মালদা, 3 অক্টোবর: রাত কিংবা ভোরে ঢাক বাজলে বোলের আওয়াজ যায় পাশের গ্রামে থাকা বাংলাদেশের মানুষের কানে ৷ মাইকে অষ্টমী তিথির অঞ্জলির মন্ত্রোচ্চারণে প্রতিবেশী দেশের কত মানুষ মুখ মেলান, জানা নেই ৷ তবে তরফদার পরিবারের মায়ের পুজো এখনও নাকি সেদেশের মানুষের মুখে ফেরে ৷ পুজোর পত্তন যে হয়েছিল, ওপার বাংলাতেই ৷
তরফদার পরিবারের আদি বসবাস বাংলাদেশের পাবনা জেলার বাদাই গ্রামে ৷ বিপুল কৃষিজমির মালিক ছিলেন এই পরিবারের পূর্বপুরুষরা ৷ তাঁদের সম্পদ নাকি জমিদারদেরও টেক্কা দেওয়ার ক্ষমতা রাখত ৷ অষ্টাদশ শতকে পরিবারের তিন ভাই, চন্দ্রনাথ, দুর্গানাথ আর যজ্ঞেশ্বরের দাপটও ছিল পাবনাজুড়ে ৷ সেই সময়ই দেবীর স্বপ্নাদেশে বাড়িতে দুর্গাপুজোর পত্তন করেন বড় ভাই চন্দ্রনাথ তরফদার ৷ সময়টা 1850 সাল ৷ সেই শুরু ৷ তারপর থেকে নিরবিচ্ছিন্নভাবে পুজো হয়ে আসছে প্রতিবছর ৷ এবার 174 বছরের পুজো ঘিরে এই মুহূর্তে চূড়ান্ত ব্যস্ততা তরফদার পরিবারে ৷
দুই বাংলাকে এক সুতোয় বেঁধে রাখে মা (ইটিভি ভারত) পুরাতন মালদা ব্লকের মোহনবাগান গ্রাম ৷ এক কিলোমিটারের মধ্যে ভারত-বাংলাদেশের কাঁটাতারের সীমান্ত বেড়া ৷ গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গিয়েছে টাঙন নদী ৷ সেই নদীও খানিক এগিয়ে বাংলাদেশেই ঢুকে পড়েছে ৷ এই মোহনবাগান গ্রামেই 1979 সাল থেকে তরফদার পরিবারের দুর্গাপুজো হয়ে আসছে ৷ প্রথমে টিনের মন্দিরে মায়ের পুজো হত ৷ এখন সেখানে ঝকঝকে পাকা মন্দির ৷
কী জানাচ্ছেন পরিবারের সদস্যরা ?
পরিবারের সদস্যরা জানাচ্ছেন, বাংলাদেশে থাকাকালীন অনেক দুর্যোগ তাঁদের পরিবারের উপর নেমে এসেছিল ৷ গত শতকের ষাটের দশকে কোনও এক বছর সেখানে স্মল পক্স মহামারীর আকার নিয়েছিল ৷ সেই রোগে আক্রান্ত হয়ে পরিবারের 8 সদস্য মারা গিয়েছিলেন ৷ কিন্তু দেবীর পুজো বন্ধ হয়নি ৷ 1971 সালে যখন দুষ্কৃতীরা পুরো বাড়ি পুড়িয়ে ছাই করে দেয়, সেবারও মায়ের পুজো হয়েছিল ৷ অনেক চেষ্টা করেও দুষ্কৃতীরা তাঁর মন্দিরে আগুন লাগাতে পারেনি ৷ তবে, 1971 সালের পর থেকেই তরফদার পরিবারের সদস্যরা একে একে এপার বাংলায় চলে আসতে শুরু করেন ৷ 1979 সালে পরিবারের শেষ সদস্য ভারতে চলে এসেছেন ৷ এখন সেদেশে এই পরিবারের আর কেউ থাকেন না ৷
তরফদার বাড়ির প্রতিমা তৈরি হচ্ছে (নিজস্ব ছবি) পরিবারের সদস্য রবীন্দ্রনাথ তরফদার বলেন, "174 বছরের এই পুজোয় কখনও ছেদ পড়েনি ৷ 1979 সালে যখন দেবীর সব জিনিসপত্র এপারে নিয়ে আসা হয়েছিল, তখন কোনও দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বাধা দেয়নি ৷ সেই বছর থেকেই এখানে পুজো শুরু হয় ৷ পুজোর সময় ঢাকের আওয়াজ পৌঁছে যায় বাংলাদেশেও ৷ এখন আমরা চতুর্থ প্রজন্ম এই পুজো চালাচ্ছি ৷ আমাদের পুজো বৈষ্ণবমতে হয় ৷"
পরিবারের আরও এক সদস্য বিকাশ তরফদার বলছেন, "এখন পরিবারের সদস্য সংখ্যা 150 ছাড়িয়ে গিয়েছে ৷ তবে আমাদের পুজোর বিশেষ কোনও রীতি নেই ৷ দশমী তিথিতে কীর্তন আর ঢাকঢোল বাজিয়ে গ্রামের পুকুরে দেবীমূর্তি নিরঞ্জন করা হয় ৷"
পত্তনের সময় যেসব সামগ্রীতে মায়ের পুজো করা হয়েছিল, এখনও সেই সামগ্রীতেই তরফদার বাড়িতে দুর্গাপুজো হয় ৷ বাড়ির ছোট বউ বীণা তরফদার বলছিলেন, দেবী স্বপ্নাদেশে চন্দ্রনাথ তরফদারকে জানিয়েছিলেন, বাড়ির পুকুরপাড়ে পুজোর সমস্ত সামগ্রী রাখা আছে ৷ সেই সামগ্রী দিয়েই যেন তাঁর পুজো হয় ৷ এই পুজো ঘিরে আরও লোকগাথা রয়েছে ৷ একবার এক বাচ্চা মেয়ে গ্রামে আসা শাঁখারির কাছ থেকে শাঁখা নিয়েছিল ৷ শাঁখারি দাম চাইলে সে তাকে বলেছিল, সে চন্দ্রনাথের মেয়ে ৷ শাঁখারি যেন চন্দ্রনাথের কাছ থেকেই শাঁখার দাম নিয়ে নেয় ৷
তরফদার বাড়ির প্রতিমা তৈরি হচ্ছে (নিজস্ব ছবি) বীণাদেবীর কথায়, "এরপর শাঁখারি চন্দ্রনাথের কাছে গিয়ে সব ঘটনা জানিয়ে দাম চায় ৷ ভাবনায় পড়ে যান চন্দ্রনাথ ৷ তাঁর কোনও মেয়ে ছিল না ৷ তিনি বুঝতে পারেন, স্বয়ং দেবী মেয়ে হয়ে তাঁর কাছে এসেছেন ৷ তখন থেকেই মানুষজন শাঁখা দিয়ে মায়ের কাছে মানত করেন ৷ প্রতিবছর পুজোয় প্রচুর শাঁখা মাকে উৎসর্গ করেন ৷ মানুষ বিশ্বাস করেন, ঘরে বিবাহযোগ্যা মেয়ে থাকলে শাঁখার মানতে নাকি খুব তাড়াতাড়ি পাত্রের সন্ধান মেলে ৷"
শিল্পী কী জানাচ্ছেন?
1979 সাল থেকেই তরফদার বাড়ির দেবীমূর্তি তৈরি করে যাচ্ছেন মুচিয়া বারুইপাড়ার শিল্পী প্রভাত পাল ৷ বয়সের ভারে শরীর ঝুঁকে গিয়েছেন অনেকটাই ৷ কিন্তু এখনও এই বাড়িতে তিনিই মায়ের মূর্তি গড়েন ৷ তিনি বলেন, "আগে মূর্তির আকার ছোট ছিল ৷ তখন টিনের চালার নীচে পুজো হত ৷ প্রথম থেকেই মহাষষ্ঠীর দু'দিন আগে মায়ের চক্ষুদান হয় ৷ এবারও তার ব্যতিক্রম হবে না ৷"