জয়নগর, 5 অক্টোবর: এক নাবালিকাকে ধর্ষণ ও খুনের অভিযোগে রণক্ষেত্রের চেহারা নিল দক্ষিণ 24 পরগনার জয়নগর ৷ নাবালিকার পরিবার ও স্থানীয়রা পুলিশের বিরুদ্ধে চরম উদাসীনতার অভিযোগ তুলে ক্ষোভে ফেটে পড়েন। উত্তেজিত জনতা স্থানীয় মহিষমারি ফাঁড়িতে ভাঙচুর চালিয়ে আগুন ধরিয়ে দেন। পুলিশের দু'টি বাইকও ভেঙে দেওয়া হয় ৷
প্রাথমিক ভাবে পুলিশ পিছু হটলেও, পরে বিশাল বাহিনী মোতায়েন করা হয় এলাকাতে ৷ নামানো হয়েছে ব়্যাফ ৷ পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটবৃষ্টি শুরু হলে, জনতাকে সামাল দিতে কাঁদানে গ্যাসও ছোড়া হয় ৷ ঘটনায় মূল অভিযুক্ত গ্রেফতার হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ ।
চতুর্থ শ্রেণির পড়ুয়াকে ধর্ষণ ও খুনের অভিযোগে উত্তপ্ত জয়নগর (ইটিভি ভারত) স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, নিহত নাবালিকা কুলতলি থানার কৃপাখালি এলাকার বাসিন্দা এবং চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী ৷ শুক্রবার দুপুর আড়াইটে নাগাদ কাছের মহিষমারিতে টিউশন পড়তে যায় সে ৷ কাছেই বাজারে তার বাবার দোকান ৷ টিউশন শেষে বাড়ি ফেরার পথে দোকানে গিয়ে বাবার সঙ্গে দেখাও করেছিল নাবালিকা ৷ এরপর একা বাড়ি ফেরার পথে তাকে অপহরণ করা হয় বলে অভিযোগ ৷
শুক্রবার কী ঘটেছিল ?
নাবালিকার পরিবার জানিয়েছে, সন্ধ্যা পেরিয়ে গেলেও সে বাড়ি না-ফেরায় চিন্তায় পড়েন তাঁরা এবং প্রাথমিক খোঁজখবরের পর তাঁরা জয়নগর থানায় নিখোঁজের সম্পর্কে জানাতে গেলে, তাঁদের পুলিশ কুলতলি থানায় পাঠিয়ে দেয়। পুলিশ বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়নি ৷ অভিযোগ জানাতে গেলেও পুলিশ তা শুনতে চায়নি ৷ এফআইআর করতে চাইলেও পুলিশ নিতে চায়নি। নিখোঁজ নাবালিকাকে তন্নতন্ন করে খোঁজা শুরু হয় ৷ শেষে ভোররাতে নাবালিকার বাড়ির পাশে একটি জলাজমি থেকে ছাত্রীর মৃতদেহ উদ্ধার হয় ৷ দেখা যায়, ছাত্রীর দেহে একাধিক আঘাতের চিহ্ন রয়েছে ৷
পরিবারের দাবি, নাবালিকা ছাত্রীটিকে ধর্ষণের পর খুন করে ফেলে দেওয়া হয় পুকুরে ৷ পরে মৃতের পরিবারের তরফে লিখিত অভিযোগ দায়ের করা হয় জয়নগর থানায় ৷ অভিযোগ, প্রথমে মহিষমারি পুলিশ ফাঁড়িতে অভিযোগ জানাতে গিয়েছিল পরিবার ৷ সেখানে অভিযোগ না নিয়ে তাদের জয়নগর থানায় যেতে বলা হয়েছিল ৷ জয়নগর থানা আবার তাদের কুলতলি থানায় পাঠায় ৷ পরিবারের অভিযোগ, পুলিশ প্রথমেই বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখলে মেয়েটিকে হয়তো বাঁচানো যেত ৷
মহিষমারি পুলিশ ফাঁড়িতে আগুন (ইটিভি ভারত) পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ অস্বীকার
এদিন সন্ধ্যায় এসপি ঢালি বলেন, "আমরা যে অবস্থায় মেয়েটির দেহ উদ্ধার করেছি, তা অত্যন্ত বেদনাদায়ক ৷ অভিযুক্ত আমাদের জায়গাটা দেখায় ৷ সেখান থেকে আমরা দেহ উদ্ধার করেছি ৷" পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ তিনি সম্পূর্ণ অস্বীকার করে ব লেন, "পুলিশ কোনও কাজ করেনি ৷ এর প্রমাণ অন রেকর্ডে আছে ৷ পুলিশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চলছে ৷ আমরা পরিবারকে প্রথম থেকে সাহায্য করেছি ৷ মেয়েটির বাবা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিলেন ৷ আপনাদের মাধ্যমে বলতে চাই, এটা নৃশংস অপরাধ ৷ আমাদের সরকারের অবস্থান এবিষয়ে খুবই কড়া ৷ আমরা দ্রুত তদন্ত শেষ করব ৷ যাতে সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া যায়, তার চেষ্টা করব ৷ দ্রুত চার্জশিট পেশ করা হবে ৷ অপরাধীকে যাতে ফাঁসির সাজা দেওয়া যায়, সব দিক দিয়ে তার চেষ্টা করব ৷"
তিনি আরও বলেন, এফআইআর পাওয়ার আগেই তদন্ত শুরু হয়েছে ৷ পাঁচ ঘণ্টার মধ্যে পুলিশ এই মামলার সমাধান করেছে বলে দাবি করেন তিনি ৷ পুলিশের উচ্চাধিকারিক ঢালি বলেন, "এফআইআর-এর আগেই তদন্ত শুরু হয়েছে ৷ তা নাহলে পাঁচ ঘণ্টার মধ্যে কোথা থেকে কী হয়েছে, সবকিছু তদন্ত করে বের করা সম্ভব হত না ৷ আমি আমার দলকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি ৷"
পুলিশ সূত্রে খবর, রাতেই তদন্ত শুরু হয় এবং সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে এক যুবককে চিহ্নিত করা হয় ৷ ফুটেজে দেখা গিয়েছে, যুবক সাইকেলে করে নাবালিকাকে নিয়ে যাচ্ছে ৷ ওই যুবককে রাতেই আটক করে পুলিশ ৷ পরে সে অভিযোগ স্বীকার করলে তাকে গ্রেফতার করা হয় ৷
এদিন বিকেলে নাবালিকার দেহ ময়নাতদন্তের জন্য কলকাতার কাটাপুকুর মর্গে পৌঁছয় ৷ সেখানে মর্গের সামনে নাবালিকার দেহ সংরক্ষণের দাবিতে বিক্ষোভ দেখায় বিজেপি ৷ পুলিশের সঙ্গে রীতিমতো খণ্ডযুদ্ধ চলতে থাকে ৷ জানা গিয়েছে, নাবালিকার বাবাকে মর্গে ঢুকতে দিয়েছে পুলিশ ৷ বিজেপি নেত্রী অগ্নিমিত্রা পলও মর্গের ভিতরে প্রবেশ করেছেন ৷
বাম যুবনেত্রী মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায় দাবি করেন, ভিডিয়োগ্রাফি করে ময়নাতদন্ত হবে এবং সেই সময় পরিবারের কেউ সেখানে উপস্থিত থাকবে ৷ পরিবার ছাড়া অন্য কেউ যেন না থাকে ৷ পুলিশ দু'টি দাবি মেনে নিয়েছে ৷ প্রথমত, ময়নাতদন্তের ভিডিয়োগ্রাফি হবে ৷ দ্বিতীয়ত, পরিবারের একজনের উপস্থিতিতে ময়নাতদন্ত হবে ৷
পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগে এবং দোষীর কঠোর শাস্তির দাবিতে সকাল থেকে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে জয়নগর থানা এলাকা ৷ পুলিশকে ঘিরে বিক্ষোভ দেখায় উত্তেজিত জনতা ৷ পরে রাস্তা অবরোধ করে লাঠি-ঝাঁটা নিয়ে থানায় চড়াও হয়ে ভাঙচুর চালানো হয় ৷ জয়নগরের মহিষমারিহাট পুলিশ ফাঁড়ি তছনছ করে আগুন ধরিয়ে দেন গ্রামবাসীরা ৷ হামলার মুখে পড়ে জখম হন পুলিশের কয়েকজন আধিকারিক ৷ খবর পেয়ে এসডিপিও অতীশ বিশ্বাসের নেতৃত্বে বিশাল পুলিশ বাহিনী এলাকায় পৌঁছলে তাঁকে ঘিরে বিক্ষোভ দেখাতে থাকে জনতা।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে শনিবার সকালে ঘটনাস্থলে আসেন বারুইপুর পুলিশ জেলার পুলিশ সুপার পলাশ চন্দ্র ঢালী ৷ পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ খারিজ করে তিনি বলেন, "পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ৷ এখানে পুলিশের বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে ৷ গতকাল রাত 9টার সময় আমরা খবর পাই ৷ তারপরই তদন্ত শুরু করে হয়। একটা বাজে ঘটনা ঘটে গিয়েছে। আমরা দ্রুত তদন্ত শেষ করতে চাই।" তিনি জানান জিজ্ঞাসাবাদের পর অভিযুক্ত দোষ স্বীকার করে নেওয়ার পর ভোর 3টে নাগাদ তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে ৷
এদিন সকালে ঘটনাস্থলে কুলতলি থানার আইসি সতীনাথ চট্টরাজ পৌঁছলে তাঁকেও ঘিরে ধরে উত্তেজিত জনতা ৷ পরিস্থিতি সামলাতে তিনি তাঁদের বলেন, "যে এই অপরাধ করেছে, তাকে আমরা সাজা দেব ৷ আমি কথা দিচ্ছি ৷" তিনি আশ্বাস দেন, মহিষমারি পুলিশ ক্যাম্পের যে আধিকারিক গতকাল অভিযোগ নিতে চাননি, তাঁর বিরুদ্ধেও যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে ৷
গ্রামবাসীরা আধিকারিকদের কাছে দাবি তোলেন নাবালিকা ছাত্রীর দেহ ময়নাতদন্তের পর তাদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার ৷ কুলতলির তৃণমূল বিধায়ক গণেশ মণ্ডল পরে এলাকায় এলে, ক্ষুব্ধ গ্রামবাসীদের তীব্র বিরোধিতার মুখে পড়েন। স্থানীয়রা অভিযোগ তোলেন, মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন বিধায়ক। পরে বিক্ষোভের মুখে এলাকা ছেড়ে কার্যত পালিয়ে যান তিনি ৷