুরে কাপড় কাচছিলাম ৷ মেয়েটা পাড়ে খেলছিল ৷ তখনই বাইকে চেপে আসা দু'জন ওকে নিয়ে পালায় ৷ ওই দু'জন মাসখানেক ধরে বাইক নিয়ে গ্রামে ঘোরাঘুরি করছে ৷ যখনই ওরা গ্রামে আসত, গায়ে চাদর আর মাথায় হেলমেট থাকত ৷ যে বাইক চালাত, সে একটু মোটা ৷ গালে দাড়ি আছে ৷ আজও ওরা বাইক নিয়ে দু'বার ঘুরেছে ৷ শেষবার ওরা একটা মাদ্রাসার কাছে বাইক দাঁড় করায় ৷ একটা লোকের ফোন এসেছিল ৷ ওই ফোনের পরই ওরা মেয়েটাকে তুলে নিয়ে পালায় ৷ মেয়েটা আমার স্কুলেই পড়ত ৷ আমি ওই স্কুলের মাসি ৷ মেয়েটা পড়াশোনায় ভালো ৷ ওর সঙ্গে আমার হৃদ্যতাও ছিল ৷"
কীভাবে উদ্ধার?
পুলিশ জানিয়েছে, সিসিটিভির ফুটেজে ভর করে ঘটনার তদন্তে শুরু হয় ৷ হাই অ্যালার্ট জারি করা হয় জেলার প্রতিটি থানায়৷ সিল করে দেওয়া হয় বাংলা-বিহার সীমানা ৷ নিজেদের ‘খবরিদের’ সতর্ক করেন পুলিশ অফিসাররা ৷ গোটা ঘটনা জানানো হয় বিহার ও উত্তর দিনাজপুর জেলা পুলিশকেও ৷
শেষ পর্যন্ত সেই খবরিদের মাধ্যমেই এক পুলিশ অফিসার জানতে পারেন, বিহার নয়, ওই নাবালিকাকে নিয়ে দুষ্কৃতীরা রায়গঞ্জের দিকে যাচ্ছে ৷ সেই খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রায়গঞ্জ থানাকে সতর্ক করা হয় ৷ রায়গঞ্জ পুলিশ জেলার সুপার মহম্মদ সানা আখতারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন মালদা জেলার পুলিশ সুপার প্রদীপকুমার যাদবও ৷ কিছুক্ষণের মধ্যে ইটাহার, রায়গঞ্জ, করণদিঘি, এমনকি ইসলামপুর পুলিশ জেলাও সতর্ক হয়ে যায় ৷
জাতীয় সড়কে নাবালিকাকে নিয়ে পালাচ্ছে দুই অপহরণকারী৷ (নিজস্ব চিত্র) কিন্তু সময় গড়িয়ে চললেও দুষ্কৃতীদের বাইকের দেখা নেই ৷ অবশেষে বিকেল নাগাদ জানা যায়, পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে তারা রায়গঞ্জ থানা এলাকা পেরিয়ে গিয়েছে ৷ যাচ্ছে ইসলামপুরের দিকে৷ ততক্ষণে প্রতিটি থানা এলাকায় 12 নম্বর জাতীয় সড়কের উপর নাকা করে ফেলেছে উত্তর দিনাজপুর জেলা পুলিশ ৷ করণদিঘি থানার পাণ্ডেপুর এলাকাতেও নাকা করা হয়েছিল ৷
দূর থেকে তা দেখেই দুষ্কৃতীরা বুঝে যায়, পরিস্থিতি বেগতিক ৷ তারা জাতীয় সড়কের উপর ওই শিশুকন্যাকে নামিয়ে বাইক ঘুরিয়ে উলটোদিকে পালাতে থাকে ৷ ওই বালিকাকে দ্রুত উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যান করণদিঘি থানার পুলিশকর্মীরা ৷ ওদিকে কয়েকজন সহকর্মী নিয়ে দুষ্কৃতীদের তাড়া করেন করণদিঘি থানার ট্রাফিক ওসি শামিম ইকবাল আনসারি ৷ খবর পেয়ে ততক্ষণে জাতীয় সড়কে নাকা করা হয় টুঙ্গিদিঘিতেও ৷ সেখানেই পুলিশের হাতে ধরা পড়ে যায় দুই দুষ্কৃতী ৷ অপহরণের ছ’ঘণ্টা পর ৷ বাজেয়াপ্ত করা হয় মোটর বাইকটিও ৷
করণদিঘি থানার এক অফিসার বলেন, “ওই দুষ্কৃতীদের নাম মনসুর আলম ও এজাদ আহমেদ ৷ তারা হরিশ্চন্দ্রপুর থানা এলাকারই বাসিন্দা ৷ সন্ধের মুখে উদ্ধার হওয়া নাবালিকা-সহ দুই অপহরণকারীকে টুঙ্গিদিঘি ট্রাফিক আউটপোস্ট থেকে হরিশ্চন্দ্রপুর থানার পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে ৷” চাঁচল মহকুমা পুলিশ আধিকারিক সোমনাথ সাহা বলেন, “অপহৃত নাবালিকাকে উদ্ধার করা হয়েছে ৷ দুই অপহরণকারীও ধরা পড়েছে ৷”