পশ্চিমবঙ্গ

west bengal

ETV Bharat / state

কেন্দ্র-রাজ্য কাঠগড়ায়, পেট চলে না কলাকুশলীদের ! উৎসবে নাটকের পুনরুজ্জীবন

ইস্টার্ন জোনাল কালচারাল সেন্টারে শুরু হয়েছে বেঙ্গল থিয়েটার রিজুভিনেশন ফেস্টিভাল ৷ বিভিন্ন জেলা থেকে আসা প্রতিভাধর শিল্পীরা শোনালেন তাঁদের অনটনের জীবন কাহিনি ৷

ETV BHARAT
বেঙ্গল থিয়েটার রিজুভিনেশন ফেস্টিভাল (নিজস্ব চিত্র)

By ETV Bharat Bangla Team

Published : Nov 5, 2024, 8:01 PM IST

কলকাতা, 5 নভেম্বর:প্রতিভাটাই শেষ কথা নয় । সঙ্গে চাই আর্থিক বল ৷ নইলে প্রতিযোগিতার ইঁদুর দৌড়ে পিছিয়ে পড়তে হয় । এই কড়া সত্যিটাই হাড়ে হাড়ে টের পায় বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছোট ছোট নাটকের দলগুলি । আকাশছোঁয়া প্রতিভা থাকলেও চরম অর্থাভাবের সঙ্গে লড়তে লড়তে একটা সময়ে মনোবলটাই ভেঙে যায় । এই ধরনের ছোট দল, যাদের প্রতিভা রয়েছে কিন্তু অর্থের অভাবে মঞ্চ পাচ্ছে না, তাদের আর্থিক সহায়তা ও প্রচার পাইয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে প্রতিবারের মতো এবারও রাজ্যে শুরু হয়েছে বেঙ্গল থিয়েটার রিজুভিনেশন ফেস্টিভাল ৷

ইস্টার্ন জোনাল কালচারাল সেন্টারে ভারত সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রক আয়োজিত এই নাট্য উৎসবের উদ্বোধন করেন রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস ।ইজেডসিসি-র অধিকর্তা আশিস গিরি জানিয়েছেন যে, ভারত সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রকের এই প্রকল্পে পশ্চিমবঙ্গের পিছিয়ে পড়া একাধিক ছোট নাটকের দলকে সরকারি সুযোগ পাইয়ে দেওয়া হচ্ছে । এর ফলে বাংলার থিয়েটার সংস্কৃতি আরও এগিয়ে যেতে পারবে ।

ইস্টার্ন জোনাল কালচারাল সেন্টারে বেঙ্গল থিয়েটার রিজুভিনেশন ফেস্টিভাল (নিজস্ব ভিডিয়ো)

নভেম্বর ও ডিসেম্বর এই দু' মাস ধরে পশ্চিমবঙ্গের 10টি জেলা থেকে নির্বাচিত 50টি নাটকের দলকে নিয়ে উৎসবের প্রথম পর্যায় শুরু হয়েছে । এরপর কর্মসূচির দ্বিতীয় পর্যায়ে যোগ দেবে আরও নির্বাচিত 50 থেকে 60টি নাটকের দল । এর ফলে 50টি দলের প্রায় 4000 কলাকুশলী ও নাটকের সঙ্গে যুক্ত মানুষজন উপকৃত হবেন । যে নাটকের দল এই কর্মসূচিতে যুক্ত হয়েছে, তাদের একটি সাম্মানিকও দেওয়া হবে ৷ যার অর্থমূল্য হল 20 হাজার টাকা ।

পূর্ব মেদিনীপুরের মহিষাদলের এক প্রত্যন্ত গ্রাম লক্ষার বাসিন্দা অলকেশ সামন্ত তাঁর দল নিয়ে সেখানে এসেছেন । রবীন্দ্রভারতীর নাট্য বিভাগ থেকে যখন স্নাতকোত্তর পাশ করেন, তখন তাঁর চোখে অনেক স্বপ্ন । ভেবেছিলেন নাটকের মাধ্যমে বদলে দেবেন নিজের গ্রামের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটকে । কিন্তু তাঁর স্বপ্নভঙ্গ হতে বেশিদিন সময় লাগেনি । তবে আজও অলকেশ ও তাঁর নাটকের দল 'লক্ষা পদাতিক' দিনবদলের অপেক্ষায় রয়েছেন, তাঁরা চান এমন দিন যেদিন অর্থ নয়, প্রতিভার নিরিখে বিচার পাবে শিল্পী এবং তাঁর শিল্প ।

উৎসবে নাটকের পুনরুজ্জীবন (নিজস্ব চিত্র)

অলকেশ সামন্তের কথায়, তাঁদের জীবন এবং জীবিকা দুটোই হল নাটক । তাই মাধুকরী ঘরানায় (নাটকের শেষে তাঁরা দর্শকের সামনে একটি সাদা কাপড় মেলে ধরে আর্থিক সাহায্য চান) তাঁরা নাটক করে সংসার চালান । তিনি বলেন, "এত কম টাকায় যেমন সংসার চলে না, তেমনই নাটকটাও ভালোভাবে করা যায় না। তাই আমরা আমাদের চাহিদা কমিয়ে দিয়েছি । দু'বছর আগে আমার একটি দুর্ঘটনা হয় । চিকিৎসা করিয়ে নাটক করে এবং সংসার চালিয়ে চরম আর্থিক সংকটের মধ্যে দিয়ে দিনযাপন করছি ।"

বেঙ্গল থিয়েটার রিজুভিনেশন ফেস্টিভালে চলছে নাটক (নিজস্ব চিত্র)

রাজ্য বা কেন্দ্রের পক্ষ থেকে এখনও তেমন আর্থিক সাহায্য মেলেনি বলে তাঁর আক্ষেপ । তবে আশা, হয়ত এই ধরনের প্রকল্প ও উদ্যোগের মধ্যে দিয়ে কিছুটা পরিস্থিতির সুরাহা হবে । মানুষ আবার হলমুখী হবেন এবং ছোট নাটকের দলগুলিও সুদিন দেখবে ।

হলদিয়ার আর এক দুঃস্থ নাট্যকর্মী তথা বাউল শিল্পী দুলাল খ্যাপা নাট্যকর্মী হলেও পেটের ভাত জোগাতে বাউল ও লোকসঙ্গীতও পরিবেশন করে বেড়ান । রাজ্য বা কেন্দ্রীয় সরকারের থেকে কোনও সাহায্য মেলেনি । নাটক করে ও গান গেয়ে মাধুকরী করেই চলে সংসার । তিনিও আজ সামিল হয়েছেন বেঙ্গল থিয়েটার রিজুভিনেশন ফেস্টিভালে ৷

ইস্টার্ন জোনাল কালচারাল সেন্টারে বেঙ্গল থিয়েটার রিজুভিনেশন ফেস্টিভাল (নিজস্ব চিত্র)

প্রত্যন্ত গ্রামে থাকা বহু নাটকের দল যাঁদের কাছে নিজেদের শিল্পকে টিকিয়ে রেখে বেঁচে থাকাটাই একটা মস্ত চ্যালেঞ্জ, তাঁরা বেশিরভাগই কেন্দ্র বা রাজ্য সরকারের প্রকল্পগুলির সম্বন্ধে জানতেই পারেন না । তাঁদের জন্য সরকারের এই উৎসব বড় একটা প্ল্যাটফর্ম ৷ ইজেডসিসি-র অধিকর্তা আশিস গিরি বলেন, "শুধুমাত্র বছরে একটা কী দুটো শো দিয়ে তো থিয়েটারের দলগুলিকে বাঁচিয়ে রাখা যায় না, তাই সারা বছর বিভিন্ন কর্মসূচি চলতে থাকে । তার মধ্যে একটি যেমন তাদের নাটক মঞ্চস্থ করতে সুযোগ করে দেওয়া, তেমনই দলগুলির জন্য প্রশিক্ষণ শিবির ও সেমিনারের মাধ্যমে তাদের আর্থিক সহায়তা করা ।"

বেঙ্গল থিয়েটার রিজুভিনেশন ফেস্টিভালে কোনও নামী দামি নাটকের দলকে রাখা হয়নি । তবে কলকাতা থিয়েটার ফেস্টিভ্যাল নাম দিয়ে আরও একটি অনুষ্ঠান শুরুর পরিকল্পনা করা হচ্ছে, যেখানে কলকাতার নামী দামি নাটকের দলগুলিকেও যুক্ত করা হবে বলে জানান আশিস গিরি ৷ তাঁর কথায়, দল নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রকৃত অর্থে প্রতিভাশালী অথচ পিছিয়ে থাকা এবং আর্থিকভাবে দুর্বল ছোট দলকে সুযোগ করে দেওয়া হবে । বিভিন্ন জেলা যেমন পূর্ব মেদিনীপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম এবং বাঁকুড়া - এই জেলাগুলির নাটকের দল নিয়ে ঝাড়গ্রামে নাটকের অনুষ্ঠান করা হবে । আবার একইভাবে মালদায় উত্তরবঙ্গের জেলাগুলিকে নিয়ে নাটকের অনুষ্ঠান করা হবে ।

2 মাস ধরে চলবে উৎসব (নিজস্ব চিত্র)

আর এক নাট্যশিল্পী সুমন সিং রায় বলেন, "এই জীবিকার বিকল্প উপায় আর নেই আমাদের । তবে থিয়েটার করে সংসার চালাতে যে অর্থের প্রয়োজন সেটা পাই না । তাই চেষ্টা করছি যে, ভালো কাজ দেখিয়ে যদি কিছু সুযোগ সুবিধা পাওয়া যায় ।" তিনি দলের সাম্প্রতিক একটি অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করে জানান যে, চড়া ভাড়া গুনে কলকাতার তপন থিয়েটারে নাটক মঞ্চস্থ করতে গিয়ে তাঁরা দেখেছিলেন যে, টিকিট বিক্রি হয়েছে মাত্র 30টি ৷ অথচ হলে প্রায় 150 থেকে 200 জন দর্শক বসে রয়েছেন । হল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে এই বিষয়ে কথা বলেও তেমন সুরাহা কিছু হয়নি ।

আরেক নাট্যকর্মী সায়ন প্রামাণিকের প্যাশন হল নাটক, কিন্তু জীবনধারণের জন্য তিনি একটি সাইকেল গ্যারেজে কাজ করেন । সায়ন জানান যে, 12 থেকে 13 বছর তিনি থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত । তাঁর কথায়, "একেবারেই ভালোবাসার জায়গা থেকে আমরা থিয়েটার করি । তবে সরকারি সাহায্য পেলে হয়তো আরও ভালোভাবে থিয়েটারটা করতে পারতাম । এক একটা নাটকের প্রোডাকশনের মান অনেক ভালো হত ।"

নাটকের জগৎ যে শুধুমাত্র নন্দন বা আকাদামিতেই সীমাবন্ধ নয়, বেঙ্গল থিয়েটার রিজুভিনেশন ফেস্টিভালে সেটাই বুঝিয়ে দিচ্ছেন ছোট ছোট অথচ প্রতিভাশালী নাটকের দল ও তাঁর কলাকুশলীরা ।

ABOUT THE AUTHOR

...view details